আফরোজা আক্তার

২৮ আগস্ট, ২০১৬ ২২:০১

নৈসর্গিক এক স্বর্গে ভ্রমণ আনন্দ

ছুটছি ছুটছি আর ছুটছি। জীবনটাই চলছে দুরন্ত গতিতে ছুটে। জীবনের প্রয়োজনে ছুটতেই হবে। তবে সেই ছুটাটাকে মাঝে মাঝে আনন্দময় করার জন্য প্রয়োজন কিছু উপাদান। আর এই উপাদান খুঁজতে আমরা বেড়িয়ে পড়েছিলাম টরন্টো শহর থেকে প্রায় ৩২০ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত টোবারমোরি শহরে। এটি কানাডার ব্রুস পেনিনসুলার সর্ব উত্তরের বিন্দু, একটা ছোট্ট শহর। পর্যটকদের খুব প্রিয় এই জায়গাটা।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে পুরোপুরি উপভোগ করার জন্য একটি রাত অবস্থান করেছিলাম সেই শহরের কাছাকাছি অন্য একটা শহরে। এই শরটির নাম ওয়েন সাউন্ড। সৌন্দর্যের দিক থেকে ওয়েন সাউন্ডও পিছিয়ে নেই। তবে, টোবারমোরি যেহেতু একটি পয়েন্টে এবং এখান থেকে খুব অল্প সময়ে জাহাজ অথবা বোটে করে কাছাকাছি দ্বীপগুলোতে যাওয়া যায় সেজন্য অনেকেই এখানে আসতে পছন্দ করে। এখানে পাঁচটা দ্বীপ আছে, যার সবগুলোই পার্ক কানাডার আওতায়। এরা বলে ফ্যাদম ফাইভ পার্ক। এদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়টা হচ্ছে ফ্লাওয়ারপট আইল্যান্ড। পর্যটকরা মূলত এটাতেই যায়।

শীতের দেশ কানাডা কে না জানে। বছরের একটা বড় অংশ তীব্র ঠাণ্ডা আর তুষারপাতের সাথে যুদ্ধ করতে হয়। যখন শীতকাল না, তখনও ঠাণ্ডার কমতি থাকে না। ব্যতিক্রম হচ্ছে সামার। উষ্ণ, রোদেলা এবং সবুজ। কাজেই সামারের প্রতিটা দিনই যেন উপভোগ করা যায় সেদিকেই সবার নজর থাকে। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। বছরে দুই সপ্তাহ ছুটি পাই এবং এই ছুটিটাকে যথার্থভাবে ব্যবহার করার জন্য বেছে নিলাম দুটি দিন। ছুটির প্রথম দিন কাটালাম কোথায় যাওয়া যায় সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। কারণ, সময় এবং অর্থ দুটোকেই বাজেটের মধ্যে আনতে হবে। শুরু হল গুগল সার্চ।

টরন্টো থেকে ড্রাইভিং ডিস্টান্সে কোথায় যাওয়া যায়? অনেক অনেক ভ্রমণ স্পটগুলোর মধ্যে আকৃষ্ট করল ফ্লাওয়ারপট আইল্যান্ড। ইচ্ছাটাকে গোপন রেখে পরিকল্পনা করছিলাম কীভাবে টোবারমোরি যাওয়া যায়। কারণ, টোবারমোরি থেকে ফ্লাওয়ারপট আইল্যান্ডের ভ্রমণটা কিছুটা হলেও ব্যয়বহুল। যাই হোক, টোবারমোরি পৌঁছানো মাত্র বড় বড় সাইনবোর্ডে ছবিসহ লিখা ‘ Visit flowerpot Island with the Blue Heron Cruises. See the shipwrecks through glass bottom ship দেখে ঢুকে পড়লাম ব্লু হিরন ক্রুজ কোম্পানির অফিসে।

ডেস্কে বসা স্বর্ণকেশী পটপট করে বলে দিলো ওদের ক্রুজের সময়সূচী এবং টিকিট মূল্য। আমাকে টিকিট মূল্য কিছুটা আহত করলেও আমার স্বামীর কথায় যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। ‘এতো কাছে এসে ফ্লাওয়ারপট আইল্যান্ড দেখবানা, এটা কেমন হয়?’আমি মনে মনে বলি আমারও ছিল মনে, কি করে তুমি পারিলে সেটা জানতে।

অবশেষে যাত্রা শুরু হল। গ্লাস বটম বোট আমাদের। ক্যাপ্টেন সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। ক্যাপ্টেনের সহকারী এসে বর্ণনা করলেন যাত্রা পথে কোন বিপদ এলে কিভাবে তা প্রতিহত করতে হবে এবং তার প্রয়োজনীয় উপকরণ সমূহ কোথায় এবং কিভাবে রাখা আছে। ক্যাপ্টেন বলে যাচ্ছেন দ্বীপটি সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ‘আমরা যে দ্বীপটিতে যাচ্ছি এটির আয়তন ২০০ হেক্টর। এই দ্বীপটি তৈরি হয়েছে দুটি আনউজুয়াল রক ফরমেশন থেকে। যা দেখতে অনেকটা ফ্লাওয়ার পটের মত। একারণেই দ্বীপটি নাম ধারণ করেছে ফ্লাওয়ার পট।‘দ্বীপের আরও কিছু বর্ণনার সাথে সাথে সবাইকে অনুরোধ করলেন যেন সবাই তাদের ব্যবহৃত গারবেজ সঙ্গে করে নিয়ে আসে।

যাত্রার তিন মিনিটের মধ্যেই স্মল টাব থেকে বিগ টাবে চলে এলো বোট। দেখা গেল পানির নিচে প্রায় দেড়শ বছর আগের ডুবে যাওয়া দুটো কাঠের জাহাজ। ওখানকার পানি এতোই পরিষ্কার যে গ্লাস বটম বোটের কোনো প্রয়োজন নাই, বোটের ব্যালকনি থেকেই খালি চোখে সব দেখা যায়। এমনকি পানির নিচের প্রতিটি পাথরকেও গোনা যায়। উজ্জ্বল আকাশের কারণে লেকের পানি ধারণ করেছে গাঢ় নীল রঙ। দ্বীপের গাছগুলো ছড়াচ্ছে যেন সবুজের সমারোহ। এই দৃশ্য শুধু উপলব্ধি করার।

দ্বীপে যাবার পর মনে হল আমরাই যেন প্রথম পা রাখলাম এই দ্বীপে। এক একটা গাছ যেন সাক্ষী কয়েকশ বছরের। কতগুলো গাছ দাঁড়িয়ে আছে শুধুই পাথরের উপরে। হারিয়ে যাবার কোন ভয় নাই, দিক নির্দেশনা আছে সব জায়গায়। এ ছাড়াও দ্বীপে আছে নিরাপত্তার বন্দোবস্ত। প্রতিটি বোটে কতজন যাত্রী বহন করে নিয়ে আসছে আর কত জনকে নিয়ে যাচ্ছে তা প্রতিনিয়ত মনিটরিং হচ্ছে।

ভ্রমণটিকে শুধু আনন্দদায়ক বললে ভুল হবে। আনন্দের সাথে সাথে নিয়ে এসেছি কিছু সচেতনতা, যা ঐ জাহাজের ক্যাপ্টেন দিয়েছেন। দিয়েছেন বোট থেকে নামার পরপরই পার্ক কানাডার একজন কর্মী। তার দায়িত্ব হচ্ছে প্রতিটা বোটের যাত্রীরা নামার পরেই তাদের জড়ো করে একটা ব্রিফিং দেওয়া। তার ঐ ব্রিফিং এর মধ্যে একটা ছিল, ‘তুমি যদি তোমার পরবর্তী বংশধরদের জন্য একটি সুন্দর এবং পরিচ্ছন্ন দ্বীপ রেখে যেতে চাও তাদের উপভোগের জন্য, তবে অনুগ্রহ করে তোমার ব্যবহৃত সমস্ত ময়লা সাথে করে নিয়ে এসো। চয়েস ইজ ইয়োরস।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত