সোশ্যাল মিডিয়া ডেস্ক

২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০১:১৮

‘হে সব্যসাচী! জানি, আপনিও কান পেতে আছেন!’

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক-এর মৃত্যুতে সারাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের মধ্যে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। অন্য সকল জায়গার মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের ব্যবহারকারীরা শোকের বাক্যে স্মরণ করেছেন বিরলপ্রজ এ লেখককে।

১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী এ লেখক ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬-এ ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

কবিতা, নাটক, গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্রসহ সাহিত্যের সব শাখায় স্বচ্ছন্দ সৈয়দ হক দুহাতেই লিখে গেছেন। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় তাঁর ছিল নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা। বলা হয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর তিনিই একমাত্র সাহিত্যিক যিনি লিখে গেছেন কালজয়ী সব সাহিত্য। সেখানেই দিয়েছেন হাত, সেখানে ফলেছে সোনা।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সব্যসাচী সৈয়দ হককে নিয়ে জহিরুল মিঠু লিখেন-

আপনি আছেন তবুও বোধ করি মহাশূন্যতা !

আপনি যখন গালে হাত দিয়ে ছবি উঠতেন
আমার চোখে সুকান্ত ভাসতো, জানেন ;
ডেনিমে মোড়া আপনাকে নাটক পাড়ায় দেখে
ফিল্মের হিরোর চেয়েও বেশি আগ্রহে দেখতাম, মঞ্চে সেদিন ছিল খাট্টা- তামাশার প্রথম শো।

'কথা সামান্য' নামের অসামান্য একটা বই বুকে আগলে রাখি, পড়া শেষেও যেন শেষ হয় না। কী এত মধু ছিল সব্যসাচী আপনার হাতে। উন্মাদ করেছিল ব্যঙ্গ করে, দু'হাতেই লিখছেন এ রকম একটা ক্যারিক্যাচার। তখন আপনাকে চিনতাম টাক মাথার ' খেলারাম খেলে যা'র লেখক হিসেবে। 'মার্জিনে মন্তব্য'র মত অসাধারণ একটা বই আমাদের মত মানুষের জন্য পরম মমতায় রেখে গেছেন যেন এর জলে আমরা নিবারণ করবো মহাতৃষ্ণা!

বিচিত্রা হুমায়ুন আহমেদ আর আপনাকে একবার প্রচ্ছদে এনেছিল মনে আছে। কী সুখে সেই সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম আজো টলমল করেছে চোখে!

টিভিতে বাচন ভঙ্গি দেখলেই মনে হত আপনি কী অদ্ভুত মন্ত্রমুগ্ধের মত সম্মোহন করে ফেলতেন শ্রোতা তথা দর্শককে। আপনার একাডেমিক পড়ালেখা নিয়ে গল্পটা আমি ফেরি করি রোজ! আপনার নাটক-গান -কবিতা জানতে জানতেই সমৃদ্ধ হচ্ছিলাম কিন্তু জানেন এক সময় বইমেলায় আপনার অটোগ্রাফ নিতে ভয় পেতাম -- মনে হত আপনাকে আরো পড়ার পরই আপনার মুখোমুখি হই!

'জাগো বাহে কোনঠে সবাই ' বললেই লোম খাড়া হয়ে যায় আমাদের। যেন তিতুমীর, নুর হোসেন, বরকত সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে গেল ৭ মার্চের সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে। মনে হচ্ছে এখনি হয়তো মহাকবি বলবেন ----
'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম! '

দীর্ঘদিনের আয়ু আপনাকে আমাদের সাথে জোড়া দিতে যথেষ্ট ছিল কি! আমরা এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে, আলম খানের সুরে আপনার নতুন লেখাটা শোনার জন্য বাতাসে কান পেতে আছি, হে সব্যসাচী! জানি, আপনিও কান পেতে আছেন!

মাসকাওয়াথ আহসান লিখেন,

হয়তো বাংলা সাহিত্যের গালিভার যুগের প্রায় অবসান; হয়তো লিলিপুট যুগের শুরু।

অশেষ রায় লিখেন,

সাম্য ও মানবিক আগামী এক পৃথিবী গড়ার প্রত্যয়ে দশ দিক কাঁপিয়ে কোন একদিন একজন নূরুলদীনের আহ্বান ধ্বনিত হবে "জাগো বাহে, কুনঠে সবায়।"

সরদার ফারুক লিখেন,

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক আজ না-ফেরার দেশে চলে গেলেন। মনে পড়ছে, সম্ভবত ১৯৮৩ সালের দিকে তিনি 'অক্ষর সাহিত্য'র আমন্ত্রণে বরিশালে এসেছিলেন। বিবির পুকুরের পাড়ে জাহানারা হলে সবার কবিতা মন দিয়ে শুনলেন। আমি একটা দীর্ঘ কবিতা পাঠ করার পর তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন, " দীর্ঘ কবিতা লেখা খুবই কঠিন। ধরে রাখাটাই সমস্যা।"

মীম হুসাইন লিখেন, 

হক লেখকদের মৃত্যু

বাতিল লেখকদের জীবিত করে।
ওপারে ভালো থাকুন, বাজিকর কবি সৈয়দ হক।

এমএ আহাদ লিখেন,

ওপারে শান্তিতে থাকুন প্রিয় কবি।

তোমার কবিতা দিয়েই হয়েছিল আমার আবৃত্তির হাতেখড়ি।
#জাগো বাহে কুণ্ঠে সবায়....

রনজু রাইম লিখেন, 

সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক-এর কফিনে ফুল দিতে যাবে অনেক বনসাই লেখক; তারা জানে না যে সৈয়দ হক নন, তারা নিজেরাই মৃত।

হিমেল হাসান বৈরাগী লিখেন,

সৈয়দ হক আপনি কোথায়?
এই শুনুন আপনার 'পায়ের আওয়াজ শোনা যায়'।
'নদী বাঁকা জানি, চাঁদ বাঁকা জানি, তাহার চেয়ে আরও বাঁকা তোমার ছলনা'
আপনি বলেছিলেন, - 'না যেয়ো না'
অথচ, কে যাবে কে থাকবে সেটা তার 'নিজস্ব বিষয়'।
যদি কোনদিন দেখা হয়
ঠিকঠাক শিখে নেব 'অন্য এক আলিঙ্গন '।
ভালো থাকবেন 'নূরুলদীনের সারা জীবন'।

১৯৫৩ সালে ‘একদা এক রাজ্যে’ কাব্য দিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু হলেও ‘তাস’ নামক গ্রন্থ আগেই প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর অবিরাম লিখেছেন সৈয়দ হক। সাহিত্যের সব শাখায়। 

বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা, পরাণের গহীন ভেতর, নাভিমূলে ভস্মাধার, আমার শহর ঢাকা, বেজান শহরের জন্য কেরাম, বৃষ্টি ও জলের কবিতা- এসব কাব্যগ্রন্থের অজস্র কবিতায় তাঁর নানা নিরীক্ষা জনপ্রিয়তাও এনে দেয় তাঁকে।

কাব্যনাট্য রচনায় ঈর্ষণীয় সফলতা পাওয়া সৈয়দ হক ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘গণনায়ক’, ‘ঈর্ষা’ ইত্যাদি নাটকে রেখেছেন মুনশিয়ানার স্বাক্ষর। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ও ‘নুরলদীনের সারাজীবন’ বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে।

তিনি মহাকাব্যিক পটভূমিকায় বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ নামে দীর্ঘ উপন্যাস যেমন লিখেছেন, তেমনি ছোট আকারের উপন্যাস লিখেছেন সমান তালে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে তার ‘নিষিদ্ধ লোবান’সহ নানা উপন্যাসে।

‘খেলারাম খেলে যা’, ‘নীল দংশন’, ‘মৃগয়া’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘এক মহিলার ছবি’, ‘দেয়ালের দেশ’, ‘স্তব্ধতার অনুবাদ’, ‘এক যুবকের ছায়াপথ’, ‘মহাশূন্যে পরানমাস্টার’, ‘তুমি সেই তরবারী’, ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’, ‘অন্তর্গত’, ‘এক মুঠো জন্মভূমি’, ‘শঙ্খলাগা যুবতী ও চাঁদ’, ‘বাস্তবতার দাঁত ও করাত’, ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’, ‘আয়না বিবির পালা’সহ ৫০টির বেশি উপন্যাস এসেছে তার হাত দিয়ে।

ছোটগল্পে তিনি নিজের এলাকা উত্তরাঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষের জীবনের মর্মন্তুদ ছবি এঁকেছেন।

গত শতকের ষাট, সত্তর ও আশির দশকে অনেক চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের সঙ্গে চলচ্চিত্রের জন্য গানও লিখেছেন সৈয়দ হক। তাঁর লেখা গান ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘অনেক সাধের ময়না আমার’, ‘তোরা দেখ দেখ দেখরে চাহিয়া’, ‘চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা’র মতো বহু গান এখন মানুষের মুখে ফেরে।

তাঁর নিষিদ্ধ লোবান উপন্যাস নিয়ে কয়েক বছর আগে গেরিলা নামে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত