রেজা ঘটক

১৫ জুন, ২০১৬ ০২:৪৩

স্বপ্ন বুনে উড়তে চায় ‘মাটির পাখি’

নগরের নিম্নবিত্ত মানুষের (বস্তি'র) আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার ক্ষয়িষ্ণু জীবনবোধকে প্রেক্ষিত করে 'মাটির পাখি' নামে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা মামুন শ্রাবণ। ক্রমবর্ধমান নগরায়নের আড়ালে শহরের বস্তির নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে দুঃখ আর অশান্তি যেন নিত্যসঙ্গী। বস্তি জীবনের সেই চরম কঠিন বাস্তবতার অবাধ শিকার এসব নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুরাও। অভাব, অশান্তি, অশিক্ষা, অপুষ্টি, ঝগড়া-কলহ, বহুবিবাহ, পরকীয়া আর নোংরা পরিবেশ মিলেই যেন শহরের বস্তিজীবন। 'মাটির পাখি' স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের ফ্রেম টু ফ্রেম নগর বস্তির চিরায়ত সেই কঠিন বাস্তবতার ভেতরেও এক কিশোরের মনোজগতে বিচিত্র সব নান্দনিক স্বপ্ন খেলা করে।

'মাটির পাখি' স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের গল্পটি এরকম- জন্মের সময় মা হারানো এক কিশোর রাজা। রাজার বাবা শহরের পরিচ্ছন্ন কর্মী। রাজার মা মারা যাবার পর বাবা আবার বিয়ে করেন। কিন্তু সেই সংসারে ভারী অশান্তি। অশান্তির প্রধান কারণ অভাব। অনুষঙ্গ অন্যান্য কারণের মধ্যে রাজার বাবা'র দাম্পত্য জীবনের অক্ষমতা, যার বিপরীতে রাজার সৎ মায়ের পরকীয়া প্রেম। এই নিয়ে চরম অশান্তির সংসারে সদ্য কৈশোরে উত্তীর্ণ রাজা প্রায়ই নানা অছিলায় সৎ মায়ের নির্যাতনের শিকার। বাবার অতি আদরের পুত্র রাজা প্রায়ই বাবার কাজে সহযোগিতা করে। পাশাপাশি বাবার সঙ্গে সে নগরের নানান অচেনা জায়গায় ঘুরতে গিয়ে হরেকরকম মাটি সংগ্রহ করে। এই মাটি দিয়ে অবসর সময়ে সে তার স্বপ্নের পাখি বানায়। রাজা বিশ্বাস করে এই মাটির পাখি তার মনের সকল কথা জানে। এছাড়া সময় পেলেই বস্তির সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে সে খেলা করে।

প্রতিবেশী মধ্যবিত্ত পরিবারের এক অটিস্টিক কিশোরী স্কুলে যাবার পথে প্রায়ই রাজাদের খেলা দেখে। সমবয়সী শিশুদের খেলা দেখে দেখে ওই কিশোরী ঘরে বসে একা একা ছবি আঁকে। কখনো বারান্দা থেকে রাজাকে দেখে আপন মনে খুশি হয়। একদিন রাজাকে সে নিজের আঁকা কিছু ছবি উপহার দেয়। জবাবে রাজা তাকে নিজের হাতে বানানো মাটির পাখি উপহার দেয়। এভাবে ধীরে ধীরে রাজার সঙ্গে কিশোরীর বন্ধুত্ব হয়। ওদিকে রাজাদের বস্তি'র আগে যিনি মালিক ছিলেন, সেই আলেক চাচা এখন প্যারালাইজড। সারাদিন বস্তির এক সিঁড়িতে বসে বসে সে রাজার সৎ মায়ের নানান কীর্তিকলাপসহ গোটা বস্তির নানান অসঙ্গতি দেখার এক নির্বাক দর্শক। একদিন খুব ভোরে রাজা আর তার বান্ধবী কাউকে না জানিয়ে গোপনে শহরের বাইরে ঘুরতে যায়। সেখানে তারা খুঁজে পায় এক বিশাল পাইপ। সেই পাইপের মুখে তারা যে শব্দ করে, পরক্ষণেই তা প্রতিধ্বনি হয়ে গোটা শহরময় ছড়িয়ে যায়। কিন্তু ফেরার পথে তারা আলেক চাচাকে একেবারে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে যেতে দেখে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ে। বস্তির কঠিন জীবনের সকল কর্মকাণ্ডের নীরব সাক্ষী যেমন নিশ্চল নির্বাক আলেক চাচা, তেমনি দুটি শিশু সবার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেও সেই আলেক চাচা তাদের দেখে ফেলে। এই কাকতালীয় ঘটনার পর আলেক চাচাকে আর কোথাও দেখা যায় না। এখানেই ২৫ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি 'মাটির পাখি' শেষ হয়।

আসলে আলেকের মত নির্বাক প্যারালাইজড মানুষেরা এই সমাজের সকল নষ্টামি স্পষ্ট দেখতে পায়। সমাজের ভেতরের সমস্ত ক্ষরণ, অন্যায়, অবিচার, অনিরাময় যোগ্য ব্যাধি, পাপ, সবকিছু…। কেবল মানুষের চেহারা পাওয়া অন্য সবাইকে সেই বোধ কখনও যেন স্পর্শ করে না। হয়তো আলেক সত্যি সত্যিই একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ ছিলেন! নইলে কোন আধ্যাত্মিক শক্তিবলে তিনি দিব্যি শহরের বাইরে হেঁটে গেলেন! যাকে পরে আর কোথাও কোনোদিন দেখা যায় না। একটি নির্বাক চরিত্রের চোখেই শহরের বস্তি জীবনের সকল কঠিন বাস্তবতাকে যেন তরুণ নির্মাতা মামুন শ্রাবণ 'মাটির পাখি' ছবিতে দেখাতে চেয়েছেন। পাশাপাশি শিশুদের সহজ-সরল অনুভূতি, ভালোলাগা, আবেগ, বন্ধুত্ব, স্বপ্নকে যথাযথভাবে দেখানোর প্রচেষ্টা রয়েছে ছবিতে।

শিশু নির্যাতন একটি সামাজিক অপরাধ। সামাজিক শ্রেণীবোধ ও পারিবারিক কঠোর শাসন শিশুর প্রতিভা বিকাশের পথে বড় অন্তরায়। যা শিশুকে মানসিকভাবে বেড়ে উঠতে নানাভাবে বাধা প্রদান করে। আজকের শিশুরাই যে আগামীর ভবিষ্যৎ। আজকের শিশুরাই তো একদিন এ দেশের নেতৃত্ব দেবে। এ জন্য তাদের প্রয়োজন সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা। সঠিক সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা না পেলে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পথে অন্তরায়সমূহের এক বাস্তব অথচ হৃদয়গ্রাহী দৃশ্যই যেন 'মাটির পাখি' ছবিতে রাজা ও তার কিশোরী বান্ধবীর কণ্ঠে বিশাল পাইপে বারবার প্রতিধ্বনিত হয়। এই প্রতিধ্বনি যেন বারবার বলছে ফিরিয়ে দাও আমাদের শিশু অধিকার!  

'মাটির পাখি' ছবিতে রাজা ও কিশোরী চরিত্রে অভিনয় করেছেন শিশুশিল্পী নবীন ও স্বপ্ন। এছাড়া অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইকতারুল ইসলাম (রাজার বাবা), নুরুন্নাহার বেবী (রাজার মা), কাজী ফয়সল (কিশোরীর বাবা), রওনক রিপন, শফিকুল ইসলাম এবং এনামুল হক রানা (আলেক চাচা)। এছাড়া ধলপুর বস্তির কয়েকজন ছবিতে ডকু ক্যারেক্টার হিসাবে অভিনয় করেন। 'মাটির পাখি' স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি'র দৈর্ঘ্য ২৫ মিনিট, এইচডি ফরমেটে নির্মিত, নির্মাণকাল এপ্রিল-জুন ২০১৬। ছবিটি নির্মিত হয়েছে আইউইঙ্ক ব্যানারে।

'মাটির পাখি' ছবি বানানোর প্রেক্ষাপট বলতে গিয়ে তরুণ নির্মাতা মামুন শ্রাবণ বলেন, দুই বছর ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করে ২০১৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর ভারতের চেন্নাই শহরের ভেল্যর ক্রিশ্চিয়ান মিশনারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমার সাত বছর বয়সী ভাগ্নে সায়ান অকালে মারা যায়। পাঁচ বছর বয়সে সায়ানের ইভিং সারকোমা ক্যান্সার ধরা পড়ে। তারপর টানা দুই বছর ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল ও ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে সায়ানের চিকিৎসা চলে। শেষ পর্যন্ত আমরা সায়ানকে বাঁচাতে পারিনি। আমাদের সায়ানের অব্যক্ত স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতেই 'মাটির পাখি' বানানো। অকাল প্রয়াত সায়ান যেমন নির্বাক, 'মাটির পাখি'ও এখানে নির্বাক। কিন্তু মহাকালের সঙ্গে সায়ানসহ আমাদের সবার যেন একটা অদৃশ্য সংযোগ আছে। 'মাটির পাখি'র ভেতরে আমি হারানো সায়ানকে বারবার খুঁজতে চেষ্টা করেছি। যে কারণে আমি আমার প্রথম ছবি 'মাটির পাখি' অকাল প্রয়াত ইসমাইল হোসেন সায়ানকে ডেডিকেট করেছি।

'মাটির পাখি' স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও নির্দেশনা দিয়েছেন স্ট্যামফোর্ট ইউনিভার্সিটি থেকে ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়ায় গ্রাজুয়েশন করা তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা মামুন শ্রাবণ। এটি মামুনের প্রথম ছবি। 'মাটির পাখি'তে সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন বাপ্পী, সম্পাদনা করেছেন বায়েজীদ প্রিন্স ও শওকত আলী রানা, ইংরেজি সাব-টাইটেল করেছেন রেজা ঘটক, শিল্প নির্দেশনায় ছিলেন ইকতারুল ইসলাম, স্টিল ক্যামেরায় ছিলেন সাজ্জাদ ও বিপ্লব, টাইটেল ও সংগীত নির্দেশনায় ছিলেন শওকত আলী রানা, গানের কথা ও সুর করেছেন শাজাহান সম্রাট, গানে কণ্ঠ দিয়েছেন রওনক রিপন ও রাফা।

পরিচালকের চিফ এসিসট্যান্ট ছিলেন আল-আমিন, এসিসট্যান্ট ছিলেন মেহেদী, কস্টিউম করেছেন আমেনা ও শাহেলা ইসলাম তমা, প্রপস আরশাত শাতিল, মেকআপম্যান ছিলেন তরিকুল, ক্যামেরা এসিসট্যান্ট ছিলেন আলী হাসান, আবহসঙ্গীত করেছেন মিরাজ ও হাফিজ, সাউন্ডটেকার ছিলেন সুমন, লাইট করেছেন হৃদয়, টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিয়েছে একতারা মাল্টিমিডিয়া, ক্রিয়েটিভ সাউন্ড, আইউইঙ্ক ও এক্স-ফ্যাক্টর, খাবার সরবরাহ করেছে বিএফডিসি, গাড়ি সরবরাহ করেছে আক্কাস রেন্ট-এ কার, প্রোডাকশন ম্যানেজার ছিলেন নাদিম, প্রোডাকশন বয় ছিলেন আরিফ ও সানি। 'মাটির পাখি' স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করেছে প্রমোটার ও সিনপেইন্টার।

পরিচালক মামুন শ্রাবণ জানিয়েছেন, শীঘ্রই ঢাকায় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'মাটির পাখি'র আনুষ্ঠানিক প্রিমিয়ার শো হবে। পাশাপাশি 'মাটির পাখি' দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করবে। 'মাটির পাখি' নির্মাণ করার জন্য তরুণ নির্মাতা মামুন শ্রাবণকে আমার শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আশা করি চলচ্চিত্র নির্মাণের কঠিন যুদ্ধে মামুন প্রথম ছবি'র অভিজ্ঞতার আলোকে ভুল-ত্রুটি কাটিয়ে ভবিষ্যতে ফুললেন্থ ছবি বানাতে উৎসাহী হবেন। চলচ্চিত্রাঙ্গনের রঙিন ভুবনে মামুনকে সুস্বাগতম।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত