মাসকাওয়াথ আহসান

২২ জানুয়ারি, ২০১৮ ১১:৫৫

চেয়ার নিয়ে বচসা সুবুদ্ধিপ্রসূত নয়

ভারতের বর্ষীয়ান রাজনীতিক প্রণব মুখার্জী বাংলাদেশ সফরে এসে ভারতীয় দূতাবাসের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সেখানে রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ নানাজগতের মানুষ তাঁর সঙ্গে ছবি তোলেন। এই ফটোসেশান ছিলো দীর্ঘ। নানা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে অনেকে তাঁর সঙ্গে ছবি তুলতে এসেছেন, ছবি তুলে চলে গেছেন। কিন্তু মি মুখার্জীকে দীর্ঘ সময়ের জন্য স্টেজে থাকতে হয়েছে; সবগুলো গ্রুপের সঙ্গে ছবি তুলে তবেই স্টেজ থেকে নেমেছেন।

বয়স্ক এই মানুষটিকে তাই বসার জন্য একটি চেয়ার দেয়া হয়েছে। অন্য যে বয়স্ক মানুষেরা তাঁর সঙ্গে ছবি তুলেছেন; তাঁরা এসে ছবি তুলে চলে গেছেন।

এই ছবিগুলোতে কেন প্রণব মুখার্জী বসে; অন্যরা দাঁড়িয়ে; তা নিয়ে ৭২ ঘণ্টা আলোচনা করেছে নানামহল। সমালোচনার মুখে ভারতীয় দূতাবাস তাদের ফেসবুক পেজ থেকে এ ছবি অপসারণের পরেও আলোচনা থামেনি।

গোটা পৃথিবীতেই অতিথি বিশেষ মর্যাদা পান। আর বাংলাদেশের মানুষের অতিথিপরায়ণতার গুণটি অত্যন্ত প্রশংসিত। একজন প্রবীণ অতিথিকে নিয়ে এরকম অনভিপ্রেত ও তিক্ত আলোচনা বাংলাদেশের প্রচলিত সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না।

এখানে আরও উল্লেখ্য যে, মি মুখার্জীর স্ত্রী বাংলাদেশের মেয়ে। বাংলাদেশের বিজন গ্রামেও মেয়েজামাই এলে তাকে সর্বোচ্চ সম্মান দেয়া হয়। যারা মি মুখার্জীর চেয়ারে বসা ছবি নিয়ে দীর্ঘ বচসা করছেন; তারা নিজের বোনের জামাই বা মেয়ের জামাইকে সর্বোচ্চ সম্মান দিতে অভ্যস্ত।

কাজেই ব্যক্তিগত একটি সম্পর্কের সুতো মি মুখার্জীর সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে; এটা জানার পরেও এই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে লেবু কচলে তেতো করাটা সুবুদ্ধিপ্রসূত হয়নি। অতিরাজনীতিকতা আজকের সমাজে মনোবিভ্রম তৈরি করছে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের সৌন্দর্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এগুলো পরম স্নেহে লালন করার বিষয়। আর কাউকে সম্মানিত করতে জানলে মানুষ নিজেও সম্মানিত হয়।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সঙ্গে নানাবিষয়ে মতবিরোধ থাকতে পারে। ঠিক যেসব বিষয়ে মতবিরোধ; সেগুলো স্পষ্ট করে আলোচনা করলে ভারতের বুঝতে সুবিধা হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু ভারত থেকে আগত অতিথিকে নিয়ে তিক্ততা তৈরি একেবারেই কাঙ্ক্ষিত নয়। ঠারে-ঠুরে মানুষকে অপমান করার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত নিজের জন্য অসম্মানই বয়ে আনে।

অবশ্য চেয়ার নিয়ে দক্ষিণ এশীয় সমাজে একটি স্পর্শকাতর অনুভূতি বা সেন্টিমেন্ট কাজ করে। পিছে একটা ব্যানার লাগিয়ে চেয়ার-টেবিল পেতে সভা করাটা দক্ষিণ এশীয়দের "অনার"-এর প্রতীক। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে যে কোন অনুষ্ঠানে চেয়ারের সামনের সারিতে বসাকে স্টেইটাস সিম্বল বলে মনে করা যায়। ফলে সেখানে বসা নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকে, থাকে মান-অভিমানের পালা। অনেক জায়গায় মঞ্চের চেয়ারে বিপুল সংখ্যক সম্মানাকাংক্ষী ব্যক্তিকে বসতে দিতে গিয়ে চেয়ার-টেবিলসহ মঞ্চ ভেঙে পড়ার উপক্রমও হয়।

অপেক্ষাকৃত উন্নত ও সভ্য দেশের অনুষ্ঠানগুলোতে চেয়ার-টেবিলের এতো গুরুত্ব চোখে পড়ে না। যেহেতু সভ্যতা মানেই মানসিক সাম্য; কাজেই চেয়ারে বসা নিয়ে কেউ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত নয়। দক্ষিণ এশীয় "অনার" কনসেপ্টটি খুব অপরিচিত সভ্য জগতে। হয়তো দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি প্রজন্ম খুব করে চেয়ারে বসে নিলে চিন্তার জগত থেকে এই "অনার" বা চেয়ারানুভূতির জগদ্দল পাথর সরে যাবে। সেই আলোকিত দিনের প্রত্যাশায় রইলাম।

  • মাসকাওয়াথ আহসান: সাংবাদিক, সাহিত্যিক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত