নিজস্ব প্রতিবেদক

৩০ মার্চ, ২০২০ ০১:৩৯

চা শ্রমিকরা কি করোনার ঝুঁকিমুক্ত?

চা বাগানগুলোতে এখনো চলছে কার্যক্রম, মজুরি-রেশনসহ বন্ধের দাবি

শনিবার দুপুরে শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানের কাজ করছিলেন ১৫-২০ জন শ্রমিক। কারো হাতে গ্লাভস নেই, মুখে মাস্ক নেই। পাতা উত্তোলন, চারা গাছ পরিচর্যার একসাথে বসে দুপুরের খাবারও খান তারা।

খাবার খেতে খেতেই নারী চা শ্রমিক গীতা হাজরা বলেন, বাগান থেকে আমাদের কোন সুরক্ষা ব্যবস্থা করা হয় নি। সবাই বলছে বার বার হাত ধূতে, মাস্ক ব্যবহার করতে। আমরা চা শ্রমিকরা এগুলো কিভাবে কিনবো। আমাদের এমনিতেই নুন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থা।

আরেক শ্রমিক সাধন হাজরা বলেন, সারাদেশের মত চা বাগানগুলোও লকডাউন করে দেওয়া দরকার। চা বাগানে সবাই পাশাপাশি ঘনবসতি করে বসবাস করে। যদি করোনা ভাইরাস চা বাগানে ছড়ায় তাহলে ভয়ংকর রূপ নিবে।

শুধু এই কয়েকজনই নয় করোনা আতঙ্কের মধ্যেও নিয়মিত কাজে যেতে হচ্ছে দেশের ১৬৬টি চা বাগানের প্রায় দুই লাখ শ্রমিককে। এরমধ্যে এরমধ্যে সিলেট বিভাগেই রয়েছে ১৩৮টি বাগান।

সিলেটের বেশ কয়েকটি চা বাগান ঘুরে দেখা যায়, পর্যাপ্ত সুরক্ষা উপকরণ ছাড়াই পাতা উত্তোলনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন শ্রমিকরা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বালাই নেই সেখানে। তবে কোনো কোনো বাগান মালিক শ্রমিকদের মাস্ক সরবরাহ করেছেন, ব্যবস্থা করেছেন হাত ধোয়ার।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ২৫ মার্চ সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত ৪ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বন্ধ হয়েছে গিয়েছে শ্রমঘন শিল্প পোশাক খাতের অধিকাংশ কারখানা। যদিও দাবি সত্ত্বেও এখনো ছুটি পাননি আরেক শ্রমঘন খাত চা বাগানের শ্রমিকরা। এ বিষয়ে শ্রম অধিদপ্তরে দফায় দফায় চিঠি দিয়েও সদুত্তর পায়নি চা শ্রমিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন।

এদিকে, শ্রমিকদের বেতন ও রেশন প্রদান করে চা বাগান বন্ধের দাবিতে শনিবারও সিলেটের জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করেছে চা শ্রমিকদের একটি সংগঠন।

চা শ্রমিকদের চিঠির বিষয়ে শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত বিভাগীয় শ্রম অধিদপ্তরের উপপরিচালক নাহিদ হোসেন বলেন, চা শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে আমাদের চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের কেবিনেট সভার পত্র অনুযায়ী চা বাগানের শ্রমিকদের বাধ্যতামূলক ছুটির ঘোষণা নেই। তবে বাগান মালিকরা চাইলে নিরাপত্তার স্বার্থে বাগানের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে পারেন। বিষয়টি আমরা শ্রমিক নেতাদের জানিয়ে দিয়েছি। করোনাভাইরাসের ঝুঁকি এড়াতে এখানে আমাদের কিছুই করার নেই।

জানা গেছে, ২৫ মার্চ করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে বাগানগুলোতে সচেতনতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চিঠি দেয় বাংলাদেশ চা বোর্ড। চিঠিতে চা বোর্ডের দেয়া আট নির্দেশনায় বাগানের কার্যক্রম বন্ধ রাখা ও শ্রমিকদের ছুটি প্রদানের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। বোর্ডের নির্দেশনা পেয়ে কিছু বাগান মালিক সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ বেশকিছু কর্মসূচি পালন করলেও সারা দেশের সব বাগানে এসব নির্দেশনা পরিপালন হয়নি। ফলে দেশের প্রায় দেড় লাখ চা শ্রমিকসহ প্রায় ছয় লাখ জনগোষ্ঠীর মধ্যে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করছেন চা শ্রমিক নেতারা।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২৭ মার্চ কমলগঞ্জ ও ২৮ মার্চ শ্রীমঙ্গলের বেশকিছু চা বাগানের শ্রমিকরা নিজ উদ্যোগে কাজ বন্ধ করে কর্মবিরতিতে চলে গেছেন। এর মধ্যে কমলগঞ্জে শমসেরনগর, দেওচড়া, বাগিচড়া, ডবলচড়া ও মিতিঙ্গা চা বাগানের কাজ বন্ধ রাখেন ক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। ২৮ মার্চ শনিবার সাতগাঁও, মাকরিছড়া, ইছামতী ও মাঝদীঘি (শ্রীমঙ্গল) চা বাগানের ও ২৯ মার্চ সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগানের কার্যক্রমও বন্ধ করে দেন শ্রমিকরা। মূলত ভারতের আসাম রাজ্যের ৮৬০টি চা বাগানের কাজ বন্ধ ঘোষণার খবর এলে দেশের প্রায় সব চা বাগানের শ্রমিকরা ছুটির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন।

কাজের প্রয়োজনে নিবিড়ভাবে চলাফেরা করতে হয় চা শ্রমিকদের। এ কারণে চা বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদকে চিঠি দিয়ে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত শ্রমিকদের বাধ্যতামূলক ছুটির দাবি জানান শ্রমিক নেতারা। ২৬ মার্চ দেয়া ওই চিঠিতে ছুটি দেয়া না হলে বাগানের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করলেও ছুটির বিষয়ে এখনো কিছুই জানাননি বাগান মালিকরা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কইরি বলেন, চা শ্রমিকরা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বাস করেন। নিত্যপ্রয়োজনে হাটবাজার ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে চলাচল করেন তারা। এছাড়াও চা শ্রমিকদের অনেকেই বাগানের কাজ ছাড়াও স্থানীয় বাসা-বাড়িতেও কাজ করে। এ অবস্থায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সারা দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মতো চা শ্রমিকদের ছুটি দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু শ্রম অধিদপ্তর ও বাগান মালিকরা আমাদের দাবি কোনোভাবেই মেনে নিচ্ছেন না। এসব কারণে অনেক বাগানের শ্রমিকরা সংক্ষুব্ধ হয়ে নিজেরাই বাগানের কাজ বন্ধ করে দিচ্ছেন। প্রশাসন ও বাগান মালিকরা দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত না নিলে সারা দেশের চা বাগানের পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।

চা শ্রমিকরা অভিযোগ করে বলেন, একজন চা শ্রমিক শুধু বাগানে চা প্লাগিংই করেন না। বরং বাগান থেকে কুঁড়ি উত্তোলন থেকে শুরু করে চা উৎপাদন কারখানা চালু রাখা, চা মোড়কজাত, চা পরিবহনসহ সব ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত। চা শ্রমিকদের সঙ্গে বাগানের বাইরে থেকে আসা শ্রমিকদেরও অবাধে সংস্পর্শ হচ্ছে। ফলে বাগান মালিকদের চা বাগান নিয়ে অবহেলা এ খাতে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

চা শ্রমিকদের ঝুঁকির বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক ডা. দেবপদ রায় বলেন, এখন কাউকেই ঝুঁকিমুক্ত বলা যাবে না। চা বাগানে শ্রমিকরা খুব গাদাগাদি অবস্থায় থাকেন। তাদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও পরিচ্ছন্নতা উপকরণের অভাবও রয়েছে। ফলে তারা ঝুঁকির মধ্যেই রয়েছেন। এ অবস্থায় তাদের ঘরে থাকাই ভালো। বিষয়টি আমি গত বৃহস্পতিবার সিলেটের বিভাগীয় কমিশনারকেও জানিয়েছি।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে চা বাগানের ভেতরে দর্শনার্থী প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে জানিয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক কাজী এম. এমদাদুল ইসলাম বলেন, এখন তো সবাইকেই ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে। তবে চা বাগানগুলো যেহেতু সংরক্ষিত নয়, তাই অনেকেই ভেতরে চলে যায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাইরের কেউ যাতে ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে এজন্য ব্যবস্থা নিতে বাগান কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে। তবে বাগানের কার্যক্রম বন্ধের কোনো সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত