হাসান মোরশেদ

২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ০০:৩০

বিস্মৃতির ভস্ম থেকে জেগে উঠুক চেতনার আগুন পাখি

সময়ের হাতে নির্মিত মানুষ। অধিকাংশ মানুষ। তবু কোন কোন মানুষ সময়কে বিনির্মান করার স্পর্ধাও ধারন করেন। সেইসব সাহসী মানুষদের কেউ কেউ আবার বিস্মৃত হয়ে যান সময়ের প্রতিশোধে।

টুপাক আমারোকে তিনশো বছর ভুলে ছিলো ল্যাটিন আমেরিকা। স্পেনিশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়েছিলো টুপাক। স্পেনিয়াডর্রা ফাঁসিতে ঝুলানোর মুহুর্তে টুপাক আমারো মাতা ধরিত্রীকে স্বাক্ষী রেখে বলেছিলো- ‘আমি আবার ফিরে আসবো'।

টুপাক ফিরে এসেছিলো তিনশো বছর পরে, সিমন বলিভারের নেতৃত্বে যখন গোটা ল্যাটিন আমেরিকাজুড়ে তুমুল স্বাধীনতার যুদ্ধ তখন টুপাক আমারোর আত্মদান হয়েছিলো তাদের অনুপ্রেরণা।

পৃথিবীর দেশে দেশে সকল সময়ে, সকল মানুষের শুভবোধের পক্ষে, অসুন্দর ও অকল্যানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের গল্পটা মুলতঃ একই। এই প্রতিরোধ কখনো ফুরোয় না, শুভবোধের পক্ষে সংগ্রাম তাই একটি নিয়ত চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই স্মৃতি সংরক্ষন করতে হয়, কোন কোন সময় স্মৃতিকে পাহারা দিতে হয়, কেননা ঘাতকেরা চায় প্রতিরোধের স্মৃতি মুছে দিতে, যে সমুহ স্মৃতি থেকে জন্ম নিতে পারে নতুন প্রতিরোধের চেতনা।

এই শহর, এই মায়াবী মনোটোনাস শহর দীর্ঘ দিন বিস্মৃত থেকেছে একটি শোকার্ত দিন, তার তিনটি সন্তানের বিভৎস খুন যারা মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বীজানুবাহী ঘাতক দালালদের প্রতিরোধে ব্যারিকেড হয়ে দাঁড়িয়েছিলো মিথিক্যাল সাহসে ভর করে।

এই শহর, এই বিস্মৃতির বিমর্ষ শহর তার সন্তানের ঘাতকদের তুমুল আস্ফালন দেখে গেছে কেবল, যাদের প্রতিশোধ নেয়ার কথা ছিলো তাদের আপোষ, নিবীর্যতা, অসহায়ত্বের স্বাক্ষী হয়েছে কেবল। যেমন এই রাষ্ট্র ভুলে থেকেছিলো তার ৩০ লক্ষ সন্তানের নাম, মুছে ফেলতে চেয়েছিলো মানচিত্রে লেগে থাকা গণহত্যার দাগ।

কিন্তু মানুষ, শুভবোধের সপক্ষের মানুষ সেই আশ্চর্য্য আগুন পাখী- সহস্র বিস্মৃতির ব্যারিকেড ভেঙ্গে যে বেরিয়ে আসে, ছাইভস্ম থেকে জন্ম নেয় নতুন করে বারবার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি তাই রুদ্ধ করা যায়নি কোন ষড়যন্ত্রেই, থামানো যায়নি মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন।

এই স্বপ্নযাত্রায় প্রতিটি প্রতিরোধ ও আত্মদানের স্মৃতিই এক একটি স্মারক। প্রতিটি স্মারককে স্পষ্ট করে তুলতে হবে নিজেদের প্রয়োজনে। এই স্মারকগুলো বাতিঘর হয়ে পথ দেখাবে, চিনিয়ে দেবে প্রগতির পথে কে ভাই, কে দুশমন।

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮৮, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক ঘাতকদের প্রতিরোধ ইতিহাসের উজ্জ্বলতম দিন। না, রাজধানী ঢাকায় নয় ঘাতক জামাত শিবিরকে সর্বাত্মক প্রতিরোধের যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো শহর সিলেটে ১৯৮৮ এর শুরুতেই। একদিকে সামরিক স্টিমরোলার অপরদিকে ঘাতক দালালদের নৃশংসতায় রুখে দাঁড়িয়েছিলো শহর সিলেটের মানুষ। প্রগতিশীল ছাত্রদের হাতে গড়ে উঠা প্রতিরোধ আন্দোলন যখন সামাজিক আন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়া শুরু করেছিলো তখনই সামরিক শাসনের ছত্রছায়ায় ঘাতক জামাত শিবির চরম আঘাত হানে। একদিনে শহীদ হন তিন প্রতিরোধ যোদ্ধা মুনীর-তপন-জুয়েল।

তারপর দীর্ঘ বছর তারা বিস্মৃত, দীর্ঘ কালঘুম আমাদের। পাঁচ বছর আগে হঠাৎ করেই শহর সিলেটের কিছু তরুণ যারা মুনীর-তপন-জুয়েলের আত্মদানের সময়ে নেহাৎ শিশু ছিলো, তারা পণ করে বিস্মৃতির ভস্ম ঠেলে জাগাবেই চেতনার আগুন পাখি। মুনীর-তপন-জুয়েলের সহযোদ্ধাদের সাথে তারাই যোগাযোগ করে, সচলায়তন-আমার ব্লগ-উন্মোচনের মতো প্রগতিশীল বাংলা ব্লগগুলো সহযোগী হয়, ফেসবুকে ছড়ানো হয় বার্তা।

এবং দীর্ঘ দিন পর শহর সিলেট আবার বেঁচে উঠে। আলোর মিছিলে সারথী হয় শত মানুষ। স্মৃতি, সম্মান ও শোকে উচ্চারিত হয় শহীদদের নাম- ঘাতকদের বিচারের দাবী পুনঃ উচ্চারিত হয় প্রকাশ্যে।

২৪ সেপ্টেম্বরের আত্মদান কেবল সিলেটের নয়। এই প্রতিরোধ যুদ্ধ, তিনজন শহীদের আত্মদান একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্রের জন্য, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত বাংলাদেশের জন্য। তাই শহীদ মুনীর-তপন-জুয়েল যেনো স্মরিত হন সমগ্র দেশে। দেশের আনাচে কানাচের যে কোন অঞ্চলের শুভবোধ সম্পন্ন মানুষেরা যেনো শোকার্ত হন, যেনো প্রতিরোধের স্পৃহায় ঐক্যবদ্ধ হন।

সেপ্টেম্বর ২৪ তাই ভুলা যাবে না। বিস্মৃতির ছাইভস্মে আর ঢেকে রাখা যাবে না শহীদ মুনির, তপন, জুয়েলের আলোক প্রতীমা। জীবিত জুয়েল, মুনীর, তপন একটি রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলেন, সেই রাজনৈতিক দলের প্রতি কারো সমর্থন নাই থাকতে পারে কিন্তু শহীদ মুনীর, তপন, জুয়েল দলীয় পরিচয়ের সীমানা পেরিয়ে একটা পরিচয়েই অমর হয়ে গেছেন- মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংগ্রামের সাহসী সৈনিক তারা। রাজনীতির নামে, ব্যক্তিগত হিসেব-নিকেশে এইদিনকে ভুলে থাকা মানে ঘাতক-দালালদের জন্য আরেকটু পথ ছেড়ে দেয়া। যারা এইভাবে আত্মাবিক্রী করেছেন বা করবেন সময় তাদের গুনে নেবে নীলডূমো মাছি হিসেবেই- সে তারা আজ যতোবড় রথি-মহারথিই হোন না কেনো।

মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংগ্রামের যদি কারো সমর্থন থাকে, শুভবোধের প্রতি থাকে পক্ষপাত তবে সেপ্টেম্বর ২৪ এ শহীদদের স্মৃতিতে একটু আণত হোন, বুকের ভেতর লালটুকটুকে স্বপ্নটাকে আবার হাত বুলিয়ে প্রত্যয় নিশ্চিত করুন- 'নো পাসারানো'- মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে নুন্যতম কোন আপোষ নয়।

এ বছরও ২৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় আলোর মিছিলে মিলিত হবো আমরা সিলেটবাসীরা। দেশের আর সব অঞ্চলে কি ২৪ সেপ্টেম্বর 'মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দিবস' পালন সম্ভব নয়? আমরা সবাই দায়িত্ব নিয়ে অন্ততঃ চেষ্টাটুকু কি করতে পারিনা?

মানুষের শুভবোধের জয় হোক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত