আরিফ জেবতিক

২৯ মে, ২০১৬ ১৭:৩৪

শাহ আলম, আমাদের চিত্রকর ভাই

শাহ আলমের সঙ্গে কখন কীভাবে পরিচয়, আজকে অনেক চেষ্টা করেও স্মরণ করতে পারলাম না। আমি চোখ বুজে অনেকবার চেষ্টা করলাম শাহ আলমের সঙ্গে স্মৃতি স্মরণ করতে, বারবার চোখে ভাসে একটা মাত্র ছবি- গহীন অন্ধকার রাত, চৈত্রের শেষ রাত, ভোর হলেই পহেলা বৈশাখ, অজানা আশংকায় এমসি কলেজের আশেপাশে আমরা নিদ্রাহীন জেগে আছি, আর গোটা ক্যাম্পাসে একমনে ছবি এঁকে যাচ্ছে শাহ আলম।

আজকের বাস্তবতায় আজ থেকে ২৫ বছরের আগের অবস্থা বুঝা খুব কষ্টের। সেই সময় গোটা সিলেটেই একটি সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব বিরাজ করছে, আমরা কয়েকজন সাহস করে এমসি কলেজে পহেলা বৈশাখ আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছি। প্রতিনিয়ত বাঁধা-বিপত্তি, হুমকির মুখের একটু একটু করে কাজ এগুচ্ছে। ছোট শহর, গাতক পাওয়া যায়, আবৃত্তিকার পাওয়া যায়, কিন্তু চিত্রকর বলতে গেলে নেই। সেই সময় শাহ আলম একাই একের পর এক আল্পনায় রাঙিয়ে যাচ্ছে এমসি কলেজের দেড়শ একরের বিশাল ক্যাম্পাস-আমাদের বন্ধুরা গুটিকয় তাঁর এঁকে দেয়া আল্পনাগুলো দ্রুত রঙ দিয়ে ভরাট করছে, আমরা কয়েকজন পেছনে পাহারায়-এই দৃশ্য মনে পড়ে শুধু। এমসি কলেজের পিচঢাকা কালো পথে সাদা-লাল-হলুদের বড় বড় আল্পনাগুলো অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করে উঠছে, আর শাহ আলম তাঁর ঝাকড়া চুলগুলোকে সরিয়ে দিয়ে কব্জি দিয়ে ঘাম মুছছে- আজ এত এত বছর পরে স্মৃতি মনে পড়লে শুধু এটাই মনে পড়ে আমার।

একসঙ্গে সংগ্রামের স্মৃতি যেমন আছে, ব্যক্তিগত সুখের স্মৃতিও আছে। হুট করে বিয়ে ঠিক হয়ে গেল আমার, বিয়ের ব্যাপারে প্রত্যেক মানুষেরই কিছু না কিছু পরিকল্পনা থাকে, আমার বেলা সব শিকেয় উঠল। অনেকটা উঠ ছোড়া তোর বিয়ের মতো সপ্তাহান্তে বিয়ে। বিয়ে ঠিক হওয়ার পরের দিন দুপুরে আমি লিয়াকত সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ঘামছি আর কী কী করব ভাবছি, এই সময় সামনে দিয়ে রিক্সা করে শাহ আলম যাচ্ছে। আমি বললাম, 'রিক্সা থেকে নামো, কাজ আছে।' সে রিক্সা থামালো, আমি বললাম ফয়সলের দোকানে যাও, আমার বিয়ের কার্ড ডিজাইন করে দাও।

শাহ আলম, 'আরে খাইছে' বলে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে রিক্সা ছেড়ে সোজা ঢুকে পড়ল কাজে। তাঁর আরেকটা জরুরি কাজ ছিল, সেখানে ফোন দিয়ে বলল, আসতে পারব না। তারপর কাজে লেগে পড়ল। বিকেল নাগাদ ঝকঝকে বিয়ের কার্ড ছেপে বের করল অপু।-এসব ব্যক্তিগত স্মৃতি মনে পড়ে যায়।

শাহ আলম নিভৃতচারী ছিল, আমি কখনোই তাঁকে উচ্চকণ্ঠ হতে দেখিনি, নিজের কাজে বুঁদ হয়ে থাকত, কাজ শেষ করে নীরবে পেছন থেকে সরে পড়েছে সবসময়, অনুষ্ঠান সবাই দেখে, অনুষ্ঠানের রঙগুলোর কার তুলিতে আঁকা-সেকথা জানে কয়জন?

বড্ড অসময়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শাহ আলম চলে গেছে। তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে মনে পড়ে যায় আমাদের আরেক বন্ধু রাজিব দে মান্নার কথা, আমাদের সেই তুমুল কৈশোরের স্বজন, সেই রাত জাগা আল্পনা আঁকা রাতগুলোর সাহসী নেতা। মনে পড়ে যায় হৃদরোগে মরে যাওয়া বেনজিরের কথাও, আমাদের দঙ্গলের আরেক বন্ধু।
আমার নিজের হৃদপিণ্ডেও রক্ত জমেছে, একটা হার্ট এটাক হয়ে গেল গতবছর, চিকন সুতোর উপর নিজেকে ঝুলিয়ে মুঠো মুঠো অষুধ গিলে টিকে থাকার চেষ্টায় আছি-অবশ্যম্ভাবী পরবর্তী হামলার জন্য শুধুই ক্ষণ গননা।

একদিন আমাদের সকলের হৃদপিণ্ডই থেমে যাবে, মফস্বল শহরে বেড়ে উঠা স্বপ্নবাজ তরুণরা কেউ কেউ তারুণ্যেই আর বাকিরা হয়তো বুড়ো হতে হতে মুছে যাবে মহাকালের পাতা থেকে।

তারপর কি একদিন কোথাও আবার আমাদের দেখা হয়ে যাবে?

কোথাও কি আমরা একসঙ্গে হেসে উঠে বলব, 'আমাদের হার্টটা অনেক বড় ছিল। বড় বড় শহরগুলোর মতো বড় বড় হার্টগুলোতেই তাই ট্রাফিক জ্যাম হয়েছিল।'
হৃদয়ের গভীরে আমি হয়তো সেরকম দিনগুলোর জন্যই অপেক্ষা করি।
ভালো থেকো শাহআলম।

আমাদের স্মৃতিতে তুমি তোমার ছবিগুলোর মতোই জ্বলজ্বল করে আছো। সেই ছবি কেউ কোনদিনই মুছে ফেলতে পারবে না...।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত