মৌলভীবাজার প্রতিনিধি

১৫ অক্টোবর, ২০১৮ ১৮:৫২

উপমহাদেশের একমাত্র লাল দুর্গায় পূজা হচ্ছে ৩শ বছর ধরে

প্রতি বছর উপমহাদেশের কয়েক লক্ষ প্রতিমায় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন সাজে। কিন্তু উপমহাদেশের একমাত্র লাল বর্ণের দুর্গা প্রতিমায় পূজা হয় মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁওয়ে।

সিলেট ছাড়িয়ে দেশের নানা প্রান্ত এমন কি ভারত থেকেও প্রচুর ভক্ত আসেন এই পূজামণ্ডপে। পূজোর ৩ দিন কয়েক লক্ষ ভক্তের ভিড়ের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃতি ঘটে।

অষ্টমী ও নবমীর দিন হেটে যেতে হয় কয়েক কিলোমিটার। ভক্তদের ধারনা এখানে দুর্গা জাগ্রত। যে যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাড়া প্রায় ৩০০ বছর ধরে এই লাল বর্ণের দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রতি বছর।

সাধক সর্বানন্দ দাস লাল বর্ণের দুর্গাপ্রতিমায় পূজার প্রচলন করেন। এখানে দেবী ‘স্বশরীরে’ হাজির হন বলে কথিত আছে। সিলেট বিভাগের প্রতিটি উপজেলা থেকে পূজার ৩ দিনে একবার হলেও পাঁচগাঁওয়ে না আসলে যেন ভক্তদের পূজা দেখা পূর্ণতা পায় না।

মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার ও রাজনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার উত্তরে পাঁচগাঁও গ্রামে স্বর্গীয় সর্বানন্দ দাসের বাড়িতে পালিত হয়ে আসছে ব্যতিক্রম এই পূজা। প্রতি বছর পূজার সময় মহিষ বলির পাশাপাশি কয়েক শত পাঁঠা বলি দেওয়া হয় এখানে।

এলাকায় প্রচলিত আছে স্বর্গীয় সর্বানন্দ দাস আসামের শিবসাগরে মুন্সীপদে চাকরি করতেন। তিনি ছিলেন সাধক পুরুষ। একবার আসামের কামরূপ-কামাখ্যা বাড়িতে গিয়ে পূজার জন্য পাঁচ বছরের একটি মেয়ে চাইলে স্থানীয় লোকজন তাকে একটি মেয়ে দেন। সর্বানন্দ দাস সেই মেয়েকে পূজা দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে ধীরে ধীরে মেয়েটির রং বদলে লাল হয়ে ওঠে। মেয়েটির মধ্যে স্বয়ং দেবী ভর করেন।

মেয়েটি তখন সর্বানন্দ দাসকে বলে, ‘তুমি আমার কাছে বর (আশীর্বাদ) চাও। আমি তোমাকে বর (আশীর্বাদ) দিব।’ সর্বানন্দ দাস তখন তার কাছে বর (আশীর্বাদ) চাইলেন। দেবী তখন নির্দেশ দিলেন পাঁচগাঁওয়ের প্রতিমার রঙ হবে লাল। সাধক সর্বানন্দ দাস দেবীকে রাজনগরের পাঁচগাঁওয়ে যেনো দেখা দেন সেই আকুতি জানান।

সেই থেকে এখানে লাল বর্ণের মূর্তির পূজা হয়ে আসছে এবং এখানে সাধনায় প্রসন্ন হয়ে মা দুর্গা তাকে দেখা দেন। পূজার একপর্যায়ে সাধক সর্বানন্দ দাস মায়ের কাছে আকুতি জানান, তিনি (মা দুর্গা) যে এখানে এসেছেন তার প্রমাণ কী? তখন মা তার হাতের পাঁচ আঙুলের লাল ছাপ তৎকালীন নির্মিত কাচা ঘরের বেড়ায় লেপটে দেন। মায়ের মাথার স্বর্ণের টিকলি ও কানের দুল রেখে যান। সে থেকেই এখানে লাল মূর্তিতে দেবীর পূজা হয়ে আসছে।

পূজার সময় এখনো মায়ের রেখে যাওয়া গয়না পরানো হয় দেবীকে। সাধক সর্বানন্দ দাসের বংশধর সঞ্জয় দাস ১৪১৫ বঙ্গাব্দে নতুন জায়গায় মন্দির স্থাপন করলে পূর্বের সেই স্মৃতিচিহ্ন আর চোখে পড়ে না। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী মন্দিরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। মন্দির পুড়ে গেলেও গহনা অক্ষত ছিল।

ভক্তদের বিশ্বাস পাঁচগাঁও দুর্গাবাড়িতে স্বয়ং দেবী অধিষ্ঠান করেন। এটি জাগ্রত প্রতিমা। লাল বর্ণের দেবীর মূর্তি দেশের আর কোথাও নেই। যে কারণে এই প্রতিমার কাছে ভক্তদের অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা।

প্রতি বছর উৎসবমুখর পরিবেশে লাখ লাখ পূজারীরা আসেন দেশ বিদেশ থেকে। এখানে হাজার হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বী পুণ্যার্থীরা তাদের নানা মানত নিয়ে ছুটে আসেন দূরদূরান্ত থেকে। কেউ হোমযজ্ঞ দেন, কেউ প্রদীপ ও আগরবাতি জ্বালান আবার কেউ বা মহিষ, পাঠা, কবুতরসহ অন্যান্য পশু বলি দেন।

দুর্গাপূজার মণ্ডপকে ঘিরে আশেপাশের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এখানে মেলা বসে। বিভিন্ন ধর্মীয় জিনিসপত্রের ও দেবদেবীর ছবি মূর্তিসহ কয়েকশত দোকানে বেচাকেনা হয় খই, মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা, জিলাপি, মিষ্টি, বাঁশি, বেলুন, ঝুমঝুমি আরও অনেক কিছু।

এবারও প্রতিবছরের মত লাখো ভক্তের মিলন ঘটবে এখানে। তাই প্রশাসন ও পূজা উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মো. শাহজালাল জানান, পুলিশ, আনসার, র‌্যাবসহ গ্রাম পুলিশ মোতায়েন থাকবে। পাঁচগাওয়ে লাল দেবীর পূজা হওয়ায় এখানে লাখো মানুষের ঢল নামে। তাই আলাদা ব্যবস্থাসহ জেলায় শান্তিপূর্ণভাবে পূজা সম্পন্ন হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত