সিলেটটুডে টুয়েন্টিফোর ডেস্ক

০৭ মার্চ, ২০১৭ ১৭:০২

কালিকাদা’র জন্য শোকগাঁথা

কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য। দুই বাংলার প্রিয় কালিকা দা’। অকালেই সড়ক দুর্ঘটনায় চিরবিদায় নেওয়া প্রিয় এ মানুষের মৃত্যুর সংবাদটি মেনে নিতে পারছেন না দুই বাংলারই সংগীতপ্রেমীরা।

কালিকাপ্রসাদের আদি বাড়ি সিলেটের ঢাকা দক্ষিণ। আসামের শিলচরে বড় হওয়া কালিকাপ্রসাদের আজন্মের টান ছিল সিলেটের সাথে। আর তাই সিলেটেও রয়েছেন তাঁর অজস্র গুণগ্রাহী প্রিয়জন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেই প্রথম ছড়িয়ে পড়ে কালিকাপ্রসাদের মৃত্যুসংবাদ। আর তাঁর শোকসংবাদের সাথে মিশে রয়েছে তাঁকে নিয়ে সিলেটের মানুষের স্মৃতিগাঁথা।

সিলেটের সংস্কৃতিকর্মী হুমায়ুন কবির জুয়েল তাঁর ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাসে লিখেছেন,

“দিন তারিখ মনে নেই, রাখার প্রয়োজনও বোধ করিনি কখনো। সম্পর্কটা ছিলো বহতা নদীর মতো বহমান। সম্ভবত '৯০ দশকের শেষের দিকে পরিচয় দোহার এবং কালিকা'দার সাথে। সূত্র শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার, আমাদের শুভ'দা। এ মানুষগুলোর কারণে শিলচর গেলে মনে হতো না ভিন দেশে গেছি-এরা আমাদের কেউ নয়। দেশ ভাগের অশ্রুকণায় প্রথম ভিজলো নয়ন এঁদের আলিঙ্গনে!

তখন দোহারের অডিও ক্যাসেট বের হয়, আমরা নিয়ে আসি নিজেরা মোহিত হই অন্যদের শোনাই। কালিকা'দা সিলেট আসে। জমিয়ে আড্ডা হয়, নাড়ির টানে গানের পাণে ছুটতে থাকে-আমরা তার সঙ্গী। বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম সহ অনেকের বাড়িতে, আখড়ায় গেছে দাদা। সঙ্গীত ছিলো তাঁর কাছে সাধনা। কালিকা-শুভ'র অমর সৃষ্ট 'এপার বাংলা অপার বাংলা মধ্যে জলাধিনদী/ নির্বাসিত নদীর বুকে বাংলায় গান বাঁধি' আজো আপ্লুত করে প্রতিক্ষণে!”

বেসিস্ট-ভোকালিস্ট দীপ রায় তার একটি স্ট্যাটাসে লিখেন,

“গাড়ি চলেনা গাইতে থাকা মানুষটাকে থামিয়ে দিল রোড এক্সিডেন্ট। বাংলা লোক গানের দল দোহার এর ভোকাল কালিকা প্রসাদ যাঁর ধ্যান জ্ঞান ছিলো মাটির গান। গান সব শিল্পি শোনান, তাঁর থেকে শোনা যেতো গানের ইতিকথা, ইতিহাস, গল্প।অভাবনীয় ক্ষতি হয়ে গেলো বাংলার লোক গানের, জীবন্ত আর্কাইভ ছিলেন তিনি বাংলা লোক গানের। কোনোদিন আর স্টেজে দেখা যাবেনা,শোনা হবেনা নতুন গান-গল্প। গানের মানুষ সুরেই বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে।“

সংস্কৃতিকর্মী দেবজ্যোতি দেবু ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেন,

“একজন কালিকা প্রসাদ ভট্টাচার্য থেকে প্রাণের কালিকা দা হয়ে ওঠা মানুষটা আর আমাদের মাঝে নেই! জীবনের এ কেমন রসিকতা! এ কেমন নিষ্ঠুরতা! গত বছরই তো মানুষটা আমার শহরে এসে শাহ আব্দুল করিমকে নিয়ে বন্দনা গাইলেন। এইতো কিছুদিন আগেও ভুবন মাঝি সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনা করলেন। আবারও বাংলাদেশে এসে আরো অনেক অনেক গান শোনানোর কথা দিয়ে গিয়েছিলেন। তাহলে কেন চিরতরে চলে গেলেন?

আমি সব সময় গর্ব করে, অধিকার খাটিয়ে বলি, 'আমাদের কালি দা'। কারণ তিনি যে আমাদেরই একজন ছিলেন মনে-প্রাণে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তিনি নিজের ইতিহাস বলে মনে করতেন।…

একজন স্রষ্টার অপমৃত্যু হলো আজ। এক অসীম সম্ভাবনার দুয়ার বন্ধ হয়ে গেল আজ। একজন মানুষের বিদায় হয়ে গেল আজ। আমাদের প্রাণের মানুষটা খাঁচা ভেঙ্গে উড়াল দিলো।

ভালোবাসি কালি দা। ভাল থেকো দাদা। তোমাকে বিদায় দেবো না। স্রষ্টার বিদায় হয় না। তুমি বেঁচে থাকবে তোমার সৃষ্টিতে, আমাদের প্রাণে, আমাদের বন্দনায়।…”

খুব ছোট কথায় নিজের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন সংস্কৃতিকর্মী সুপ্রিয় দেব শান্ত। তিনি লিখেছেন,

“প্রিয় কালিকা'দা নেই, ভাবতে পারছি না।“

প্রজেক্ট লন্ডন ১৯৭১ এর সমন্বয়ক উজ্জ্বল দাস স্মৃতিচারণ করে লিখেন,

“২০০৮ সালে কালিকা’দার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল রাজীব দে মান্না ! হুট করে এক ভোররাতে লন্ডনে মান্না'দাকে হারালাম। সেদিন কলকাতা থেকে ফোন করে সেকি কান্না! আজকে কালিকা আর মান্নাদা মনে হয় জম্পেশ আড্ডায় বসবে!! প্রিয় মানুষগুলোর এই তাড়াহুড়ো ভাল লাগেনা!! বড্ড খালি লাগছে! বিশাল ক্ষতি!!! ওপারে শান্তিতে থাকুন দাদা!”

নিজের আরেকটি স্ট্যাটাসে কালিকাপ্রসাদের নাড়ির ইতিহাস লিখেন হুমায়ুন কবির জুয়েল। তিনি লিখেন,

“দাদা ছিলেন নামকরা কবিরাজ। আদিবাড়ি সিলেট জেলার ঢাকা দক্ষিণে।

একবার শিলচরের এক বিখ্যাতজন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে ডাক পড়ে কবিরাজ মহাশয়ের। অসুস্থ রোগি সুস্থ হলে অত্র অঞ্চলের মানুষ তাঁকে আর আসতে দেয়নি।

তারপর দেশ ভাগ! ফেরা হয়নি নিজ ভূমে আর কখনোই.....শিলচরে থিতু হওয়া এ পরিবারের সাংস্কৃতিক পরম্পরা তিনি বহন করেছেন জীবনের প্রতিটি বাঁকে।

বিখ্যাত কবিরাজ দাদার অন্য দুই সন্তান অর্থাৎ কালিকা প্রসাদের কাকা অন্তু ভট্টাচার্য এবং মুকুন্দ ভট্টাচার্য যথাক্রমে বরাক উপত্যকার প্রবাদপ্রতিম লোকসংগীত শিল্পী ও নৃত্যগুরু। আর প্রসাদ নিজে ছিলেন শিল্পসাধক।

দাদা বরাক পাড়ের একটুকরো সিলেট অর্থাৎ শিলচর ছেড়ে পাড়ি জমালেন কলকাতায়।

দোহার এবং কালিকাপ্রসাদ ছড়িয়ে পড়লো বিশ্বময় আর আজ দাদা চলে গেলেন অন্যকোন গ্রহে!”

কালিকাপ্রসাদের প্রয়াণকে এককথায় ব্যক্ত করেছেন লেখক-গবেষক সুমনকুমার দাস। তিনি লিখেছেন,

“কালিকা দা', তুমি আছো, থাকবে।“

আপনার মন্তব্য

আলোচিত