আনোয়ারুল হক হেলাল

০৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ২১:১৮

উন্নয়ন বনাম হাহা(কার)জীবীগণ

জীবিকার তাগিদে প্রবাসে থাকি, কিন্তু মনটা সর্বক্ষণ পড়ে থাকে বাংলাদেশে। কাজ শেষে যখন ঘরে ফিরি, টিভি চালু করে বাংলা নিউজ চ্যানেল কিংবা অনলাইন নিউজপেপার নিত্যসঙ্গী দেশের খবর নেওয়ার জন্য। দেশের দুর্ঘটনা, হতাহত ইত্যাদি খবরে যেমন মনঃক্ষুণ্ণ হই তেমনি ছোটবড় যেকোনো উন্নয়নের খবরে পুলকিত হই, আশায় বুক বাঁধি, দেশ অগ্রসর হচ্ছে। হাজার মাইল দূরে মাতৃভূমির জন্য এই আনন্দ, এই উৎকণ্ঠা, দেশের প্রতি এ গভীর অনুভূতি আমার মত প্রত্যেকটি প্রবাসীরই।

দেশে অনেকগুলো মেগা প্রজেক্টের কাজ চলছে, বাস্তবায়ন হচ্ছে আগামীর বাংলাদেশের স্বপ্ন। প্রজেক্টগুলোর মধ্যে অন্যতম পদ্মা সেতু প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর, কর্ণফুলী ট্যানেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ইত্যাদি। এইসব মেগা প্রজেক্টের পরিকল্পনা দুঃসাহসিক, এবং বিশ্বাস করি এইসব প্রজেক্ট শেষ হলে ডিজিটাল বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসোপানে নিজের পদচিহ্ন পৃথিবীর বুকে একে প্রমাণ করে দেবে আমরাও পারি।

ইতিমধ্যে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ অনেকগুলো প্রজেক্টের কাজ সমাপ্ত, আর বাকিগুলো প্রায় সমাপ্তির পথে। দীর্ঘ মেয়াদী এইসব প্রজেক্ট পরিকল্পনা য় বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার, বিশেষ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা আর সুদূর প্রসারী উন্নয়নের চিন্তারই সুস্পষ্ট প্রতিফলন। দীর্ঘ মেয়াদী একটি সরকারের নেতৃত্বে থেকে উন্নয়নের প্রশ্নে নিজ অবস্থানে শত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও অবিচল থাকা দেশ ও জনগণের প্রতি নেত্রীর দায়বদ্ধতার আর জবাবদিহিরই প্রতিফলন।

বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা নিয়ে যে শুধু আমাদের মাঝে আগ্রহ তা নয়, বিশ্ব-মিডিয়া এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তানেও প্রধান প্রচার মাধ্যমগুলোতে বড় আকারে নিউজ হচ্ছে, এবং সকল নিউজই ইতিবাচক। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি বিশ্ব মিডিয়ায় কত প্রশংসামূলক সংবাদে শিরোনাম হয়েছে তা গবেষণার বিষয়। ভারত কিংবা পাকিস্তানের রাস্তায় খোদ সেই দেশের ভিডিও ব্লগাররা বাংলাদেশের উন্নয়নের ছবি দেখিয়ে পথচারী জনগণকে জিজ্ঞাস করছেন, এটা কোন দেশ? পথচারী সাধারণ জনগণ অধিকাংশই বলতে পারছেন না, কেউ বলছেন মালয়েশিয়া, কেউ বলছেন চীন, কেউ বলছেন সিঙ্গাপুর! এসব উন্নয়ন বাংলাদেশে হয়েছে শুনে অনেকেই চোখ কপালে তুলেছেন। বিশেষ করে পাকিস্তানী জনগণের হা-হুতাশের শেষ নেই, নিজ দেশের সরকার, কর্তা ব্যক্তিদের গালাগালি করে অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশের এই উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার কারণেই। তাদের মধ্যে অনেকেই যারা বাংলাদেশ ও বিশ্বের খবর রাখেন তারা এই উন্নয়নের পুরো ক্রেডিট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই দিচ্ছেন, এবং এও বলছেন শেখ মুজিবের সুযোগ্য কন্যা, এই উন্নয়ন তাঁর দ্বারাই সম্ভব। প্রবাসে বসে এইসব ভিডিওব্লগ একজন বাংলাদেশীকে কতটা আবেগী করে তুলে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সদ্য সমাপ্ত হওয়া মেগা প্রজেক্ট এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন হয়ে গেল গত ২ সেপ্টেম্বর শনিবার। ছুটির দিন ছিল বিধায় উদ্বোধনসহ সকল নিউজই লাইভ দেখে তৃপ্তি নিয়েছি। নিউজফিড স্ক্রল করতে গিয়ে খেয়াল করলাম, হাজার হাজার লাইক আর লাভ রিঅ্যাক্ট এর ভিড়ে অসংখ্য হা-হা রিঅ্যাক্ট, মন্তব্যের অপশনে অনেকে কটু কথা লিখে রেখেছেন। দেশ যেখানে উন্নয়নের মাইলফলকে, মেগা প্রজেক্টগুলো একে একে উদ্বোধন হচ্ছে সেখানে অট্টহাসির রিঅ্যাক্ট দেওয়া এই হাস্যজীবী কারা? তারা কি আদৌ বাংলাদেশের নাগরিক!! দেশের উন্নয়নে নিয়ে খুশি হওয়ার জায়গায় তারা কেন ট্রল করছে, কটু মন্তব্য করছে!!! কেন তাদের দেশের উন্নয়ন সহ্য হচ্ছে না!!!

এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের যেতে হবে কয়েক বছর পূর্বে পদ্মা সেতু নিয়ে দেশের দুই বারের প্রাক্তন প্রধান (মতান্তরে তিনবার!) বেগম খালেদা জিয়ার একটি মন্তব্যের আলোচনায়। বেগম খালেদা জিয়া পদ্মা সেতু নিয়ে ২০১৮ সালে ছাত্রদলের এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, “পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার। কিন্তু পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। এ সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানানো হচ্ছে। এ সেতুতে কেউ উঠবেন না। অনেক রিস্ক আছে!”

দেশের একটি প্রধানদলের নেত্রী এবং দুইবারের প্রধানমন্ত্রীর মুখে এমন মন্তব্য বড়ই বেমানান। পরবর্তীতে ২০২২ সালের ২৫ জুন যখন পদ্মা সেতুর কাজ শেষে উদ্বোধন হয়, সেদিন সাড়ে তিন হাজার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, যার মধ্যে ছিলেন, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, বিভিন্নদলের প্রাক্তন ও বর্তমান রাজনীতিবিদ, সরকার ও বিরোধীদলের প্রায় সবাইকে, বাদ যায়নি বিএনপিসহ এর অঙ্গসংগঠনগুলোও। সরকারের সেতু মন্ত্রণালয়ের উপসচিব দুলাল চন্দ্র সূত্রধর বিএনপি নয়াপল্টন কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে দলের জ্যৈষ্ঠ মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর হাতে আমন্ত্রণপত্রটি সরাসরি হস্তান্তর করেন। দেশ ও বিদেশের সকল আমন্ত্রিত অতিথিরা সেদিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন, শুধু বিএনপি ছাড়া। ঐ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিএনপির পক্ষ থেকে কেউই উপস্থিত হননি। তাদের কোন প্রতিনিধিও প্রেরণ করেননি। হীনমন্যতার এখানেই শেষ নয়, গোটা দেশকে এক করা পদ্মা সেতু নিয়ে ৪৫ বছর পূর্বের স্মৃতিচারণে আবেগঘন ফেসবুক স্ট্যাটাস দেয়ায় চট্টগ্রামের আকবরশাহ থানার বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলুল হককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে তিরস্কৃত করে বিএনপি। পদ্মা সেতু নিয়ে উচ্ছ্বসিত স্ট্যাটাসটি দেয়ায় নাকি বিএনপি তৃণমূল নেতাকর্মীদের মনে আঘাত লেগেছে, তিন দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর জন্য সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়। এর আগে ও পরে পদ্মা সেতু নিয়ে বিএনপির ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজ থেকে বিভিন্ন প্রোপাগাণ্ডামুলক প্রচারণাও চালানো হয়।

দেশের উন্নয়নমূলক কাজ আওয়ামী লীগ করেছে বলে যে ধরনের গাত্রদাহ বিএনপি নেতাকর্মীদের মাঝে দেখা যাচ্ছে তা নিতান্তই হিংসাত্মক হীনমন্যতারই বহিঃপ্রকাশ। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় হওয়া এই উন্নয়ন কার্যক্রমে সাধারণ জনগণ হিসেবে বিএনপি সমর্থকরাও গর্বিত অংশীদার। কিন্তু উন্নয়নের এই গৌরবের মালা সবার গলায় হয়তো মানায় না। আওয়ামীবিরোধিতা তাদের দেশবিরোধিতার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। নিজেদের হিংসার সংক্রমণ ছড়িয়ে দিয়েছেন মাঠপর্যায়ে। দেশের একটি বিরাট জনগোষ্ঠীকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে ঘৃণার চাষ করছেন তারা সর্বত্র।

১৯৮০-৯০ এর দশকে একই সাথে সিলেটের রাজনীতি করা বাম ধারার প্রচুর ছাত্রনেতা, যারা সদর্পে কাঁপিয়েছেন যারা রাজপথ, বিএনপি প্রথমবারের মত ক্ষমতায় ইউ-টার্ন নিয়ে তাদের একটি বিশাল অংশ বিএনপিতে যোগদানের পর কেমন জানি বদলে গেলেন পলকেই। প্রগতিশীল এইসব রাজনীতিবিদের মুক্তচিন্তা একসময় যেখানে হাজারো কর্মী স্লোগান মুখরিত উত্তপ্ত রাজপথে স্বপ্ন দেখাতো একটি নতুন বাংলাদেশের, সেইসব রাজনীতিবিদ হয়ে গেলেন হীনমন্য হিংসাত্মক। হয়তো জাতীয়তাবাদী শক্তিই এমন, যার ছোঁয়ায় প্রগতিশীল মানুষগুলোও মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে যায় নিমিষেই।

পদ্মা সেতু নিয়ে তিনি ২০১২ সালে বেগম খালেদা জিয়া প্রতিজ্ঞা করেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে পদ্মা নদীর উপর দুইটি সেতু হবে, একটি মাওয়ায়, অপরটি দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া দিয়ে। দেশ ও জাতির জন্য এই ধরনের প্রতিজ্ঞা বা পরিকল্পনা খুবই খুশির সংবাদ। আজীবন আওয়ামী রাজনীতি করা ব্যক্তি আমি সাধুবাদ জানাই এই পরিকল্পনাকে, এবং কথা দিই বিএনপি যদি দুইটা পদ্মা সেতুর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে তবে নিজে ধন্যবাদ জানাবো কলাম লিখে। দুইবার ক্ষমতায় থেকে একটিও মেগা প্রজেক্ট করতে না পারা জাতীয়তাবাদী দল যদি ক্ষমতায় কোন মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে পারে তবে তার প্রশংসার ভাগীদার আমি আওয়ামী লীগকেও করবো।

উন্নয়ন যে একটি কাজ, আর এটি দেশের জন্য করতে হয় তা অন্তত বিএনপি শিখুক। অনুকরণের উন্নয়নেও যদি দেশের জনগণের উন্নয়ন হয় তবে তাই ভালো। কিন্তু বিএনপি যে পর্যায়ের মেধাহীনের দলে পরিণত হচ্ছে ক্রমাগত, হয়তো ক্ষমতায় এসে ভেবে বসতে পারে, “উন্নয়ন” আওয়ামী লীগ করেছে, আওয়ামী লীগ যা করেছে আমরা তা করি না!

ধিক্কার জানাতেও কষ্ট হয় হাহা(কার)জীবী আর্তনাদবিদদের জন্য, করুণা তোমাদের প্রতি… বাংলাদেশের উন্নয়নে যাদের গাত্রদাহ।

  • আনোয়ারুল হক হেলাল: প্রবাসী, সাবেক ছাত্রনেতা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত