মাসকাওয়াথ আহসান

১৭ নভেম্বর, ২০১৬ ১৭:৩১

সাঁওতালের ওপর একদা সাঁওতাল শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন

পুরো দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে ছোট ছোট আদিবাসী গোষ্ঠীর বসবাস। এই আদিবাসীরা যখন তাদের গোত্র-গ্রামে বসবাস করতো তখন তারা সহজ-সরল জীবন যাপন করতো। আজো দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশেই কৃষিজীবী সমাজগুলো তেমনি সরল সবুজ জীবন যাপন করে। মহাসড়ক থেকে নেমে যে কোন জনপদের গহীনে প্রবেশ করলেই দেখা যায় ভারতবর্ষের ঐতিহ্যসঞ্জাত সরল মানুষের বসবাস।

উপজেলা বা মহকুমা পর্যায় থেকে শুরু হয়েছে বিকৃত এক মনোজগৎ। একই আদিবাসী যখন সামান্য নগরায়নের সংস্পর্শে আসছে; তখন সে ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে। গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালদের গ্রাম পুড়িয়ে, মানুষ হত্যা করে অনুতাপহীন সুগারমিল ম্যানেজার, ইউপি চেয়ারম্যান, স্থানীয় সাংসদ, শিল্পসচিব, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা মানবতাবিরোধী অপরাধ অস্বীকার করে চলেছেন; তারা সবাই কিন্তু সাঁওতাল গোত্রেরই লোক।

বংশগতির কোন একটি জায়গায় দখলদার কিছু দূরদেশীয় আদিবাসী কোন গোত্রের মানুষের সঙ্গে সংকরায়ন হয়তো ঘটেছে। তাই এরা মৌলিক চেহারা হারিয়ে একটু ভিন্নতর দেখায়। অনেকের চেহারা একই আছে কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে অর্জন করেছে মানবতাবিরোধী নতুন অপরাধী মনোজগৎ।

বহিঃশত্রু দখলদাররা নতুন জনপদে এসে যখন লুণ্ঠন, মানুষ হত্যা, নারী ধর্ষণ, বাড়ী-ঘর পুড়িয়ে দেয়া, উচ্ছেদ, ভূমি-দখলের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে; তখন নৈকট্য বা সমানুভূতি না থাকাতেই বর্বর হতে পেরেছে। কিন্তু নিজেরই ভূ-খণ্ডে নিজের শেকড়ের, আত্মপরিচয়ের মানুষের ওপর এতোটা নিষ্ঠুর হতে পারলো সাঁওতাল গ্রামে হানাদাররা!

আদিবাসী গ্রামগুলোতে আজো যে মানবিক সমাজ রয়েছে; আমাদের প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সক্রিয়তা তা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে সামান্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রাপ্ত মানুষ বা নগরায়নের সংস্পর্শ পাওয়া মানুষই দানবিক হয়ে উঠেছে।
সাঁওতাল গ্রামের মানুষেরা আক্রান্ত হয়েছেন, খোলা আকাশের নীচে অনিশ্চয়তার ক্ষুধার্ত রাত কাটাচ্ছেন। তাদের আত্মমর্যাদার বোধ এতোই ঋজু যে, তারা তাদের জন্য বরাদ্দ সরকারী ত্রাণ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। পরে অনেক অনুরোধ করে তাদের অনশন ভঙ্গ করা গেছে। এই আত্মমর্যাদার সংস্কৃতি কথিত শিক্ষিত নগরায়িত সমাজে বিরল। প্রতিদিন যে ক্ষমতাকাঠামো মানবতা বিরোধী অপরাধ করছে; তাদের দেয়া ন্যুনতম একটি সেলফি ত্রাণের জন্য উন্মুখ শহুরে মানুষ।

সভ্য সমাজগুলো তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে তাদের মাটির সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে বিনির্মাণ করায় সেখানে ঐতিহ্য ও বিশ্বদৃষ্টির মেলবন্ধনে অপেক্ষাকৃত মৌলিকত্ব বজায় রেখে আলোকিত সমাজ রচনায় সক্ষম হয়েছে তারা। সততা, মানবতা, নিসর্গপ্রিয়তা সেসব শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে অনায়াসে ঢুকে পড়ে শিশুমনে।

অথচ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বহুধা-বিভক্ত। কোথাও কোন সে আরব-মুল্লুকের অপভ্রংশ শিক্ষা দেয়া হয়, কোথাও দেয়া হয় কোন সে বৃটেন-এমেরিকার অপভ্রংশ শিক্ষা, কোথাও বা শেখানো হয় কী করে টেকাটুকা বানানো যাবে, স্যার হওয়া যাবে, খুব গুছিয়ে মিথ্যা বলা যাবে, কীভাবে মানুষ ঠকানো যাবে। এরকম বিকৃত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে মিথ্যাবাদী মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা, আমলা-পুলিশ, ম্যানেজার, মানবতাবিরোধী অপরাধের সহযোগী ক্যাডার তৈরি হবে এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই।

এখানে বোধহীন দর্শক সমাজ ও প্রতারক বুদ্ধিজীবীরা শাসকগোষ্ঠীকে খুশী করে রাখতে সাঁওতাল পল্লীতে মানবতা বিরোধী অপরাধ দেখে চোখে ঠুলি পরে থাকতে চাইবে; সেটাই স্বাভাবিক।
[ফেসবুক থেকে]

  • মাসকাওয়াথ আহসান : কথাসাহিত্যিক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত