শফিকুল ইসলাম, রাবি

০৭ মার্চ, ২০১৭ ১১:২৯

‘এন্তারনেট’-ই যেনো সাম্প্রতিক ভাবনা

প্রযুক্তির স্রোতে বাড়ছে পুঁজি, হারিয়ে যাচ্ছে শিল্প-সংস্কৃতি; সমান তালে বাড়ছে সামাজিক বৈষম্য, ব্যক্তিস্বার্থ। এক সময়ের ‘মানুষ মানুষের জন্যে...’ রূপ নিয়েছে ‘আমাকে আমার মত থাকতে দাও...’! ‘বৈষম্য বেড়েছে, সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদী-জঙ্গিবাদের খড়গের তলায় বসবাস সবার, ভোগবাদী দর্শনে গড়ে উঠেছে সামাজিক মূল্যবোধ, সুপার ক্যাপিটালের মুরুব্বিরা চেপে বসেছে রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতির ঘাড়ে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এগুলো ঠেকানো যায় নি কেনো?

এইতো সেদিনও মানুষের হাতে ছিল না অবাক পৃথিবীর যত সব বিস্ময়, ছিলো প্রাণের সুর- ঐতিহ্য। আর, আজ মানুষই যেন প্রযুক্তি! ঐতিহ্য খুইয়ে মানুষের চিন্তা-ধারার যে ‘উন্নতি’ তার নেপথ্যে প্রধান চালিকা শক্তি হিসাবে মুখ্য ভূমিকা পুঁজিরই বটে। পুঁজির হাতে মানুষ বলি দিয়েছে তার নিজস্বতাকে। মানুষের এই পরিবর্তন ভাল, নাকি খারাপ সে-বিচার সময়ের হাতেই।

প্রকৃতি পরিবর্তনশীল। তবে সেই পরিবর্তন নির্ভর করে যাদের ওপর, তারা পরিবর্তনটা কোনদিকে নিয়ে যাবে সেটা তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরই নির্ভর করে। যেমন ধরা যায়, পৃথিবীতে কোনো মানুষই অপরাধী হয়ে জন্ম নেয় না, অপরাধী হয়ে ওঠে। কোনটা ‘অপরাধ’ আর কোনটা নয় সেটাও ব্যক্তি ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই এটা জলবৎ তরলং এর মতো পরিষ্কার হয়ে যায় ‘অপরাধের’ চালিকা শক্তির চেহারা। তবে এটা নিশ্চিত, অপরাধ যত বড়, পিছনের হাত ততো বড়-লম্বা-শক্তিশালী।

এখন কথা হলো অপরাধ করে কে? অপরাধী সৃষ্টি করে কে বা কারা? অন্তত সমাজ-রাষ্ট্র-দেশ কাউকে অপরাধী বানায় না, বানায় চলমান একটা সিস্টেম। যে সিস্টেম কেড়ে নিয়েছে শিল্প-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য, বিনিময়ে দিয়েছে যত ‘অপসংস্কৃতি’! এই সিস্টেমই মানুষের প্রধান শক্তি, মেরুদণ্ড ‘শিক্ষা’কে দিয়েছে বাণিজ্যিক রূপ। শিক্ষাও যে একটা পণ্য তা বার বার প্রমাণ করেছে এই সিস্টেম। সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে সব কিছুকে বাণিজ্যিকিকরণের এই নির্মোহ তৈরি করছে নতুন সব ডিসকোর্স।

সাম্প্রতিককালে তৃতীয় বিশ্বের এ দেশটি এক বিভীষিকাময় সময়ের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করছে। দেশের পাবলিক কিংবা প্রাইভেট শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো এমনকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও এর বাহিরে নয়। যাতে আটকা পড়ে আছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও। খানিকটা তাকালেই চোখে পড়ে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ক্যাম্পাসগুলো কতোটা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত। প্রতিটি ক্যাম্পাসে নামে বে-নামে যে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো রয়েছে সেগুলোও মৃতপ্রায়। তাই এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা ক্যাম্পাসগুলোও খরায় পুড়ছে। এর পিছনে কাজ করছে ওই অলীক সিস্টেমই। বর্তমানে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে মোকাবেলা করতে হয় নানা প্রতিবন্ধকতা। শিক্ষা-ব্যবস্থার এই ক্রান্তিক্ষণে শিক্ষার্থীরাই-বা কতোটা সংস্কৃতিমনা হয়ে উঠতে পারছে? যেটুকু পাচ্ছে তারও ‘সঠিক’ ব্যয় করছে না। কারণ তাদের মানসিকতাটাই সেভাবে গড়ে উঠছে না।

‘শিল্প মানুষের মনের ময়লা দূর করে’। এই কথাটির সত্যতার বড় প্রমাণ এই ক্রান্তিকাল। যে সময়ে নানা ডিসকোর্সের নির্মোহ দিকটাই দেখতে হচ্ছে। বর্তমান সময়ে আলোচিত দিক ‘জঙ্গিবাদ’। এইতো ক’টা দিন আগেও পত্রিকা-টিভিসহ গণমাধ্যমের সামনে বসলেই আমাদের ইন্দ্রিয়তে ভাসতো যে ডিসকোর্স। সেই জঙ্গিবাদ কীভাবে আমাদের মধ্যে এলো, সে প্রশ্ন না করে এটা বলা শ্রেয়, সাংস্কৃতিক অপ্রতুলতাই জঙ্গিবাদের প্রধান কারণ। মানুষের মধ্যে সঠিক সংস্কৃতি চর্চা, শুদ্ধ সংস্কৃতির বিকাশই জঙ্গিবাদ দমনের প্রধান হাতিয়ার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক চর্চা, বিকাশ কতোটুকু হচ্ছে, সে দিকটাই ভাবায়।

সংস্কৃতির একটি অন্যতম ধারা নাটক। নাটকের মাধ্যমেই গড়ে ওঠে যত আন্দোলন, ঘটে সমাজের পরিবর্তন। নাটকের এই ধারায় গড়ে ওঠা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ঐতিহ্যবাহী নাট্য সংগঠন অনুশীলনের ৬০তম প্রযোজনা জঙ্গিবাদ বিরোধী নাটক ‘এন্তারনেট’। বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক মলয় ভৌমিকের রচনা ও নির্দেশনায় নাটকটিতে তুলে ধরা হয়েছে ‘একটি সাধারণ পরিবারের সদস্যদের, বিশেষ করে যুব-মানসের ওপর বর্তমান রাষ্ট্র-রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি এমনকি সামাজিক-পারিবারিক ব্যবস্থা, আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং দেশি-বিদেশি নানা স্বার্থবাদী কর্মকাণ্ড কীভাবে অভিঘাত ও বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে, তার কিছু নমুনা।

সোমবার সন্ধ্যা ৭টায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে জঙ্গিবাদ বিরোধী ‘এন্তারনেট’ ষষ্ঠ বারের মতো প্রদর্শিত হয়। নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন নাজমুন নাহার সাথী, তানজিদা নাহার জুঁই, খাইরুল ইসলাম, তানভির অর্ক, মিজানুর রহমান, রায়হান উদ্দিন, শাহরিয়ার তারেক, স্বাধীন, মইনুল ইসলাম, মানিক, রাসেল, অনিক মাসুদ প্রমুখ।

উত্তরাধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে কোনোকিছুই যেনো স্থায়িত্ব নেই। তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক একটি সংগঠন হওয়ায় মঞ্চে দাঁড়াতে শেখার আগেই কর্মীদের চলে যেতে হয়। সার্বক্ষণিক নতুন কর্মী সংগ্রহের অসম্ভব কঠিন কাজকে সম্ভব করে তোলা, সামর্থ্যবান মধ্যবিত্তের থিয়েটার বিমুখতা, সেমিস্টার পদ্ধতিতে লেখাপড়ার চাপ, মেয়েদের হলে প্রবেশে সান্ধ্য আইন, মৌলবাদী ছাত্রসংগঠন ও জঙ্গিবাদীদের নৈমিত্তিক রক্তচক্ষু, মঞ্চে আক্রমণ, অগ্নিসংযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রবল বিরোধিতা, প্রগতিশীল শক্তির ক্রমাগত পিঠটান, সব মিলিয়ে এক চরম অনিশ্চয়তা। তবুও স্পর্ধার উচ্চারণÑ কাজটা ছাড়ছে না অনুশীলন।

‘বৈষম্য বেড়েছে, সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদী-জঙ্গিবাদের খড়গের তলায় বসবাস সবার, ভোগবাদী দর্শনে গড়ে উঠেছে সামাজিক মূল্যবোধ, সুপার ক্যাপিটালের মুরুব্বিরা চেপে বসেছে রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতির ঘাড়ে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এগুলো ঠেকানো যায় নি কেনো? দায়িত্বটা একমাত্র নাটকের নয়Ñ একথা বলে দায় এড়িয়ে গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসানোকে যৌক্তিক মনে করেনি ৩৭ বছর ধরে পথ চলা অনুশীলন নাট্যদল।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত