আল আমিন হোসেন মৃধা

০৬ এপ্রিল, ২০১৭ ০৩:০০

যে দেশে ধনি হওয়া সহজ, গরীব হওয়া কঠিন!

সময়টা ২০০৫, ছোট ভাই শিপন নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান বয়স মাত্র সাত স্বপ্ন মোটরবাইক কিনবে সারাদিন বাইক চালিয়ে বেড়াবে এভাবেই মনের ভেতর স্বপ্ন বুনতে বুনতে দিন শেষে ঘুমাতে গেল মাটির তৈরি টিনের চালা বেষ্টিত ঘরের এক কোনায় ছোট্ট একটি চৌকির উপর। নিচু চৌকি হওয়ায় উঁচু করার জন্য কয়েকটা ইট দেয়া। সারাদিন কল্পিত স্বপ্ন ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো। শুরু হল ঘুমের মধ্য তার কল্পিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন যথারীতি বাইক কিনে স্টার্ট করতে লাগলো পা উঁচিয়ে মুখে শব্দ করে ভো-ভো-ভো! মুহূর্তের মধ্যেই চৌকির নিচে পড়ে গেল সে; চোখটা পড়লো ইটের উপর। নেয়া হলো উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে!

"যেখানে আপনার একটা স্বপ্ন আছে" স্লোগান সংবলিত পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের হাজারো স্বপ্ন দেখানো মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে গরীব হওয়াটাই সবচেয়ে কঠিন, ধনী হওয়া সবচেয়ে সহজ শত চেষ্টা করেও তিনি গরীব হতে পারেন নাই। মন্ত্রীর এহেন কথায় অতি সহজে ধনী হবার স্বপ্ন দেখতে যারা শুরু করেছে উপরের গল্পটা তাদের উদ্দেশ্য।

প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার (০৪ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর শেরে বাংলানগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, "পৃথিবীতে ধনী হওয়া সবচেয়ে সহজ। ৮৫ বছর পরে দূরবীন দিয়ে দেশে গরিব মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর সবচেয়ে কঠিন কাজ গরিব হওয়া। আমিও গরিব হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম, পারি নাই।"

তিনি জোরগলাই পুনরায় বলেন, "একমাত্র ধনী হওয়া পৃথিবীতে সহজ কাজ।" তিনি বলেন, "বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে অন্যতম ব্যবসা-বান্ধব দেশ। এখানে ইচ্ছা করলেই জমিসহ কারখানার মালিক হওয়া যায়। অথচ পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে জমির মালিক হওয়া যায় না। সব কিছুই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য লিজ নিয়ে করতে হয়। ব্যবসার সব বিষয়ে বাংলাদেশে নিরাপত্তা ভালো।"

আমাদের এই বাংলাদেশে কত সহজে ধনী হওয়া যায়, কত সহজ সম্পদের মালিক হওয়া যায়, কত সুন্দর ব্যবসা বান্ধব এদেশ, এত সহজে পৃথিবীর কোথায় জমির কারখানার মালিক হওয়া যায় না। মহান মুক্তিযুদ্ধে এরকম প্রত্যাশাই তো আমাদের ছিল সবাই সমান থাকবো, দেশের জনগণ থাকবে সবকিছুর মালিক, কেউ গরীব থাকব না (অর্থাৎ কেউ খাব, কেউ খাব না; তা হবে না) জমি কল-কারখানার মালিক হবে জনগণ।

মাননীয় মন্ত্রী সাহেব ভুল বলেন নাই- এ দেশে সহজে ধনি হওয়া যায়, সহজে সম্পদের মালিক হওয়া যায়, সহজে ব্যবসা করে কোটিপতি হওয়া যায় এখানে গরীব হওয়াটা বড্ড কঠিন (যা মন্ত্রী সাহেবও পারেন নাই)। কারণ এই সহজে মালিক হবার সুযোগটা মন্ত্রীদের, সহজ কোটিপতি হবার সুযোগটা শুধু আমলাদের গুটিকয়েক লেজুড়বৃত্তি করা মালিকের। হাজার মানুষের পুঁজি খুইয়ে কত সহজে শেয়ার বাজার থেকে শত শত কোটি টাকা লোপাট করে সুইস ব্যাংকে রাখার সুযোগ এটা শুধু যে আপনাদের!

সোনালি ব্যাংকের (হলমার্ক কেলেঙ্কারি) ৪০০০ কোটি টাকা লুটপাট আপনাদের কাছে সামান্য টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ সহ অসংখ্য লুটপাট। ফ্লাইওভার নির্মাণে বিশ্বে যেখানে প্রতি কি.মি. ৪০-৬০ কোটি বাংলাদেশে ২১০ কোটি, মহাসড়ক নির্মাণে বিশ্বে প্রতি কি.মি. ১৫-২৮ কোটি এদেশে ৫৯ কোটি (ঢাকা-মাওয়া ৯৫ কোটি) রেলপথ নির্মাণে বিশ্বের আদর্শ ব্যয় প্রতি কি.মি. ২৩-২৮ কোটি বাংলাদেশে সেখানে ২০০-২৫০ কোটি এখান থেকেও হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট। মালিক হওয়া এখানে কত সহজ। এদেশে সর্বোচ্চ ট্যাক্স দেন জর্দা ব্যবসায়ী কাউস মিয়া আর বিশ্ব সেরা ধনি হন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।

গত ৩০ মার্চ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ঢাকার শেরেবাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কেন্দ্রে এনজিও প্রতিনিধিদের সাথে প্রাক-বাজেটে উচ্চ শিক্ষায় টিউশন ফি পাঁচ গুণ বৃদ্ধির কথা বলেছেন। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, “উচ্চ শিক্ষায় অর্থাৎ সরকারি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজসহ স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি পাঁচ গুণ বৃদ্ধি করা হবে, দেখি কি হয়।”

এদেশে শিক্ষা বাজেটে টাকা নাই (এ জন্য ফি বৃদ্ধি) তবে অস্ত্র কেনার টাকা আছে!

গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা আছে বলেই দেশের উন্নয়ন হচ্ছে : প্রধানমন্ত্রী (গত ৯ মার্চ সংসদে বক্তব্যে)। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে কোনও প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেল ছিল না। আমরাই প্রথম বেসরকারি খাতে প্রাইভেট টেলিভিশন উন্মুক্ত করে দিয়েছি বলেই তারা (সমালোচক) এতো কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন। দেশে গণতন্ত্র আছে বলেই তো উন্নয়ন হচ্ছে। আজকে আমরা গণতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে সরকার পরিচালনা করছি বলেই তো দেশের উন্নয়নটা হচ্ছে। আপনারা রাস্তায় যানজটের কথা বলেন; উন্নয়ন না হলে এতো গাড়ি আসলো কোথা থেকে?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ স্নাতকধারী তরুণের বেকারত্বের হাহাকার, রাস্তার পাশে খোলা আকাশের নিচে শত শত মানুষের বসবাস, হাজার হাজার পথশিশু, পানিবিহীন উত্তরবঙ্গের কৃষি জমি পরিণত হচ্ছে মরুভূমিতে।

উন্নয়নের জোয়ারে এগুলো আপনাদের চোখে পড়বে না। আমরা চাই অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কাজ আর আপনার কিনেন অস্ত্র। আমরা যুদ্ধ নয় শান্তি চাই আমরা অস্ত্র নয় বেঁচে থাকার ন্যুনতম হলেই অধিকার চাই।

গৌরীশংকর বলেছিলেন "আমি যাহা বুঝি না, তাহা শিখাইতে গেলে কেবল কপটতা শেখানো হইবে"। ঠিক তাই, যারা লুটপাট আর ক্ষমতা ছাড়া কিছু বোঝে না তাদের কাছে এগুলো তুলে ধরা আর কপটতা শেখানো ছাড়া কিছু না।

  • আল আমিন হোসেন মৃধা: সভাপতি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ঢাকা কলেজ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত