সিলেটটুডে ডেস্ক

০৬ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:৩৮

কার্যতালিকায় যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর রিভিউ, আজ শুনানি

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা রিভিউ আবেদন ও খালাস চেয়ে করা সাঈদীর রিভিউ আবেদন শুনানির জন্য আজ বৃহস্পতিবারের (৬ এপ্রিল) কার্যতালিকায় রাখা হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের বৃহস্পতিবারের কার্যতালিকায় বিষয়টি ১৩৮ নম্বর ক্রমিকে রাখা আছে।

এর আগে, গত ৩ এপ্রিল সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা রিভিউ আবেদন ও খালাস চেয়ে করা সাঈদীর রিভিউ আবেদনটি প্রথমবারের মতো রিভিউ শুনানি কার্যতালিকায় ১৪৭ নম্বরে স্থান পায়।

এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আগামী ৬ এপ্রিল মামলাটির শুনানি হতে পারে। আমরা সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’

গত বছরের ১২ জানুয়ারি সাঈদীর সাজা আমৃত্যু কারাদণ্ড থেকে বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রাষ্ট্রপক্ষ রিভিউ আবেদন করে। রাষ্ট্রপক্ষের ৩০ পৃষ্ঠার মূল আবেদনে পাঁচটি যুক্তি দেখানো হয়।

অন্যদিকে, ১৭ জানুয়ারি আপিলের রায় থেকে খালাস চেয়ে রিভিউ আবেদন দায়ের করেন সাঈদী। মোট ৯০ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে আমৃত্যু কারাদণ্ড থেকে খালাস পেতে ১৬টি যুক্তি দেখানো হয়।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ট্রাইব্যুনালে সাঈদীর বিরুদ্ধে গঠিত ২০টি অভিযোগের মধ্যে আটটি প্রমাণিত হয়।

২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদান করেন। ওই বেঞ্চের অন্য চার বিচারপতি ছিলেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

ট্রাইব্যুনালের রায়ে ২০টি অভিযোগের মধ্যে আটটিতে দোষী সাব্যস্ত হন সাঈদী। এর মধ্যে একাত্তরে ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসাবালীকে হত্যার দায়ে আলাদা দুটি অভিযোগে তাকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়। ওই সাজা থেকে খালাস চেয়ে আপিল করেছিলেন এই জামায়াত নেতা। আর রাষ্ট্রপক্ষ অন্য ছয়টি অভিযোগে সাজা চেয়ে আপিল করে, যেগুলোতে দোষী সাব্যস্ত হলেও ট্রাইব্যুনাল সাজা দেননি।

আপিলে ১০, ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগে সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন আপিল বিভাগ। ১০ নম্বর অভিযোগ বিসাবালিকে হত্যার, ১৬ নম্বর অভিযোগ তিন নারীকে অপহরণ করে আটকে রেখে ধর্ষণের এবং ১৯ নম্বর অভিযোগ প্রভাব খাটিয়ে ১০০-১৫০ হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করার।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে ৬, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়। ৬ নম্বর অভিযোগ লুণ্ঠনের, ১১ নম্বর হামলা ও লুণ্ঠনের এবং ১৪ নম্বর অভিযোগ ধর্ষণের।

৮ নম্বর অভিযোগের অংশবিশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে সাঈদীকে খালাস দেওয়া হয়। একই অভিযোগের অংশবিশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে তাকে ১২ বছর কারাদণ্ড দেন আপিল বিভাগ। অষ্টম অভিযোগটি হত্যা ও অগ্নিসংযোগের।

এ ছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে ৭ নম্বর অভিযোগে সাঈদীকে ১০ বছর কারাদণ্ড দেন আপিল বিভাগ। সপ্তম অভিযোগ নির্যাতন ও বাড়ি লুণ্ঠনের পর অগ্নিসংযোগ।

৮ নম্বর (ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা) ও ১০ নম্বর অভিযোগের (বিসাবালি হত্যা) দায়ে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনালের রায়: মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ রায় দেন।

ট্রাইব্যুনালে সাঈদীর বিরুদ্ধে গঠিত ২০টি অভিযোগের মধ্যে আটটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এগুলো হলো: ৬, ৭, ৮, ১০, ১১, ১৪, ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগ।

এর মধ্যে ৮ ও ১০ নম্বর অভিযোগ হত্যার, ১৪ ও ১৬ নম্বর অভিযোগ ধর্ষণের এবং ১৯ নম্বর অভিযোগ ধর্মান্তরিত করার। বাকিগুলো নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন এবং এ ধরনের অপরাধে সহযোগিতার অভিযোগ।

সাঈদীর বিরুদ্ধে ৬ নম্বর অভিযোগ-মাখনলাল সাহার ২২ সের স্বর্ণ লুট করা।

৭ নম্বর অভিযোগ-মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম সেলিমকে নির্যাতন ও তাঁর বাড়ি লুণ্ঠনের পর অগ্নিসংযোগ।

৮ নম্বর অভিযোগ-একাত্তরের ৮ মে ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যা এবং পিরোজপুরের পারেরহাট এলাকায় হিন্দুদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ।

১০ নম্বর অভিযোগ-একাত্তরের ২ জুন বিসাবালিকে হত্যা এবং উমেদপুর হিন্দুপাড়ার ২৪টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ।

১১ নম্বর অভিযোগ-মুক্তিযোদ্ধা মাহাবুবুল আলম হাওলাদারের বাড়িতে হামলা ও লুণ্ঠন।

১৪ নম্বর অভিযোগ-মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে হোগলাবুনিয়ার হিন্দুপাড়ায় এক নারীকে ধর্ষণ ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ।

সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৬ নম্বর অভিযোগ-তিন নারীকে অপহরণ করে আটকে রেখে ধর্ষণ।

ধর্মান্তরিত করার ১৯ নম্বর অভিযোগ-প্রভাব খাটিয়ে পারেরহাটসহ অন্য গ্রামের ১০০-১৫০ হিন্দুকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা।

ইব্রাহিম কুট্টি (৮ নম্বর অভিযোগ) ও বিসাবালিকে হত্যার (১০ নম্বর অভিযোগ) দায়ে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের দুটি, ধর্মান্তরিত করার একটি এবং লুটপাট, অগ্নিসংযোগ নির্যাতনের তিনটি অভিযোগ প্রমাণিত হলেও দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ায় অন্য অভিযোগগুলোতে আলাদা করে কোনো দণ্ড দেওয়া হয়নি।

ট্রাইব্যুনালে সাঈদীর বিরুদ্ধে গঠিত ১ থেকে ৫ এবং ৯, ১২, ১৩, ১৫, ১৭, ১৮ ও ২০ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। এর মধ্যে গণহত্যার চারটি (২, ৪, ১২, ১৫), ধর্ষণের দুটি (১৭ ও ২০) ও হত্যার (১, ৫, ১৩ ও ১৮) চারটি অভিযোগ। বাকি দুটি অভিযোগ ছিল লুটপাটের।

রায়ে বলা হয়, প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ, নথি ও যুক্তির ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল মনে করেন, সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও ধর্মান্তরিত করা এবং এ ধরনের অপরাধে সহযোগিতার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে অষ্টম অভিযোগে ইব্রাহিম কুট্টি ও দশম অভিযোগে বিসাবালি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অপরাধের গভীরতা ও গুরুত্ব বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনাল মনে করেন, আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত।

চূড়ান্ত আদেশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আসামি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হলো। প্রমাণিত না হওয়া ১২টি অভিযোগ থেকে সাঈদীকে খালাস দেওয়া হলো।

উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ২৯ জুন সাঈদী গ্রেপ্তার হন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে। পরে ২ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত