ড. তপন বাগচী

০১ জুন, ২০১৭ ০১:৩৩

জাকির শাহ : সুর ও বাণীর শুদ্ধতার সাধক

বর্তমানে প্রজন্মে যাঁরা মরমিগান রচনা করে, সুর করে এবং পরিবেশন করে, জাকির শাহ-র নাম তাদের সামনের কাতারে। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল, বিশেষত সুনামগঞ্জে জন্মনেয়া জাকির শাহ এখন গীতিকার ও শিল্পী হিসেবে বেশ আলোচিত নাম। জাকির শাহ যে শুধু নিজের গান করে, তা নয়, অন্য মরমি কবিদের গানও কণ্ঠে তুলে নেয়। সিলেট অঞ্চলের বাউল-গানের শিল্পী ও মরমি কবিদের উত্তরসূরী হিসেবেই নিজেকে গড়ে তোলার সাধনা চালিয়ে যাচ্ছে। তার বেশির ভাগ গানের বাণীই আধ্যাত্ত্বিক বা ভাবতত্ত্বের উপর নির্ভর করে রচিত। এ ধরনের গানই তাকে খুব টানে।

জাকিরের বাবা ছিলেন গানের মানুষ। বাউলগানের ভক্ত এবং ব্যাখ্যাতা ছিলেন তিনি। ঘরে-বাইরে যেখানে যে অবস্থায় থাকতেন গান যেন তার কণ্ঠের হার হয়ে উঠেছিল। তিনি ওই এলাকার একজন সালিশ ব্যক্তিত্বও ছিলেন। অনেক সালিশেতেও গান গেয়েছেন, গান গেয়ে দুইপক্ষের বিবাদমান দলকে আনন্দে মাতিয়ে তুলেছেন। সংগীতপ্রিয় লোক ছিলেন তিনি। সংগীতানুরাগী পিতার আদর্শেই জাকির নিজেকে গড়ে তুলেছে। সিলেটে বাস করে গান গেয়ে জাতীয় পর্যায়ে পরিচিতি পাওয়া তো একটা বড় চ্যালেঞ্জ। জাকির তা জানে। তবু সিলেটের সাংগীতিক ঐতিহ্যকে স্মরণে রেখে জাকির তার গানের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সাধনাই তার বড় সম্বল।

সিলেটে অজস্ত্র গীতিকরি আবির্ভাব।  দ্বাদশ শতকের এক বৈষ্ণব কবি মীন নাথ। তারপর চতুর্দশ শতকে কবি অদ্বৈত আচার্য। এরপর একে একে দীন ভবানন্দ সৈয়দ শাহ নূর, শীতালং শাহ, পীর নছিম আলী, সহিফা খাতুন, হাসন রাজা, রাধারমণ দত্ত, দুর্ব্বিণ শাহ্, আরকুম শাহ, শাহ আবদুল করিম, ক্বারী আমীরউদ্দিন, গিয়াসউদ্দিন প্রমুখের উত্তরসূরী এই জাকির শাহ।  কেবল মনের টানে লেখা আর সুরের ঘোরে গ্ওায়া নয়। ওস্তাদের কাছে রীতিমতো সংগীতশিক্ষাগ্রহণে  সে বদ্ধপরিকর।

সিলেটের মহাজন হাছন রাজা, রাধারমণ, দুর্ব্বিণ শাহ প্রমুখের গান ভাল গাইতে পারে জাকির। কিন্তু এসকময় খেয়াল করলো  যে গানে যা সে বলতে চায়, তার জন্য নতুন বাণী দরকার। আর তখনই নিজে লিখতে শুরু করা। আর দরদ ঢেলে নিজের গান নিজের মতো করে গাইতে থাকা। সে তো শুরু। আর থামা নেই।

গান গাওয়া আর লেখার পাশাপাশি একসময় দুর্ব্বিণ শাহর গান নিয়ে গবেষণাও করেছে জাকির। নতুন কিছু তথ্য উদ্ঘাটন আর নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে দুর্ব্বিণ শাহকে আবিষ্কার করেছে জাকির। বাবাকেই সে গানের গুরু মানে। বাবার কাছ থেকেই শিখেছে গান। গান রচনার কৌশল জানতে  সে পড়ালেখাও করেছে।

ইতোমধ্যে তার গানের দু’খানা বই প্রকাশ হয়েছে। একখানা হলো “রূপের ঘরে স্বরূপ ধরে”, অন্যখানা হলো “ভাবের ঘরে ভারই নড়ে”। এতে রয়েছে দেহতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, কামতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, পারঘাটা তত্ত্ব ইত্যাদি। এই দু’খানা বই প্রকাশের মাধ্যমে যথেষ্ট সাড়া পেয়েছে জাকির, যা তাকে আরো গান লিখতে উৎসাহিত করেছে। গান যে কেবল গীত নয়, তা যে পাঠ্য হতে পারে, সেই কথাটি এখনকার গীতিকবিরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে না। জাকিরের সেই বিবেচনা আছে। আর তার সুফলও সে পেয়েছে।

নিজের লেখা গান নিজের কণ্ঠে অ্যালবাম করার প্রস্তুতিও নিয়েছে সে। অ্যালবামে ৮টি গানের মধ্যে ৪টি গান জাকির গেয়েছে আর ৪টি গান গেয়েছে তরুণ শিল্পী অর্পণা চন্দ। জাকির গানে ভণিতা থাকে। জাকিরের গান আত্মনিবেদনের গান। যার উদ্দেশ্যে নিবেদিত তার কাছে তো নিজেকে আর গোপন কওে রাখা যায় না। তাই ভণিতায় নিজের নামটি রচিত থাকে। এই গানে শিল্পীর কণ্ঠেই থেকে যাবে স্রষ্টার নাম।

এবারের ‘শুদ্ধ স্বরে নিরিখ করে’ পান্ডুলিপিটি পাঠের সুযোগ আমার হয়েছে। মানুষের প্রতিটি মুহূর্ত-ই তার জীবনের নির্ধারিত আয়ু থেকে ব্যয় হয়ে যায়, তাই নিজেকে শুদ্ধ করার সাধনা বা নিয়তের ভেতরে এক মুহূর্তের জন্যেও স্থির থাকতে পারে না তার সদাসঙ্গী ষটরিপুর কারণে, এই  বিষয়টি নিয়েই শুরু হয়েছে এর প্রথম গান-

                                 দমেদমে প্রাণের দমে
আমার দিকে আসে যত
আমি যেন পাপ সাগরে
ডুবতে থাকি অবিরত ॥

            এই না ফেরে পড়ছে জাকির
         কি যেন হয় আমি পাপীর
       হস্ত বান্দা রই নতশির
         থাকব কি আর অক্ষত ॥


মধু এবং ফুলের রূপকে অজস্ত্র গান রচিত হয়েছে। রাধারমণের গানেও এই রূপকের প্রয়োগ দেখি। আমাদেও জাকির শাহ একই রূপে লিখেছে নতুন গান-

  আমার মধু না রহিল ফুলের কোলে গো
                            কাল ভ্রমরা ঝুলে ফুলেফুলে ॥

                            আসিল বসন্ত কাল
                             সুশোভিত গাছের ডাল
                             ডালেডালে ফুলের ঝুটা ঝুলে
                             পাগল করা ফুলের সুবাস
                             ঘটাইল আমার সর্বনাশ
মধুর আসে থাকে বসে দোলে গো ॥

                             বসন্তের ভ্রমরও জাতি
                             বুঝে না ফুলেরও মতি
                             ফুল ফোটে ঝুলতে রাজার গলে-
                             মধু শূন্য ফুলের মত
                             সোনার যৌবন হইল গত
    তাইতো জাকির কান্দে চিত্তশুলে গো ॥

জাকিরের নতুন গানে আমরা বিচ্ছেদী গান পাই, ধামাইল গান পাই। সুনামগঞ্জের মানুষ, আর সে ধামাইল গান লিখবে না? তা কি হয়!  জাকির যেহেতু সুর দিতে জানে, তাই তার গানের বাণী এমনই যে তা যেন সুরের অপেক্ষা করে বসে থাকে।  ‘কানু ছাড়া গীত নাই’ কথাটি সে জানে। তাই তো গানে এসে যায় যমুনায় রাধার  জলে যাওয়ার প্রসঙ্গ-
জল খেলিতে চল গো সখি
জল খেলিতে চল
আজ নিশিতে জল খেলিতে
সাধুর মন উচ্ছ্বল॥

পাগলও জাকিরে বলে
যে পাড়ে ঐ সাধুর ছলে
বুঝো না তার চলাকলে
করে কি কৌশল॥
এই গান জলধামাইল হিসেবেও পরিবেশনের যোগ্য। জাকিরের গানের বড় বৈশিষ্ট্য হলো তত্ত্বকথাকে সে নিগূঢ়ভাবে প্রকাশ করতে পারে। চলতি সময়ের গীতিকবিরা এ ব্যাপারে যেখানে সচেতন নয়, জাকির সেখানে সচেতন ও শিক্ষিত। গীতসাধনার ধারা সম্পর্কে তার ব্যাপক পঠনপাঠন আছে, পর্যবেক্ষণ আছে, আছে চর্চা ও সাধনা। তাই তার হাতে তত্ত্বগান নতুন সুরে প্রাণ পেয়েছে।

জাকির শাহের সাথে আমার বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ, সদর, ধরাধরপুর আরকুম শাহর সমাধিক্ষেত্র এবং সুনামগঞ্জ ধামাইল উৎসবে। খুবই নিষ্ঠা লক্ষ করেছি তার গান শেখার প্রতি, গান লেখার রণকৌশলের প্রতি। সিলেটে আরকুম শাহর বার্ষিক স্মরণদিবসের বক্তৃতা শেষে গভীর রাতে ঢাকায় ফেরার পথে তার গান শুনতে শুনতে বাসস্ট্যান্ডে এসেছি। গানের ব্যাপারে অত্যন্ত নিবেদিত মনে হয়েছে তাকে। এই তো সেদিন সুনামগঞ্জ বাউল উসৎবে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আমার সঙ্গেই ছিল জাকির। আঞ্চলিক গানের প্রতি তার তীব্র আকর্ষণ দেখে মুগ্ধ হয়েছি।

জাকির আধ্যাত্মিক গান রচনা করে। আধুনিক উচ্চশিক্ষার অধিকারী আধুনিক মানুষ সে। তাই তার গানের রচনাশৈলীতে লোকগানের প্রভাব এড়িয়ে যাওয়া দরকার। প্রথম দুটি বইয়ের ছন্দ এবং অন্ত্যমিলে বেশ কিছু এলোমেলো ব্যাপার লক্ষ করে আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কিছু পরামর্শ দিয়েছিলাম। সেই কারণে হয়তো সে আমাকে ‘গুরু’ বলে ডাকে। আমি এতে কিছুটা বিব্রত হই নিজের অযোগ্যতাকে জানি বলেই। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। গান রচনার কলাকৌশল সে আমার কাছ থেকে শিখতে চায়। আমার যেটুকু সাধ্য, তার সঙ্গে তা আলোচনা করি। কখনো কখনো আমি নিজেই ঋদ্ধ হই তার সঙ্গে আলোচনায়। আমার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে স্বরচিত গানের তৃতীয় সংকলনে এসে কিছু পরিশীলনের চেষ্টা সে করেছে দেখে ভাল লাগল। তবু ছন্দ এবং মাত্রাসমতা রক্ষার ব্যাপারে তাকে আরো মনোযোগী হতে হবে। অন্ত্যমিল রক্ষায় তাকে আরো অভিনিবেশী হতে হবে। সেই যোগ্যতা আর মানসিকতা তার আছে। পুরনো অভ্যেসমতো যে সকল গান সে লিখেছে, তাতে সুরযোজনা করে একটা অবস্থানে সে করতে পেরেছে। একস্থানে থেমে থাকলে তো চলবে না। এখন দরকার পরবর্তী উত্তরণ। সেই ধারায় সে আরো পরিশীলিত হবে, এবং পূর্বতন মহাজনদেও গানের ত্রুটিদুর্বলতা পেরিয়ে জাকির শাহ হয়ে উঠবে সুর ও বাণীর শুদ্ধতার সাধক। তার প্রতি আমার আন্তরিক শুভকামনা রইল।

ড. তপন বাগচী : কবি-গীতিকার-প্রাবন্ধিক, উপপরিচালক, বাংলা একাডেমি, ঢাকা

আপনার মন্তব্য

আলোচিত