আরিফ জেবতিক

২৪ মার্চ, ২০১৮ ০০:৫৯

অপরাজিতা সংগীতা আর রাজপথে কিছু কাক

অপরাজিতা সংগীতার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল এক গভীর রাতে। আমার এক বন্ধুর বিয়েতে অনেক খাবার বেঁচে যায়। প্রায় ৩/৪শ লোকের খাবার। এত খাবারের কী করা হবে? তখন অপরাজিতা সংগীতার ফোন নাম্বারটি আমি পাই। এরা একটি সুন্দর স্বেচ্ছাসেবা দেয়। বিয়ে বাড়ি থেকে বেঁচে যাওয়া খাবার নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত তাঁরা পথে পথে, অলি-গলি-বস্তিতে ছিন্নমূল মানুষের মাঝে এই খাবারগুলো বিলিয়ে দেয়।

বলা যত সহজ, কাজ ততই কঠিন। ভাদ্রের ভ্যাপসা গরমের রাত দুটো-তিনটে পর্যন্ত সেই খাবারগুলো মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে দেয়া সহজ বিষয় নয়। সংগীতারা সেই কাজটি ভালোবেসে করে। একটুও স্বীকৃতির লোভ নেই, সেলফি দেয়ার আগ্রহ নেই-তাঁরা সবাই মিলে শুধু ছিন্নমূল মানুষকে খাবার দিতে থাকে। তাঁদের ঘামে ভিজে জবজব হওয়া শরীর, ঘুমহীন ক্লান্ত চোখ আর বড় বড় হাঁড়িপাতিলগুলো টানাটানি করা কালিমাখা কাপড়চোপড় নিয়েও তাঁরা সে রাতে অনেক সুন্দর, অনেক চমৎকার মানুষ হিসেবে ধরা দেয় আমার চোখে।

এরা তেজি মানুষ, এরা সাহসী মানুষ। আবার একই সাথে এরা একেবারেই সহজসরল আমার আপনার মতোই সাধারণ মানুষ। এদের তেমন কোনো বড় সংগঠন নেই, ট্রেড ইউনিয়ন নেই-এদের আসলে বুক ভরা সাহস আর ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই নেই।

সংগীতার সাথে শেষবার দেখা হয়েছে সপ্তাহ দুয়েক আগে। মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের উপর হামলার প্রতিবাদে তাৎক্ষনিকভাবে শাহবাগ থেকে যে মশাল মিছিল বের হয়, সেখানে আমার ঠিক পাশে-কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, মশালের দীপ্তিতে তাঁর সাহসী মুখ নিয়ে হেটে যাওয়া মানুষটিই সংগীতা। বয়েসের তুলনায় সাহস অনেক বেশি। মানুষের বিপদে আপদে সাহস নিয়ে পাশে দাঁড়ানোর সাহসেই তাঁরা অপরাজিতা।

সেই সংগীতার বিরুদ্ধে গোপনে মামলা করেছে আমাদের মিডিয়া সেলিব্রেটি গাজী রাকায়েত। ঘটনা খুব সিম্পল। গাজী রাকায়েতের আইডি থেকে একজন মেয়েকে গভীর রাতে অশ্লীল প্রস্তাব দেয়া হয়। সেই মেয়েটি একটি ক্লোজড মেয়েদের গ্রুপে স্ক্রিনশটগুলো শেয়ার করেন। সেখান থেকে নিয়ে অপরাজিতা সংগীতা তাঁর ফেসবুক প্রোফাইলে দিয়ে ঘটনার বিচার দাবি করে। মিডিয়ায় গাজী রাকায়েত তখন উদ্ভট সব যুক্তি হাজির করেন। কখনো বলেন যে তার আইডি কয়েকজন মিলে চালায়, কখনো বলেন যে তার কাজের ছেলে আইডি চালায়, কখনো বলেন যে তার আইডিটি হ্যাক হয়ে গেছে। পুরো গোলমেলে ব্যাপার। তবে পাশাপাশি গাজী রাকায়েত এবং তাঁর প্রভাবশালী বন্ধুবান্ধবরা তখন সংগীতাকে বলেন যে বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে, আপাতত যেন সে গাজী রাকায়েতকে নির্দোষ ধরে নিয়ে স্ক্রিনশটগুলো হাইড করে।

সংগীতা বিষয়টি মেনে নেয়। সে জানায় আগামী কয়েকদিনের মধ্যে যদি বিষয়টি তদন্ত করে সুরাহা না হয়, তাহলে সে আবার স্ক্রিনশটগুলো পাবলিশ করবে।

কাপুরুষের মতো ঘটনাটা ঘটে তার পরেই। গাজী রাকায়েত সাহেব কাউকে কিছু না বলে নীরবে গিয়ে সংগীতার বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করে বসেন! পুলিশ সংগীতাকে খুঁজতে শুরু করার পর গত সোমবার রাতে বিষয়টি জানাজানি হয়। মঙ্গলবার বিভিন্ন সূত্রে জেনেছি যে সংগীতাকে দেখে নেয়া হবে-এই ক্ষমতার দম্ভে নাকি আকাশ বাতাস প্রকম্পিত।

কথা হচ্ছে, হুট করে সংগীতার বিরুদ্ধে মামলা কেন? সে তো সরাসরি স্ক্রিনশট বের করেনি-শেয়ার করেছে, তবে কেন তাঁকে চুপ করিয়ে দেয়ার এই চেষ্টা?

কারণ খুব সিম্পল। অনলাইনে অফলাইনে আমার আপনার মতো সাধারণ মানুষ অনেক ধরনের হয়রানির মধ্য দিয়ে যায়। সবার কথা বলার সাহস থাকে না। তাঁদের পক্ষ হয়ে সাহস নিয়ে কথা বলে সংগীতার মতো মানুষেরাই। তাঁরা স্টার নয়, স্টার হতেও চায় না- কিন্তু কারো এসব বিপদ আপদে তাঁরা সাহস দেয়, হাত ধরে, বুক দিয়ে আলগায়।

আজ সংগীতাদেরকে যদি চুপ করিয়ে দেয়া যায়, তাহলে এসব তথাকথিত ক্ষমতাধরদের উল্লাস চলতেই থাকবে।

কাল আমি আপনি বিপদে পড়লে আমাদের মতো আরেকজন মানুষ আপনার আমার হাতটা ধরতে ভয় পাবে।

সংগীতার বিরুদ্ধে মামলা, সংগীতাকে পুলিশ দিয়ে হেনস্থা করার প্রয়াস সাধারণ মানুষকে চুপ করিয়ে দেয়ারই চেষ্টা।

একে এখনই রুখে দিতে হবে।

আমরা লড়ব। আমরা অনলাইনে লড়ব, রাস্তায় লড়ব, আদালতে লড়ব। আমরা দেখতে চাই, ক্ষমতার দাপট বড় না সাধারণ মানুষদের শক্তি বড়।

আজ সংগীতার পাশে না দাঁড়ালে কাল আরেক সংগীতা এসে আমার আপনার মতো মানুষের পাশে দাঁড়াবে না। আমাদের সংগঠন নেই, টাকার জোর নেই, মিডিয়ার রথিমহারথিদের সাথে পরিচয় নেই।

আমাদের আছিই শুধু আমরা। আপনার জন্য আমি, আমার জন্য আপনি।

আমরা তারকা খচিত বড় কিছু নই। আমরা ক্ষমতার দম্ভে ভরা পাখিরাজ ময়ূর নই।

আমরা এলেবেলে সাধারণ পাখি, আমরা রাজপথে খাবার বিলি করে বেড়ানো অচ্ছুৎ কাক।

কিন্তু আমাদের ভালোবাসা আছে। এক কাক বিপদে পড়লে হাজার হাজার কাক তাকে ঘিরে কাঁদতে থাকে।

সুন্দর ময়ূরের পেখমপুচ্ছ, নিষ্ঠুর ঈগলদের ঠোঁটের বিরুদ্ধে আসুন তবে কাকের মতো একসাথে দাঁড়াই।

'আপনার জন্য আমি, আমার জন্য আপনি' - একথায় যদি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস থাকে, তবে আসুন আমরা সংগীতাকে ঘিরে সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে থাকি।

  • আরিফ জেবতিক: লেখক, অনলাইন এক্টিভিস্ট।
  • [ফেসবুক থেকে]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত