১৪ নভেম্বর, ২০১৬ ২২:৪১
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম ঘোড়ামারা। সে গ্রামেই বাঁশের বেড়া দেয়া টিনের ছাউনি ও মাটির মঞ্চের পরিপাটি ‘নটমণ্ডপ’। এ মন্ডপেই নিজেদের শ্রেষ্ঠ অভিনয় যেন সমর্পণ করছেন দেশবরেণ্য মঞ্চাভিনেতারা। কমলগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামটি হয়ে ওঠে একটি পূর্ণাঙ্গ নাট্যাঞ্চল, যেখানে অভিভূত হতেই আগমণ ঘটছে নাট্যপ্রেমীদের। নটমণ্ডপটি মণিপুরী থিয়েটারের স্টুডিও থিয়েটার হল এবং গ্রামীণ পরিবেশে নির্মিত একমাত্র থিয়েটার হল।
প্রতিষ্ঠার দুই দশক পার করে মাসব্যাপী একটি নাট্যমেলার আয়োজন করেছে বাংলাদেশের খ্যাতনামা নাট্য সংগঠন ‘মণিপুরী থিয়েটার’। থিয়েটার অঙ্গণে দীর্ঘদিন ধরেই নিজেদের অনবদ্য প্রযোজনা মঞ্চায়নের পর এবার দুই দশক পূর্তিতে এ থিয়েটার পীঠস্থান ঘোড়ামারা গ্রামের নিজস্ব স্টুডিও হল ‘নটমণ্ডপ’ এ আয়োজন করে মাসব্যাপী একটি নাট্যমেলার। গত ২৫ সেপ্টেম্বর ছিল মণিপুরী থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
গত ২৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এ নাট্যমেলায় সপ্তাহে দুটি করে নাটক মঞ্চায়িত হচ্ছে। মণিপুরি থিয়েটারের ৫টি ও ঢাকার ৬টি’সহ মোট ১১টি নাটক ঘোড়ামারা গ্রামের নটমণ্ডপে এ আয়োজন সাজিয়েছেন নাট্য সংগঠনটির নাট্যজনেরা।
মণিপুরী থিয়েটারের এ আয়োজনকে অসাধারণ ও তুলনাহীন বলে অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ সিলেটটুডে টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মণিপুরী থিয়েটার এ আয়োজন এক কথায় তুলনাহীন, কোন আয়োজনের সাথেই এ আয়োজনের কোন তুলনা হয় না। গ্রামের এত নির্মল পরিবেশে মাটির মঞ্চে আমি সত্যিকারের থিয়েটারটা দেখতে পেয়েছি যা আমি গত ৪০ বছর গ্রাম থিয়েটার নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরেও দেখতে পাইনি”।
নাট্যমেলার উদ্বোধনী দিন আয়োজক মণিপুরী থিয়েটার পরিবেশন করে তাদের অন্যতম নাট্য প্রযোজনা ‘কহে বীরাঙ্গনা’। মাইকেল মধুসূদন দত্তের রচিত বীরাঙ্গণা কাব্য থেকে রূপান্তর করেন ও নাটকটির নির্দেশনা প্রদান করেন শুভাশিস সিনহা।
উদ্বোধনের পরদিন (২৮ অক্টোবর) নটমণ্ডপে মঞ্চায়িত হয় ঢাকা থিয়েটারের নাটক ‘বিনোদিনী’। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন ও সায়মন জাকারিয়া রচিত নাটকটির নির্দেশনা দেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ ও মঞ্চে অভিনয় করেন মঞ্চকুসুম শিমুল ইউসুফ।
এর পরের সপ্তাহে ৪ নভেম্বর মহাকাল নাট্য সম্প্রদায় মঞ্চস্থ করে নাটক ‘নীলাখ্যান’। কাজী নজরুল ইসলামের সাপুড়ে গল্প অবলম্বনে নাটকটি রচনা করেছেন আনন জামান, নির্দেশনা দিয়েছেন ইউসুফ হাসান অর্ক। পরদিন (৫ নভেম্বর) মঞ্চস্থ হয় মণিপুরি থিয়েটারের নিজস্ব প্রযোজনার নাটক ‘লেইমা’। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া লোরকার কাব্যনাটক ‘ইয়ের্মা’ থেকে ‘লেইমা’ নাটকটি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষায় রূপান্তর করে নির্দেশনা দিয়েছেন শুভাশিস সিনহা।
১১ নভেম্বর নটমণ্ডপে মঞ্চস্থ হয় থিয়েটার (নাটক সরণি) এর মঞ্চ নাটক ‘মুক্তি’। ত্রপা মজুমদারের নির্দেশনায় নাটকটিতে অভিনয় করে খ্যাতিমান মঞ্চাভিনেতা ফেরদৌসী মজুমদারসহ অন্যান্যরা। এরপরদিনই (১২ নভেম্বর) মঞ্চে নাটক নিয়ে আসে মণিপুরী থিয়েটার। বড়ু চন্ডীদাসের রচনা থেকে নেয়া নাটক ‘শ্রীকৃষ্ণকর্তন’। এ নাটকটিরও নির্দেশনায় রয়েছেন শুভাশিস সিনহা।
নাট্যমেলার নটমণ্ডপে আগামী ১৮ নভেম্বর নাটক মঞ্চায়ন করবে থিয়েটার আর্ট ইউনিট। এসএম সোলায়মানের রচনা ও নির্দেশনার নাটক ‘গোলাপজান’ মঞ্চায়ন করবে দলটি। এর পরদিন (১৯ নভেম্বর) মণিপুরী থিয়েটার তার নিজস্ব প্রযোজনা ‘ইঙাল আঁধার পালা’। নাটকটির রচনা ও নির্দেশনায় রয়েছেন শুভাশিস সিনহা।
মণিপুরী থিয়েটারের এ নাট্যমেলার শেষ সপ্তাহের আয়োজনে রয়েছে নাট্য সংগঠনটির নিজস্ব প্রযোজনা ‘দেবতার গ্রাস’। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে নাট্যরূপ দিয়ে নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন শুভাশিস সিনহা। এর পরদিন (২৫ নভেম্বর) প্রাচ্যনাট মঞ্চস্থ করবে নাটক ‘সার্কাস সার্কাস’। আজাদ আবুল কালাম রচিত নাটকটির নির্দেশনা প্রদান করেছেন রচয়িতা নিজেই।
উৎসবের সমাপনী সন্ধ্যায় (২৬ নভেম্বর) রয়েছে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নাটক। তবে এখন পর্যন্ত প্রযোজক নাট্যদলটি স্থির করতে পারেনি কোন নাটকটি করছেন তারা। তবে সম্ভাব্য নাটকের মধ্যে রয়েছে আসাদুজ্জামান নূর নির্দেশিত ও বের্টল্ট ব্রেশট রচিত নাটক ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’ অথবা ঊষা গাঙ্গুলী নির্দেশিত ও সা’দত হাসান মান্টোর নাটক ‘নাম-গোত্রহীন মান্টোর মেয়েরা’।
মাসব্যাপী আয়োজিত এ উৎসবের আয়োজন সম্পর্কে মণিপুরী থিয়েটারের পুরোধা ব্যক্তি ও এ নাট্যমেলার আহবায়ক শুভাশিস সিনহা বলেন, “আমাদের ছোট্ট গ্রামের ছোট্ট মাটির মঞ্চে এতগুলো বড় দল নাটক মঞ্চায়িত করেছে, আমাদের আবেগের সাথে তাদের আবেগ মিশিয়েছে, এতে আমরা কৃতজ্ঞ ও আপ্লুত”।
এছাড়াও এ আয়োজনের সাথে সম্পৃক্ত সবাইকে ছাড়াও তিনি বিশেষ করে ধন্যবাদ জানান যে সকল নাট্যপ্রেমীরা দূরদুরান্ত থেকে তাদের এ আয়োজনে এসেছেন থিয়েটার উপভোগ করতে, তাদেরকে।
আপনার মন্তব্য