সাব্বির খান

০৯ আগস্ট, ২০১৮ ২১:২৫

আইন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কতদূর?

গত ৯ মে দৈনিক আমাদের সময়ের একটা রিপোর্টে দেখেছিলাম যার শিরোনাম ছিল, ‌“প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বরখাস্ত হতে পারেন”। খবরটা প্রকাশের পরে দেখলাম, ফেসবুক উত্তাল!

অনলাইনে যে যেভাবে পারছে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজের নৈতিকতা নিয়ে লিখছে। কোনো ধরনের বিচার ছাড়াই তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলানোর প্রবণতাও সেখানে দেখেছিলাম! তখন ট্রাইব্যুনালের একজন বিজ্ঞ প্রসিকিউটরকে দেখেছিলাম বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সাথে ইন্টারভিউ দিচ্ছিলেন। বিস্ময়ে খেয়াল করলাম, তিনি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রসিকিউটার তুরিন আফরোজকে দায়ী করে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। তিনি নিজেও তুরিনের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সেদিন বলেছিলেন-

১) ট্রাইব্যুনাল আইনে প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ কোনো আসামির সাথে সাক্ষাত করতে পারেন না। তুরিন একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) এবং পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মুহাম্মদ ওয়াহিদুল হকের সাথে গোপনে দেখা করেছেন, যা ১৯৭৩ সালের ট্রাইব্যুনাল আইনের পরিপন্থী। তুরিন আইন ভঙ্গ করেছেন, যা সাজার যোগ্য।

২) মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তুরিন আসামির হাতে মামলার নথিপত্র হস্তান্তর করেছেন।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের ভেতর থেকে একজন সিনিয়র প্রসিকিউটর আর একজন প্রসিকিউটরের বিরুদ্ধে অন-ক্যামেরায় যে ভাষায় সেদিন কথা বলছিলেন, তা অবিশ্বাস করার কোনো উপায় আমার বা দেশবাসীর কারোরই ছিল না। নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে সেদিন আমিও "তুরিনের বিচার চেয়েছিলাম" এবং ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম! তখন আইনমন্ত্রী বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তদন্তের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই থেকে শ্বাসরুদ্ধর অবস্থায় জাতি অপেক্ষা করছে তদন্তের রিপোর্ট শোনার জন্য।

আমি নিজেও উৎসুক হই অভিযোগটির ব্যাপারে। সব শুনে বুঝলাম, আসামি মুহাম্মদ ওয়াহিদুল হকের সাথে তুরিনের সাক্ষাতের প্রায় তিন ঘণ্টার একটা অডিও টেপই মূলত সব অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দু এবং একমাত্র আলামত। অভিযোগ অনুযায়ী সেই টেপেই তুরিনকে মোটা অংকের টাকা চাইতে শোনা গিয়েছে বলে দাবি করেছিলেন ট্রাইব্যুনালের একজন প্রসিকিউটর। এছাড়া অন্য কোনো আলামতের কথা জানা যায়নি যা ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে অভিযুক্ত করতে পারে।

আমি চেষ্টা করি অডিওটি শোনার। অনেক চেষ্টা করে শেষমেশ এক সাংবাদিক বন্ধুর সহযোগিতায় রেকর্ডটি শোনার সুযোগ পাই। শোনার পরে আমার প্রতিক্রিয়া-

১. সেই টেপে কোনো ধরনের টাকা-পয়সা লেনদেনের কথা আমি শুনিনি বা সেই রেকর্ডে টাকা-পয়সা লেনদেন বিষয়ে কোনো কথা ছিল না, যা প্রমাণ করে যে প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ আসামির কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা চেয়েছিলেন বা নিয়েছেন। একই সাথে ট্রাইব্যুনালের একজন প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ কর্তৃক টাকা-পয়সার লেনদেনের ব্যাপারে যে দাবি করেছিলেন, তা সর্বতোভাবে মিথ্যাচার এবং অসৎ উদ্দেশ্যমূলকই বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে।

২. ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী মামলার স্বার্থে কোনো প্রসিকিউটর আসামির সাথে সাক্ষাত করতে পারে কিনা তা জানার জন্য আমি উচ্চ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত দুইজন বিচারপতির সাথে কথা বলি। তাঁরা ট্রাইব্যুনাল আইনের বিচার বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, "ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী আসামির সাথে প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজের সাক্ষাত সম্পূর্ণ আইনানুগ এবং বিধিসম্মত। তুরিন আফরোজ কোনোভাবেই ট্রাইব্যুনাল আইন ভঙ্গ করেননি"।

অর্থাৎ প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ একজন আসামির সাথে তদন্তের স্বার্থে দেখা করতে পারেন না বলে খোদ প্রসিকিউশনের ভেতর থেকে যে দাবি করা হয়েছিল, তা ভুল বলে প্রতীয়মান।

আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হলেও আমি মোটামুটি নিশ্চিত হই যে, তুরিন কোনো অপরাধে জড়িত হননি। তাহলে একজন প্রসিকিউটর কোন উদ্দেশ্যে এবং কেন এভাবে বিভিন্ন মিডিয়ায় এবং অন-ক্যামেরায় অত্যন্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছিলেন যে, “তুরিন আসামির সাথে দেখা করে আইনভঙ্গ করেছেন যা সাজা পাওয়ার যোগ্য” তা আমার বোধগম্য নয়!

ঘটনার পর পরই আইনমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, এ ব্যাপারে একটা সুষ্ঠু তদন্ত হবে। সেই থেকে ঘটনার প্রায় তিন মাসের অধিককাল পেরিয়ে গেলেও, অদ্যাবধি কোনো তদন্ত রিপোর্ট আইন মন্ত্রণালয় জাতির সামনে তুলে ধরেনি। জাতি আশা করে, খুব শিগগিরই ব্যারিস্টার তুরিনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয়েছিল, তার সুষ্ঠু তদন্ত রিপোর্ট জাতির সামনে প্রকাশ করবেন মাননীয় আইনমন্ত্রী!

  • সাব্বির খান: কলামলেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত