হাসান মোরশেদ

২১ মে, ২০১৫ ১৫:১৭

দাসপার্টির খোঁজে: খসড়া পর্ব-৩

সর্ব্বোচ্চ সম্মানের ঘোষণা দিয়ে ও রাষ্ট্র তাকে ভূষিত করেছে তৃতীয় খেতাবে , অথচ সহযোদ্ধাদের কাছে আজও তিনি শ্রেষ্ঠ বীর। বিশাল ভাটি অঞ্চলের বীরশ্রেষ্ঠ। হত্যা আর মরদেহ প্রদর্শনের ধরণে তাকে একাত্তরের যীশুও বলেন অনেকে। চুয়াল্লিশ বছর পর লেখক হাসান মোরশেদ বেরিয়েছেন শহীদ জগৎজ্যোতি দাস আর তাঁর দাস পার্টির খোঁজে।। তাঁর সেই অনুসন্ধান ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে সিলেটটুড২৪ডটকম-এ। আজ প্রকাশিত হলো তৃতীয় কিস্

(দ্বিতীয় পর্বের পরে)

২৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৫।

দাসপার্টির খোঁজে আমাদের যাত্রা শুরুর আজ প্রথম দিন। আমি এবং নজরুল ইসলাম- সচলায়তনে আমার সহ ব্লগার, নাট্যনির্মাতা- আমরা দুজন এসেছি উত্তরার একটি বাসার খোঁজে। সকাল দশটা বেজে কয়েক মিনিট।

এই মানুষটার খোঁজ আমাকে দিয়েছেন সিলেটের সিনিয়র সাংবাদিক আল-আজাদ। আল-আজাদ নিজেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করেন বহুবছর। ক্যাপ্টেন মুত্তালিব এর  সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। মুত্তালিব এর শেষ সময়ে, যখন গুরুতর অসুস্থ তখন আল-আজাদ তার ভাষ্যে উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনের একটি বিস্তারিত বর্ণনা নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপুর্ণ একটি কাজ।

আমরা এসেছি সালেহ চৌধুরীর খোঁজে। ইনিও সাংবাদিক। বাংলাদেশের সিনিয়র সাংবাদিকদের একজন। এপ্রিল ১৯৭১ পর্যন্ত দৈনিক পাকিস্তানের সাব-এডিটর ছিলেন। তারপর আবার বাহাত্তুর থেকে অবসর নেয়া পর্যন্ত দৈনিক বাংলায়। মাঝখানে মুক্তিযুদ্ধের মাসগুলো ছিলেন অস্ত্রহাতে যোদ্ধা। না, সালেহ চৌধুরীকে ঠিক অস্ত্র হাতে যোদ্ধা বললেই তার ভূমিকা শেষ হয়ে যায়না।
 
মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর সিলেট তিনটি সেক্টরে বিভক্ত ছিলো। সেক্টর তিন চার ও পাঁচ। উত্তর-পূর্বের জৈন্তাপুর থেকে উত্তর পশ্চিমের তাহিরপুর-ধর্মপাশা পর্যন্ত ছিলো সেক্টর পাঁচ এর বিস্তৃতি। এই সেক্টরের সবচেয়ে পশ্চিমের সাব-সেক্টরটি বড়ছড়া বা টেকেরঘাট সাব-সেক্টর। এটি সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলাধীন টাঙ্গুয়ার হাওরের পাড়ে পশ্চিম খাসিয়া পাহাড়ের কোলে। এর পরেই ভারতের গারো পাহাড় এবং বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলা- এগারো নম্বর সেক্টরের শুরু।

উলম্বভাবে উত্তর থেকে দক্ষিনে নীচের দিকে নেমে এলে- সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলা( একাংশ), জামালগঞ্জ, দিরাই, শাল্লা, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ ও বানিয়াচং উপজেলা নিয়ে টেকেরঘাট সাব-সেক্টর। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনে চার নম্বর সেক্টরের জগন্নাথপুর ও নবীগঞ্জ, এগারো নম্বর সেক্টরের খালিয়াজুড়ি উপজেলায় এই সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনে যেতে হতো।


এই বিশাল এলাকার পুরোটাই ভাটি অঞ্চল। উত্তরে পাহাড় আর সবদিকেই  বিশাল বিশাল হাওড় আর নদী। হাওর এলাকার প্রায় মাঝামাঝি দিরাই উপজেলা। এই দিরাই উপজেলার গচিয়া গ্রামের জমিদার পরিবারের সন্তান সালেহ চৌধুরী, পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক।

আগষ্ট মাসে অফিসিয়ালি সাব-সেক্টর নির্ধারিত হওয়ার পর মধ্যবর্তী দিরাই এ অবস্থান করে সালেহ চৌধুরী টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের প্রধান সমন্বয়ক এর দায়িত্ব পালন করেন। অন্য সেক্টরগুলোর মতো এখানে মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপগুলো প্লাটুন, কোম্পানী বিন্যস্ত হয়নি। ভাটি অঞ্চলের রনকৌশল হিসাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট ছোট দলে ভাগ করা হয়েছিলো। বারো থেকে চল্লিশজনের এক একটা দল হতো। তাহিরপুর, জামালগঞ্জ পেরিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা দল নানা সময়ে আসতো দিরাই সালেহ চৌধুরীর সমন্বয় কেন্দ্রে। এখান থেকে তাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হতো পরিকল্পনা মতো নানা অপারেশনে। অপারেশনের পর আবার এখানে ফিরে এসে দলগুলো চলে যেতো সাব-সেক্টর টেকেরঘাট। সমন্বয় কেন্দ্রে বসে সালেহ চৌধুরী অপারেশনরত গ্রুপগুলো ও টেকেরঘাটের মধ্যে যোগাযোগ রাখতেন। প্রথমদিকে মেসেঞ্জার পাঠিয়ে, পরে ওয়ারলেসের মাধ্যমে। কিন্তু আগষ্টের আগে তখনো অফিসিয়ালী সেক্টর কার্যক্রম শুরু হয়নি- প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা আসা শুরু করেনননি , সালেহ চৌধুরী স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে দিরাই, শাল্লা ও জগন্নাথপুর থানা দখল করে নিয়েছিলেন এবং ভাটি অঞ্চলে রাজাকারদের প্রধান ঘাঁটি আজমিরীগঞ্জ আক্রমন করেছিলেন।

জুন-জুলাই মাসে টেকেরঘাট সাব-সেক্টর গঠনের পরিকল্পনাকালে  ভারতীয় কমিউনিকেশন জোন ওয়ান এর অধিনায়ক মেজর জেনারেল গুরবগ সিং গিল তাকে বলেছিলেন  থানা দখল, রাজাকারদের নিস্ক্রিয় করার মতো নিয়মিত কাজের পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপুর্ণ কাজ তাকে করতে হবে। সেটি হলো পাকিস্তান আর্মির জন্য নৌ-পথ বন্ধ করে দেয়া। ঢাকা থেকে সিলেটের সড়ক ও রেলপথ গেরিলা কার্যক্রমের জন্য পাকিস্তান আর্মির অস্ত্র, রসদ ও জনবল পরিবহনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো। তখন ভৈরব থেকে হবিগঞ্জের শেরপুর হয়ে সিলেট পর্যন্ত স্টিমার চলাচল করতো আবার হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ হয়ে একেবারে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত নদীপথ। এই দুটি পথ হয়ে উঠে পাকিস্তান আর্মির লাইফ লাইন।  

সালেহ চৌধুরী জানান- এই কাজের জন্য সাধারন মুক্তিযোদ্ধাদের বদলে বিশেষ প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদল প্রয়োজন। জেনারেল গিল আশ্বস্ত করেন, মেজর বাথ ও ক্যাপ্টেন বার্মার তত্বাবধানে বিশেষ একটি দলের প্রশিক্ষন চলছে। বাছাই করা সাহসী ও বুদ্ধিমান ছেলেদের দল, নিয়মিত প্রশিক্ষনের বাইরে এদেরকে ভারী অস্ত্র ও নৌযান ধ্বংসের কলাকৌশল শেখানো হচ্ছে।

সদরপুর, জামালগঞ্জ-সাচনার যুদ্ধ শেষ করে এই বিশেষ গেরিলা দলটি দিরাই আসে সালেহ চৌধুরীর কাছে আগষ্টের মাঝামাঝি। এই দলটিই দাস পার্টি , এই দলেরই প্রধান জগতজ্যোতি দাস নামের একুশ বছরের এক তরুন- আজমিরীগঞ্জের জলসুখা গ্রামে বাড়ি, সুনামগঞ্জ কলেজের ছাত্র, ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী।

পরবর্তী তিনমাস ধরে এই দলটি ভয়াবহ ত্রাস হয়ে উঠে এই অঞ্চলের পাক আর্মি ও রাজাকারদের কাছে। ‘টেরর দাস’ অদম্য, অপ্রতিরোধ্য। তার মাথার দাম  ঘোষনা করা হয় জীবিত অথবা মৃত।  সালেহ চৌধুরীর সমন্বয় কেন্দ্রে এই সময়ে আরো অনেকগুলো মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপও আসে, নানা অপারেশন চলতে থাকে। পাশাপাশি দাস পার্টির নৌপথ অভিযান। পাকিস্তান আর্মির রসদবাহী জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া, অস্ত্রবাহী লঞ্চ দখল, রাজাকারদের নৌকা উড়িয়ে দেয়া চলতে থাকে নদী ও হাওড়গুলোতে। এক পর্যায়ে পাকিস্তান রেডিও থেকে ঘোষনা আসে ভৈরব টু শেরপুর ও সুনামগঞ্জ নৌ পথ বিপদ সংকুল। সকল নৌ যানকে এই পথ এড়িয়ে যাবার পরামর্শ। সরকার কোন দায়-দায়িত্ব নেবে না।

দাসপার্টির ইতিবৃত্ত সন্ধানে তাই সালেহ চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ।  কয়দিন আগে সিলেটে এক অনুষ্ঠানে তিনি অতিথি হিসাবে আসলে পারিবারিক পরিচয় দিয়ে তার কাছে সময় প্রার্থনা করি। তিনিই পরামর্শ দেন ঢাকায় তার বাসায় যাবার জন্য।

তার দেয়া ঠিকানামতো আমরা যখন পৌঁছি বেলা তখন প্রায় সাড়ে দশটা। মুক্তিযুদ্ধকালে  বয়স ছিলো ছয়ত্রিশ বছর, সন্তানের জনক হয়েছেন কয়দিন আগে। সেই হিসাবে বর্তমানে সালেহ চৌধুরীর বয়স ঊনআশি বছর। শরীরের দিকে তাকালে বার্ধক্যের চিহ্ন পাওয়া যায়, হাঁটতে অসুবিধা হয় ছড়ি ব্যবহার করেন।  অবয়ব ও ভঙ্গিমায় এখনো তেজোদ্দীপ্ত, আভিজাত্য ফুটে উঠে তার শরীরি ভাষায়।

আলাপচারীতার শুরুতেই সালেহ চৌধুরী আমাদেরকে  ৫ নং সেক্টর গঠনের ইতিহাস জানান।

২৫ মার্চ রাতে ঢাকার সাথে সাথে সিলেট শহরে ও পাক আর্মির অপারেশন শুরু হয়। এর আগে সারাদিন সংগ্রাম পরিষদের অবরোধ, মিছিল-মিটিং চলছিলো। সংগ্রাম পরিষদের প্রধান নেতা ছিলেন আওয়ামী লীগের এমএনএ দেওয়ান ফরিদ গাজী। শহরের বালুচর এলাকায় থাকতেন সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত ক্যাপ্টেন মুত্তালিব। ক্যাপ্টেন মুত্তালিব আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী। এই মামলাতেই তিনি বরখাস্ত হন এবং চরম নির্যাতনের শিকার হন। আগরতলা মামলার নির্যাতনের ফলেই মানুষটা ক্ষ্যাপাটে এবং বদরাগী হয়ে উঠেন ,রাজনীতিবিদদের সাথে তার পোষাতোনা।  একটা বাইসাইকেলে চড়ে সারাদিন সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের বুঝিয়েছেন পাকিস্তান আর্মি যে কোন মুহুর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে তাই আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে আক্রমন শুরু করে দিতে হবে।

রাত বারোটার দিকে যখন পাকিস্তান আর্মি শহরে আক্রমন শুরু করে এবং আন্দোলকারী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন তখন ক্যাপ্টেন মুত্তালিব তার পিস্তল নিয়ে একা এসে দাঁড়ান টিলাগড় পয়েন্টে এমসি কলেজের দিকে। বিপরীত দিক থেকে এগিয়ে আসতে থাকে পাকিস্তান আর্মির একটা জীপ। পয়েন্টে এসে জীপটি ডান দিকে মোড় নেয়ার জন্য গতি ধীর করতেই মুত্তালিব সরাসরি গুলী করেন ড্রাইভারের উপর, ড্রাইভার নিয়ন্ত্রন হারালে তার গুলীতে নিহত হয় আরোহী অফিসারটিও। মুত্তালিব অফিসারের অস্ত্র তুলে নিয়েই উত্তর দিকে সরতে থাকেন।

এদিকে ২৮ মার্চ শহরের পশ্চিম প্রান্তে আখালিয়ায়  ইপিআর ২২ নং উইংয়ের সদর দপ্তর ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। ২৫ মার্চেই অবাঙ্গালী ইপিআররা পালিয়ে গিয়েছিলো। মোশাররফ হোসেন নামে স্থানীয় একজন বেঙ্গল রেজিমেন্টের নন কমিশন অফিসার ছুটিতে বাড়ী ছিলেন। ২৫ মার্চের পর সিদ্ধান্ত নেন ফিরে যাবেন না। মোশাররফ হোসেন আখালিয়ায় এসে বাঙ্গালী ইপিআরদের সংগঠিত করেন। সালুটিকর এয়ারপোর্টে তখন পাকিস্তান আর্মি তাদের শক্তি সমাবেশ করেছে এবং ক্ষন গননা হচ্ছে যে কোন মুহুর্তে পাক আর্মির আক্রমনের।  সন্ধার দিকে যুদ্ধ শুরু হয়, মাঝরাতে পাক আর্মির সহযোগীতায় ভারী অস্ত্রের আক্রমন শুরু হলে ইপিআর সদস্য পিছু হটতে বাধ্য হন কিন্তু পাকসেনা নিহত হয় তিনজন। এই ইপিআর যোদ্ধারাও উত্তরের ভারতীয় সীমান্তের  দিকে সরতে থাকেন।

এইসময় জাফলং চা বাগানের ব্যবস্থাপক ছিলেন নাজিম কয়েস চৌধুরী। কয়েস চৌধুরী বেসামরিক ব্যক্তিত্ব হলেও এই এলাকায় তার প্রভাব দুর্দান্ত এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে ও  যোগাযোগ ছিলো। কয়েস চৌধুরী তার বাগানের বিপুল সংখ্যক শ্রমিকদের নিয়ে দেশীয় অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সীমান্তে চলে যান এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে অস্ত্র সরবরাহের আবেদন জানান। ক্যাপ্টেন মুত্তালেবও এসময় এখানে, জাফলং  ফাঁড়ির ইপিআররাও যোগ দেন, সিলেট আখালিয়া যুদ্ধ থেকে পিছিয়ে আসা ইপিআররাও মিলিত হন। তামাবিলে তখন কয়েক হাজার মানুষের সম্মিলন।

 

আগের পর্ব সমূহের লিংক:

[প্রথম পর্ব] [দ্বিতীয় পর্ব] 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত