মাসকাওয়াথ আহসান

২৩ মার্চ, ২০১৮ ২২:০২

প্রসঙ্গ: কোটা-ব্যবস্থা

সরকারি চাকরিতে কোটা-ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে কোটা সুবিধা প্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর।

যুক্তরাষ্ট্রে যেহেতু আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ, নির্বিচারে হত্যার মতো নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডের স্বীকার হতে হয়েছিলো; তাই তাদের নিয়মিতভাবে অর্থ সাহায্য ও সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সুবিধা দিয়ে শাসকগোষ্ঠীর পাপ-স্খলনের চেষ্টা করা হয়েছিলো। নির্দিষ্ট কিছু বছরের জন্য এরকম সুবিধা থাকা যৌক্তিক। কিন্তু বিষয়টি চিরস্থায়ী হয়ে দাঁড়ালে রেড ইন্ডিয়ানদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে আত্মনির্ভর উন্নয়ন কৌশল অর্জনের আর কোন প্রচেষ্টা রইলো না। আজকের যুক্তরাষ্ট্রে রেড ইন্ডিয়ান তারুণ্যের মধ্যে অলস জীবন যাপন ও মাদকাসক্তির প্রবণতা ভয়াবহ। একই ধরণের ঘটনা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী কোটার সুবিধাপ্রাপ্তদের মাঝেও ঘটেছে।

এরকম কেসস্টাডি দেখে মনে হয়, ক্ষতিগ্রস্ত ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরিতে কোটা-ব্যবস্থা না রেখে; বরং তাদের রাষ্ট্রীয় খরচে পড়ালেখা করার সুযোগ করে দেয়াই তাদের উন্নয়নের মূলধারায় নিয়ে আসার কার্যকর পথ।

চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রটি হওয়া উচিত উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার। সেখানে কোটা-ব্যবস্থা রাখা বাস্তবসম্মত ভাবনা নয়। সরকারি চাকরি যারা করেন; তাদের কাজ হচ্ছে জনগণকে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে সেবা দেয়া। যে প্রার্থীর ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা রয়েছে; তাকেই ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োগ করা যৌক্তিক। যে সবচেয়ে ভালো ফুটবল বা ক্রিকেট খেলে; তাকে যেমন যোগ্যতার ভিত্তিতে জাতীয় দলে নেয়া হয়; রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় কর্মী নিয়োগের ব্যাপারটি ঠিক একই রকম; বরং এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ; কারণ এদের দক্ষতার ওপর জনগণের প্রতিদিনের জীবন-মৃত্যু নির্ভরশীল।

বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকেই মুক্তিযোদ্ধা, আদিবাসী, নারী, জেলা কোটা প্রচলিত রয়েছে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে। ৪৭ বছর যথেষ্ট সময় সবাইকে উন্নয়নের মূলধারায় নিয়ে আসার জন্য। অনির্দিষ্টকালের জন্য কোটা সুবিধা বহাল রাখলে কোটা সুবিধাপ্রাপ্ত সমাজই চিরস্থায়ী ক্ষতির মুখোমুখি হবে। টেকসই জীবন কুশলতা হারিয়ে ফেলবে " চাকরিতে কোটা" সুবিধাপ্রাপ্ত সমাজগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের রেড-ইন্ডিয়ানদের ক্ষেত্রে ঠিক যেমনটা হয়েছে। বাংলাদেশে চাকরিতে কোটা সুবিধা প্রাপ্ত সমাজের চাকরির পরিবর্তে তাদের শিশুদের বিনাখরচে পড়ালেখার ব্যবস্থা করলে শ্রেয়তর ফলাফল পাওয়া সম্ভব।

এক্ষেত্রে সরকার আবেগ ও জেদের বশবর্তী হয়ে চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা চালু রাখলে; কোটা সুবিধার বাইরের বিপুল সংখ্যক তরুণ-তরুণী যে কোন ভাবে দেশের বাইরে চলে যেতে চেষ্টা করবে। কেউ পড়তে যাবে; কেউ শ্রমিক হিসেবেই বাইরে চলে যাবে। ব্যক্তিগত জীবনে তারা লাভবানই হবে; কারণ দেশ থেকে বের হলেই তারা বুঝতে পারবে পৃথিবীটা অনেক বড়। তারা যে চাকরিতে প্রবেশের জন্য জীবন পুড়িয়ে ফেলছিলো; তার চেয়ে অনেক বেশি কাজের সুযোগ ও পরিবেশ গোটা পৃথিবীতে রয়েছে।

আমাদের পশ্চাৎপদ সমাজে শ্রমিক হওয়া বা কায়িক পরিশ্রম দেয়াকে খুব ছোট করে দেখা হয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া বা ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে আর কোথাও এসব নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। ফলে বাংলাদেশের মানুষ পৃথিবীর যেখানেই গেছে তাদের ভাগ্য বদলেছে। গোটা-পৃথিবীর মানুষ জানে, বাংলাদেশের মানুষ কঠোর পরিশ্রমী ও প্রতিভাসম্পন্ন। কাজেই প্রতিশ্রুতিশীল তারুণ্যের জন্য জগত জুড়ে অপেক্ষা করছে "বাঁচার মত বাঁচার" আহবান।

  • মাসকাওয়াথ আহসান: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত