ভরা বর্ষায় রেমাক্রি খালের উপচে পড়া রূপে প্রকৃতি ও জল পিয়াসী যে কোন মানুষ মুগ্ধ না হয়ে পারে না। এই খা

০৯ জুলাই, ২০১৫ ২২:৪৯

খরস্রোতা রেমাক্রি খাল

মো. মনির হোসেন

ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ধেয়ে আশা জলরাশি একটি পাথর গড়িয়ে আর একটি পাথরে কলকলিয়ে আছাড় খাচ্ছে। আর মাছেরা চোখের সামনে থেকে লম্ফ দিয়ে নিমিষেই হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। মনে হবে আপনাকে চোখ টিপ্পনি দিয়ে কেটে পড়লো বুঝি।

দু’পাশের সবুজ বন-বনানী; শুভ্রনীল আকাশ আর পাহাড় ছুঁয়ে উড়াউড়ি করা মেঘবালিকারা। আবার যখন তখন বৃষ্টি হয়ে নিচেও নেমে আসে। এ যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি। আর খরস্রোতা এই খালের সন্ধান দিয়েছিলেন আরেকজন ভ্রমণ পিপাসু মানুষ শিশির সালমান। সন্ধান পাওয়ার পর থেকেই পরিকল্পনা করতে শুরু করি কখন, কিভাবে আর কোন পথ অনুসরণ করব। অবশেষে ঠিক করলাম থানচি হয়ে রেমাক্রি যাবো।

শিডিউল অনুযায়ী নদী পরিব্রাজক দলের আরো দু’জন ভ্রমণ সঙ্গী ইলিয়াছ আর আসিফকে নিয়ে ফকিরাপুল থেকে শ্যামলী পরিবহনের গাড়িতে চড়ে রওয়ানা করলাম বান্দরবানের উদ্দেশে। ভোরে পৌঁছে গেলাম বান্দরবান শহরে। নাস্তা সেরে চলে গেলাম যেখান থেকে থানচির বাস ছাড়ে। টিকেট কেটে নিজ নিজ আসনে বসেও পড়লাম।

সিরিয়ালের প্রথম বাস আর আমাদের যাত্রা শুরু হলো থানচির উদ্দেশ্যে। রাস্তার দু’পাশে বড় বড় পাহাড়। একটার পর একটা পাহাড় উঁকি দিচ্ছে। আমরাও যাচ্ছি পাহাড়ের বুকে ভর করে। এক পাহাড় ডিঙিয়ে আরেক পাহাড়ে। রাস্তার পাশে পাতার ছাউনির নিচে আম, কাঁঠাল, কলা আর আনারসের স্তুপ। জুম চাষীদের মুখে তৃপ্তির হাসি।

 আমাদের বাহন চলছে আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে আর আমাদের অনুসরণ করে চলেছে শঙ্খ নদী। সেই সাথে জানান দিচ্ছে ‘তোমরা আমাকে ভুলে সড়ক পথে যাচ্ছো কিন্তু আমি তোমাদের ছাড়ছিনা; আমিও আছি তোমাদের সাথে’।

চিম্বুক ও বলি পাড়া এ দু’স্থানে যাত্রাবিরতি শেষে বাস আমাদের নামিয়ে দিল থানচি ব্রিজে। আর ব্রিজের নিচ থেকে শঙ্খ বলছে আমিও আছি। হেঁটে গেলাম থানচি বাজারে। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা। বসে পড়লাম মামুনের হোটেলে। মামুন সামনে এনে দিল জুম চালের ভাত, আইঁড় মাছ, ডাল, ছোটো ছোটো সাদা রংয়ের কাঁচা মরিচ। পাহাড়ী কাঁচা মরিচ আর আঁইড় মাছ; আহ! কী স্বাদ যে লেগেছিল বর্ণনায় বুঝাতে পারবো না।

৭ ফালি মাছ আর গোটা বিশেক মরিচ সাবাড় করে দিলাম। আর আসিফ ভাত-মাছ এর স্বাদকে জলাঞ্জলি দিয়ে ভক্ষণ করলো ৩০টি পাহাড়ী বাংলা কলা। তারপর মামুনের সহযোগিতায় গাইড আর ট্রলার নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম রেমাক্রি খালের উদ্দেশ্যে। নৌকায় আমাদের সাথে যুক্ত হলো গাইড, মাঝি আর তার সহযোগী। নৌকা চলতে লাগলো আঁকাবাঁকা শঙ্খ নদীর বুক চিরে। হঠাৎ সামনে দেখা গেল বিশাল এলাকাজুড়ে বিছানার মতো ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট পাথর। গাইড জানালো এই এলাকার নাম ছোটো পাথর। তারপর ধীরে ধীরে সামনে আসতে থাকলো বড় পাথর এবং রাজা পাথর। আর পাথর ঠেলে আমরা চলে আসলাম ভূ-স্বর্গ তিন্দুতে।


তিন্দু অতিক্রম করার বেশ কিছুক্ষণের পর গাইড বলতে শুরু করলো ঐ যে, রেমাক্রি খুম। মারমা ভাষায় জলপ্রপাতকে খুম বলে। আমরা চলে আসলাম রেমাক্রি জলপ্রপাতে। যেখান থেকে ৪-৫টি স্তরে ধারাবাহিকভাবে পানির  স্রোত অবশেষে যুক্ত হচ্ছে শঙ্খ নদীতে। আমরা রেমাক্রি খালে নামলাম।  স্রোতের তোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা দায়। আর এ স্রোতের সাথে পাঞ্জা লড়ে আমরা যাচ্ছি সামনের দিকে।

যেতে যেতে কখন যে ২ কি.মি. মতো পথ অতিক্রম করে ফেলেছি বুঝতেই পারিনি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে তাই রাত্রি যাপনের উদ্দেশ্যে ফিরে চলা। রেমাক্রি বাজারে সুন্দর একটি গেস্ট হাউজ পেলাম। ঠিক রেমাক্রি খালের পাশেই। যেখান থেকে রেমাক্রি খুমের জল পড়ার কলকল ধ্বনি খুব উচ্চস্বরে শোনা যাচ্ছে।


রাতের বেলায় খাবার হিসেবে পেলাম পাহাড়ী দেশী মোরগ। খেতে খেতে গল্প চললো গেস্ট হাউজের মালিক মে প্রো মারমার সঙ্গে। তিনি ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার পদে নির্বাচনও করেছিলেন। খুবই দায়িত্ব ও অধিকার সচেতন একজন নারী। নিজে লেখাপড়া করতে পারেননি ঠিকই কিন্তু তার চার ছেলে মেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। ছোট ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে ঢাকার সাভারে, একমাত্র মেয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে থানচিতে, মেঝো ছেলে এ বৎসর উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছে চট্টগ্রাম শহরে থেকে। আর বড় ছেলে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন সাথে ব্যাচেলর করছেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই সঙ্গে পাড়ার সবাইকে লেখাপড়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছেন। এ যেন পাহাড়ে আলোর ঝলকানি।

গল্পে গল্পে রাত গভীর হয়ে আসছে। কিন্তু মে প্রো মারমার গল্প শেষ হচ্ছে না। আমাদেরও শুনতে ভাল লাগছিল। অনেক পাহাড়ী জনপদে গিয়েছি, আতিথেয়তাও পেয়েছি, কিন্তু রেমাক্রি পাড়ার মে প্রো মারমার মত আন্তরিকভাবে কেউ কাছে টানেনি। যতদিন বেঁচে থাকবো, মনে থাকবে মে প্রো মারমা ও তার পরিবারকে। অবশেষে মনের বিরুদ্ধেই ঘুমুতে যাওয়া। কারণ সকাল হলেই বান্দরবান শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে হবে।


বিকেলে অতিথিপরায়ণ বন্ধু আরমান চৌধুরী ও হাবিবুর রহমানের পূর্ব আমন্ত্রণে উপস্থিত হলাম বান্দরবান জেলা পরিষদ মিলনায়তনে। উপভোগ করলাম আদিবাসী বন্ধুদের পরিবেশনায় নৃত্য। পাহাড়ী ঐতিহ্যের বিভিন্ন নৃত্যের তালে শুধু মুগ্ধ নয় বুঁদ হয়ে রইলাম। আর এই নৃত্যের আমেজ মননে নিয়ে এবারের মত বাড়ি ফেরা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত