মাসকাওয়াথ আহসান

১৭ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০৭

বঙ্গ বাহাদুরের মৃত্যু: কে দায়ী?

রম্য

গত ২৮ জুন আসাম থেকে রৌমারী জলসীমান্ত অবৈধভাবে অতিক্রম করে উন্মত্ত যমুনা সাঁতরে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে একটি ভারতীয় হাতি। টেলিভিশনের “এলিফ্যান্ট লাইভে” এই হাতির অবৈধ অনুপ্রবেশের খবর ছড়িয়ে পড়লে সক্রিয় হয় দায়িত্বশীলেরা। তারা বুঝতে পারে হাতিটি বৈধ ভিসা ছাড়াই ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশে।

ফেসবুকের প্রাইভেট ডিটেকটিভেরা সন্দেহ করেন, এ হয়তো বিচ্ছিন্নতাবাদী উলফার হাতি; স্বাধীনতা বিরোধীদের স্বপ্ন পূরণে স্বাধীনতার চেতনার সফল সরকারকে বিপাকে ফেলতেই তার এই অবৈধ অনুপ্রবেশ।

অবশ্য সানন্দবাজারের “গুলশন থেকে ষড়যন্ত্র এখন মনযমুনায়” শীর্ষক কাব্য প্রতিবেদনে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়, এ হাতি স্বাধীনতার বিপক্ষের না হয়ে স্বপক্ষেরও হতে পারে। কারণ হাতিটি প্রথমেই যায় রংপুরের ফুলছড়িতে; তাই হাতিটিকে হুট করে স্বাধীনতার বিপক্ষের তকমা দিয়ে দেয়া ঠিক হবে না।

কিন্তু হাতিটি এরপর বগুড়ার সারিয়াকান্দীতে যাওয়াতে নড়েচড়ে বসে মিডিয়া। বগুড়ায় স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির দাদার বাড়ী; সুতরাং সন্দেহভাজন হাতিটির গতিবিধিতে অশুভ ইঙ্গিত ধরা পড়ে। এসময় ভারতীয় টিভি চ্যানেলে দেয়া সাক্ষাতকারে স্বাধীনতার চেতনার একজন বাতিঘর বলেন, ইয়ে হাতি মেরা সাথি নেহি হ্যায়; ইয়ে আই এস আই কা হাতি হ্যায়; মে একশো পার্সেন্ট শিওর ইয়ে হাতি হামারা বিরাট ক্ষতি করেগা। উসকো কানমে রাডার হ্যায়; শুঁড় মে গ্রেনেড হ্যায়; দাঁত মে চাপাতি হ্যায়; ইয়ে হাতিকো থামানা পড়েগা।

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ফেসবুকের স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিরা বলে, পাকিস্তানের হাতি পাকিস্তানে ফিরে যা।

এরপর হাতিটি জামালপুরের বাহাদুরাবাদে গেলে বোঝা যায় এটি বাহাদুর হাতি। এ হয়তো ভারতের শৌর্যের প্রতীক; নইলে বানভাসি হাতি শত শত কিলোমিটার সাঁতার দিয়ে কিছুই না খেয়ে কারো কোন ক্ষতি না করে বাহাদুরি দেখিয়ে গ্রামবাসীকে আনন্দ দিতে আসবে কেন! অভিমত দ্রুত বদলাতে থাকে। স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি এবার হাতিটির সঙ্গে তাদের চিরাচরিত ভারত বিরোধিতাকে সম্পর্কিত করে বলে, এই হাতি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো ভারতের প্রতি কতটা নতজানু এই সরকার। ৪ টন ওজনের হাতি কোন রকম ট্রানজিট ফি না দিয়ে বাংলাদেশে ঘুরছে। এসব দেখার কী কেউ নেই! সবাই কী দলকানা!

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ফেসবুকের স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিরা বলে, ভারতের হাতি ভারতে ফিরে যা!

এরপর হাতিটি সিরাজগঞ্জের কাজীপাড়ায় উপস্থিত হলে স্থানীয় কাজীরা হাতিটির বিবাহের তোড়জোড় শুরু করে। ফেসবুকের জাতির বিবেকেরা বলে, চারিদিকে বন্যার্ত মানুষের আহাজারি; এর মধ্যে হাতির বিয়ে! আমাদের বিবেক কী মরে গেছে! আমরা কী মানুষ!

এসময় রামপালের বিপক্ষ শক্তি কটাক্ষ করে, হাতির বিয়ে যে দেবে; হাতী পাবে কোথায়! রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের ঘোষণা দেবার পর দেশের সব হাতি বিলুপ্ত হয়েছে।

রামপালের পক্ষের শক্তি বলে, উন্নয়নের এই শত্রুরা আসলে ভারত বিরোধী। একারণেই তারা হাতির বিয়েতে বাগড়া দিচ্ছে। রামপাল প্রকল্পটি চীনকে দিলেই এরা বলতো রামপালের কয়লা হাতির দাঁত মেজে ঝকঝকে করে দেবে।

অরণ্যমন্ত্রী হাতির বিবাহের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। উনি বলেন, হাতিটিকে উদ্ধার করে জাতীয় উদ্যানে নেয়া হোক। এর মাঝে ভারতে বেড়াতে যাওয়া বাংলাদেশের হাতিরা ফিরে এলে রাষ্ট্রীয় খরচে এই অতিথি হাতিকে আমরা বিয়ে দেবো। এতে ভারতের সঙ্গে একটা “বেয়াই” সম্পর্ক তৈরি হবে। তখন আমরা ভারতের কাছ থেকে অনেক সুযোগ সুবিধা নিতে পারবো।

২৮ জুলাই হাতিটি সরিষাবাড়ির শুয়াকৈরে পৌঁছে যাবার পর, বন বিভাগের অত্যন্ত দক্ষ কর্মীরা হাতিটি বশ মানাতে চেষ্টা করে। নানারকম নেশা দ্রব্যগুণে হাতিটি কোনমতে ঘুমায়। কিন্তু ঘুম থেকে জেগেই সে মাতলামি শুরু করে। কখনো পুকুরে নেমে সাঁতার কাটে; কখনো রাস্তায় হেঁটে গ্রামবাসীকে তার প্রতি অনুরক্ত করে তোলে। আর অনুরক্ত মিডিয়াও সারাক্ষণ হবু আত্মীয় বঙ্গবাহাদুরের সঙ্গে ছিলো।

তারপর আসে ভয়ার্ত ১৪ অগাস্ট। হাতিটি কয়রা গ্রাম থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে দৌড়ে যেতেই সেখানে বনকর্মী ও সংবাদকর্মীরা পৌঁছে যাবার আগেই একটি বাইকে করে তিনটি যুবক এসে কী এক ইনজেকশান দিলে অনেক মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করে ১৬ অগাস্ট “বঙ্গবাহাদুর” পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। অসমর্থিত সূত্র দাবী করছে, আই এস হাতিটির হত্যার দায় স্বীকার করেছে।

তবে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ বলছে, ময়না-তদন্ত এবং ভিডিও ফুটেজে হাতির বডি ল্যাঙ্গুয়েজ পরীক্ষার আগে কিছুই বলা যাচ্ছে না।

অবশ্য স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি দাবী করছে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মধুর সম্পর্ক তিক্ত করতে এই ষড়যন্ত্র। স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিকে কোথাও ফেইক জন্মদিনের কেক কাটতে না দেয়ায় তারা প্রতিশোধ নিয়েছে। চারিদিকে ষড়যন্ত্র; হুঁশিয়ার ভাইলোগ।

স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি এর প্রতিবাদে বলেছে, হাতিটাকে পাহারা না দিয়ে শোক-দিবসের চাঁদাবাজিতে ব্যস্ত থাকায় বেচারা হাতিটা মারা গেলো। আমরা ক্ষমতায় গেলে ভারতকে একটির পরিবর্তে তিনটি হাতি উপহার দেবো।

সানন্দবাজারের ক্রন্দন প্রতিবেদনে লেখা হয়, গুলশন থেকে সরিষাবাড়ি; সর্ষের মধ্যে ভুত। আল বিদা হাতি মেরা সাথী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত