নিজস্ব প্রতিবেদক

২৬ ফেব্রুয়ারি , ২০১৭ ২০:৩২

বেঙ্গল উৎসবে বিমোহিত সিলেট

সিলেটে চলছে ১০দিন ব্যাপী বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসব ২০১৭

রবিবার সন্ধ্যায় বাবা মায়ের হাত ধরে বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসবে এসেছে সাড়ে ৫ বছর বয়সী শশী। এ নিয়ে টানা পাঁচদিনই শশী ‍উপভোগ করেছে উৎসবের আয়োজন।

নাট্যকর্মী বাবা ও শিল্পী মায়ের সাথেই সিলেটের সংস্কৃতি অঙ্গণে তার বিচরণ জন্ম থেকেই। অসংখ্য মঞ্চনাটক দেখে আর গুণী শিল্পীর গান ‍শুনে বড় হতে থাকা শশীর জন্য বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ১০ দিনব্যাপী বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসব যেন একটি স্বপ্ন। এ উৎসবে এসে শশী যেমন মুগ্ধ, তেমনি মুগ্ধ তার বাবা-মা’ও।

“আমার মেয়ে তো নয়ই, আমি নিজেও কোনদিন বায়োস্কোপ দেখিনি। এ উৎসবে বাবা মেয়ে মিলে জীবনের প্রথমবারের মতো বায়োস্কোপ দেখলাম।”

আর তাই, প্রতিদিন বিকেল হতেই বাবা-মায়ের সঙ্গে শশী চলে আসে বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসবে। কেবল শশী বা তার বাবা-মা নয়; প্রতিদিনই এমন হাজারো মানুষ স্বপরিবারে আসছেন উৎসব প্রাঙ্গণে।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে সিলেটের আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্স-এ শুরু হয়েছে ‘মানবিক সাধনায় বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসব সিলেট ২০১৭’। আর এ উৎসবটি উৎসর্গিত হয়েছে জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের স্মরণে।

বাঙালি সাহিত্য-সংস্কৃতির হাজার বছরের ইতিহাস, সমসাময়িক প্রেক্ষাপট ও পরিবর্তিত জীবনধারার নানান দিকই উপস্থাপিত হচ্ছে বেঙ্গলের এ উৎসবে।

শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সকল দ্বারই এসে উন্মুক্ত হয়েছে সিলেটের এ উৎসবে। আর কেবলমাত্র বাংলাদেশের নয়, ভারত ও নেপালও যেন এক হয়েছে এ উৎসবের প্রাঙ্গণে।

প্রবেশদ্বার পার হলেই বাঁদিকে চোখে পড়বে আয়োজনের মূল অংশ ‘হাছন রাজা মঞ্চ’। যেখানে পরিবেশিত হচ্ছে গান ও নাচ। 

মূল মঞ্চের বাঁ দিকে ‘রাধারমণ দত্ত বেদী’তে বসেছে ‘সুবীর চৌধুরী আর্ট ক্যাম্প’। বাংলাদেশ ও ভারতের চিত্রশিল্পীরা এই আর্ট ক্যাম্পে এসে কথা বলছেন, ছবি আঁকছেন। 

প্রবেশপথের ডানদিকে রয়েছে বাউল শাহ আবদুল করিম চত্ত্বর। এখানে চলছে বাদ্যযন্ত্রের প্রদর্শনী। আলাদা আলাদা ছোট গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিশ্বের নানা দেশের বাদ্যযন্ত্র। এর পাশেই প্রদর্শনীতে উঠে এসেছে বৃহত্তর সিলেটের বিলুপ্ত ও বিপন্ন লোকগান সংক্রান্ত তথ্য।

এর পাশেই রয়েছে কারুমেলা। এ অংশটির নামকরণ করা হয়েছে গুরুসদয় দত্ত চৌধুরীর নামে। সিলেট, রাজশাহী, কুমিল্লা, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন অংশের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পের প্রদর্শনী চলছে।

তাঁত বা খাদি, মাটির তৈজস কিংবা কাঠের খেলনা, শাঁখা চুড়ি অথবা পাটের কারু – এসবই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত এসে যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে সিলেটের একটি মাঠের এই অংশটিতে।

এছাড়াও, এ উৎসবের অন্যতম আয়োজন হিসেবে রয়েছে সাহিত্য সম্মেলন, চলচ্চিত্র ও মঞ্চনাট্য প্রদর্শনী। আর এ সবই চলছে সিলেটের খ্যাতিমান রম্য লেখকের স্মরণে সৈয়দ মুজতবা আলী মঞ্চে।

উৎসবের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম দিন সকাল থেকেই এ মঞ্চে বসেছিল সাহিত্যের সম্মিলন যাতে একত্রিত হয়েছিলেন বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের কবি-সাহিত্যিক ও সাহিত্য গবেষকরা।

এছাড়াও, প্রায় প্রতিদিনই রয়েছে বিভিন্ন চলচ্চিত্র প্রদর্শনী এবং উৎসবে খ্যাতনামা নাট্যদলের পরিবেশনায় মোট ৪টি মঞ্চনাটকও প্রদর্শিত হচ্ছে।

উৎসবের মূল মঞ্চে গান পরিবেশন করে দর্শক মাতিয়েছেন সুবীর নন্দী, চন্দনা মজুমদার, খায়রুল আনাম শাকিল, অদিতি মহসিন, শতাব্দী রায়, মনোময় ভট্টাচার্য, ইফফাত আরা দেওয়ান, লাবিব কামাল গৌরব, নবনিতা চৌধুরী, বেবী দেওয়ান, কৃষ্ণকলি ও গানের দল জলের গান।

বাকি দিনগুলোতে থাকছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত লোকসংগীতশিল্পী সুষমা দাস, ভারতের বিখ্যাত সংগীতশিল্পী হৈমন্তী শুক্লা ও শ্রীকান্ত আচার্য, জ্যোতি চক্রবর্তী ও হাল আমলের বাউলিয়ানার ক্রেজ হয়ে উঠা পার্বতী বাউল। আর শেষ দিনের আকর্ষণ হিসেবে থাকছেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও বাউল শফি মণ্ডল।

কেবলমাত্র শিল্প-সাহিত্য কিংবা কারু নয়, বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসবের ভিন্ন একটি আঙ্গিক যুক্ত করেছে সৈয়দ মুজতবা আলীর মঞ্চের পাশে বাঁশ ও কালো দড়ির অস্থায়ী স্থাপত্য গ্যালারি কুশিয়ারা কলোনেড। এর মধ্যে প্রদর্শিত হচ্ছে সিলেট শহরের নানা অংশ ও তার নান্দনিক ভবিষ্যতের একটি কাল্পনিক পরিকল্পনা।

উপস্থিত দর্শকদের কাছে বেঙ্গলের এ আয়োজনটি অনবদ্য, কারণ কেবলমাত্র শিল্প-সাহিত্য-চারু-কারু নয়, যতভাবে সম্ভব, প্রায় ততভাবেই বেঙ্গল পরিবেশন করছে এই উৎসবে। ‍তাদের এই আয়োজন কেবল মনই ভরায়নি, প্রতি মুহূর্কেই বিমোহিত ‍করছে সিলেটের সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষকে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত