আরিফ জেবতিক

১৯ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:৩৭

সুন্দরবনের বাঘ নয়, বাংলাদেশে বিলুপ্তপ্রায় ‘প্রাণীটির’ নাম হিন্দু

মানে এই কাহিনীটা এতই জটিল, এতই অবিশ্বাস্য, অনেকটা ঐ সাহিত্যের ম্যাজিক রিয়েলিজম না কি যেন আছে, ওরকমই খানিকটা। বিশ্বাস হতে চায় না।

তবে আমার আপনার বিশ্বাসের খেতাপুরে, এটাই বাস্তবতা। সে আপনি মানেন কি না মানেন। বাগেরহাট জেলায় হিন্দু পরিবারের এক গৃহবধূকে ভয় দেখিয়ে ১৫ দিন ধরে ধর্ষণ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ধর্ষক ওই পরিবারের সবাইকে হত্যার হুমকি দিয়ে গৃহবন্দী করে রাখে। এমনকি তলোয়ারের কোপে ধর্ষিতার পা কেটে ফেলা হলেও তাকে হাসপাতালে নিতে দেওয়া হয়নি!

হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের বক্তব্য অনুযায়ী এমনকি গতবছরের তুলনায়ই এই বছর শুধু ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের সংখ্যা ৩ গুন।

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে বিলুপ্তির পর্যায়ে যে প্রাণিটি আছে সেটি আসলে সুন্দরবনের বাঘ কিংবা মেঘনা নদীর শুশুক নয়, এই প্রাণীটির নাম হিন্দু। এরা দিব্যি দেখতে মানুষের মতো, মানুষের মতোই হাসে-কাঁদে-ভাত খায় এবং আমাদের সকলের লাথি খায়। আমাদের ছোটবেলা আশেপাশে এই প্রাণিটি অনেক দেখতাম, এদের সঙ্গে যে আমাদের তফাৎ আছে এরকম না ভেবেই একসঙ্গে হেসে খেলে আমরা বড় হয়ে উঠেছি। তারপর আমাদের অগোচরেই তাঁরা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে শুরু করেছে। এই দেশ অসাম্প্রদায়িকতা থেকে যত দূরে সরতে শুরু করেছে, যতই এখানে সৌদি পেট্রোডলারে হিংস্র রাজনীতি প্রমোট শুরু হয়েছে ততোই এরা বিলুপ্ত হতে শুরু করেছে।

এবং মজার ব্যাপার হলো আগে এগুলো নিয়ে হাল্লাগোল্লা হলেও এখন আর এগুলো গা সওয়া হয়ে গেছে। ২০০১ সালের পূর্ণিমা রানীর উপর নির্যাতনের যে ভয়াবহতার কথা ডকুমেন্টেড আছে, সেই পরিমাণ আগ্রহ নিয়ে এখন আর এগুলোর প্রচার হয় না, ডকুমেন্টারি হয় না-কারণ আমরা মেনে নিচ্ছি যে আমরা একটা একমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে এগুচ্ছি যেখানে ভিন্নমত রাখব না, ভিন্ন চিন্তা রাখব না এবং ভিন্ন ধর্মও রাখব না। সম্পূর্ণ অকারণে, শুধু ধর্মের কারণে পুরোহিত-পাদ্রীদের কুপিয়ে হত্যা করা হবে বাংলাদেশে-এটা কয়েকবছর আগেও চিন্তা করা যেত না- এখন এটা আমরা মেনে নিয়েছি।

আমরা এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগুচ্ছি। আমাদের মাল্টি কালচার, মাল্টি ধর্মের দেশ ও জাতিসত্তা লুট হয়ে যাচ্ছে।

এসব নিয়ে বড় আকারে কথাবার্তা বলা শুরু করুন। রাষ্ট্র আর তার রাজনৈতিক লালিত গুণ্ডাদের হাতে ছেড়ে দিলে শত্রু সম্পত্তি/ অর্পিত সম্পত্তির মারপ্যাঁচে বাস্তুহারা হিন্দু কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে ভিনদেশে যেতে গেলে বিএসএফের গুলির মুখে পড়বে মাত্র।
এ বিষয়ে ধর্মীয় সংখ্যাগুরু হিসেবে আমাদেরকে কথা বলতে হবে। এই দায়িত্ব সেই 'হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ' এর হাতে ছেড়ে দিলে হবে না। একটা সার্বজনীন ঐক্য পরিষদ থাকলে তা-ও হতো। 'মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান' পরিষদ হতে পারত। ('মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-নাস্তিক' ঐক্য পরিষদ হলে ভালো হতো, কিন্তু সেটা করে বাকিরা কোপ গর্দানে নিতে চাইবে না।)

আর আসলে এসব ধর্ম-অধর্ম ঐক্য পরিষদের তকমায় সীমাবদ্ধ থাকাটা কোনো কাজের কথা নয়।

চাই সার্বজনীন বাংলাদেশী ঐক্য। সার্বজনীন ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তার বিকাশ ঘটিয়েই এই দানবদের রুখে দাঁড়াতে হবে, নইলে এই আক্রান্ত হওয়া থেকে কারোই নিস্তার হবে না।

  • আরিফ জেবতিক : লেখক, সাংবাদিক।

(লেখাটি ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

আপনার মন্তব্য

আলোচিত