শ্যামল কান্তি ধর

১৯ জুলাই, ২০২০ ১৭:১৪

হুমায়ূন আহমেদের শ্রাবণ মেঘের দিন

হুমাুয়ূন আহমেদের পাঠকমাত্রই জানেন তার বৃষ্টিবিলাস ও জোছনাপ্রীতির কথা। অসংখ্য উপন্যাস, গল্প, নাটক ও চলচ্চিত্রে তিনি নানাভাবে তা ফুটিয়ে তুলেছেন শৈল্পিক সুষমায়। বাংলার বৃষ্টি মানেই তো শ্রাবণ। আর হাওরাঞ্চলে শ্রাবণের বৃষ্টি, অথৈ পানি, পুবালী বাতাস সে তো প্রকৃতির এক মোহনীয় রূপ। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন সেই রূপের অনুরাগী। তাই বোধহয় তার শ্রাবণের প্রতি এত দুর্বলতা। আর এমনি এক শ্রাবণেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। তাই এই শ্রাবণে লিখতে বসেছি হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ও চলচ্চিত্র “শ্রাবণ মেঘের দিন” নিয়ে কিছু কথা। শ্রাবণ মেঘের দিনে যেমন রয়েছে ভালোবাসা, বৃষ্টি, জোছনার গল্প তেমনি আছে হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন সংকটের কথা। দরিদ্র মানুষের দিনযাপনের কথা।   

শ্রাবণ মেঘের দিন উপন্যাস হিসাবে প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে আর চলচ্চিত্র হিসাবে মুক্তি পায় ১৯৯৯ সালে। এর আগে হুমায়ূন আহমেদের পরিচালনায় চলচ্চিত্র “আগুনের পরশমনি” মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে, যে সময় শ্রাবণ মেঘের দিন উপন্যাস হিসাবে প্রকাশিত হয়। শ্রাবণ মেঘের দিন হুমায়ূন আহমেদের পরিচালনায় দ্বিতীয় চলচ্চিত্র। তাই শ্রাবণ মেঘের দিন নির্মাণকালে তিনি আর নবীন পরিচালক ছিলেন না। আগুনের পরশমনি বোদ্ধামহলে বেশ আলোচিত হয়, জিতে নেয় কয়েকটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার সহ আরো অন্যান্য পুরস্কার। তাই স্বাভাবিক ভাবেই শ্রাবণ মেঘের দিন নির্মাণকালে হুমায়ূন আহমেদ আত্মবিশ্বাসে ও অভিজ্ঞতায় বলীয়ান হয়েই আবির্ভূত হন এবং এর কিছু নমুনা আমরা পেয়েও যাই তার ‘'শ্রাবণ মেঘের দিন” চলচ্চিত্রে এবং ফলস্বরূপ  জিতে নেয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অন্যান্য কিছু পুরস্কার।

সাহিত্যের চলচ্চিত্রায়নে নির্মাতার স্বাধীনতা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। একটি উপন্যাস কিংবা গল্পের চলচ্চিত্র রূপায়নে নির্মাতা মুল ভাবকে কেন্দ্র করে কাহিনী এগিয়ে নিয়ে যান, এতে মুল কাহিনীর অনেক কিছুই বাদ দিতে হয় কিংবা চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে কিছু সংযোজনও করতে হয়, তাতে উপন্যাসের মুল সুর যাতে বিঘ্নিত না হয় সে ব্যাপারে পরিচালক রাখেন সজাগ দৃষ্টি। তবে পাঠক যখন চলচ্চিত্রে উপন্যাসের/গল্পের মিল খুঁজে বেড়ান তখন বিভ্রম তৈরী হয় কিংবা একজন চলচ্চিত্র সমালোচক যখন হাতে উপন্যাস/গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র দেখতে বসেন তখন পরিচালকের জন্য আরেক বিড়ম্বনা তৈরী হয়। সত্যজিৎ রায়কে পর্যন্ত সেইসব সমালোচকের বিরুদ্ধে কলম হাতে নিতে হয়েছে এবং রীতিমত বিশ্লেষণ করে তার জবাব দিতে হয়েছে।

হুমায়ূন  আহমেদের  চলচ্চিত্র ও উপন্যাস “শ্রাবণ মেঘের দিন” দুটোই তার নির্মিত ও রচিত। তাই হুমায়ূন আহমেদ চলচ্চিত্র নির্মাণে তার স্বাধীনতা নিশ্চিন্তভাবে পেলেও আমরা পাঠকরা/দর্শকরা কিছু বিশ্লেষণ করতেই পারি।

চলচ্চিত্র “শ্রাবণ মেঘের দিন” শুরু হয় একটি রেল স্টেশনে দু বোন নীতু, শাহানা এবং স্টেশন মাস্টারের অভিনয়ের মাধ্যমে কিন্তু উপন্যাস শুরু হয় ট্রেনের কামরায়। এই ট্রেনের কামরায় চলচ্চিত্রের অনেক “ডিটেল” ছিল যা হুমায়ূন আহমেদ ব্যাবহার করেননি। তার কয়েকটি  উদাহরণ আমি এখানে আলোচনা করতে চাই।

হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাসে ট্রেনের কামরার দৃশ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন-

“ট্রেনের কামরায় হারিকেন জ্বলছে। অসুস্থ ছেলেটির বাবা হারিকেন ধরিয়েছে। এরা রাতে ট্রেনে চাপলে হারিকেন সঙ্গে নিয়েই উঠে। হারিকেনটার কাচ ভাঙ্গা ।লাল শিখা দপদপ করছে। যে কোন মুহুর্তে নিভে যাবে। নীতু গভীর আগ্রহ নিয়ে হারিকেনের শিখার দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাতে পেনসিল টর্চ। টর্চটা কাজ করছে না। বাইরে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। হালকা বর্ষণে শাহানা মাথা বের করে ভিজছে”।   

“শাহানা জানালা দিয়ে মুখ বের করে দিয়েছে। বাতাসে তার শাড়ির আঁচল উড়ছে। পতপত শব্দ হচ্ছে। ট্রেনের ভেতরটা  অন্ধকার, বাইরে দিন- শেষের আলো।’’

আরেকে জায়গায় লিখেছেন, “যারা এই কামরায় উঠেছে তারা সবাই বয়স্ক বুড়ো ধরণের গ্রামের মানুষ। শুধু একটি ন দশ বছরের ছেলে আছে। ছেলেটির পাশে যে বুড়ো মানুষটি বসে আছে তার কোলে ঝকঝকে পেতলের একটা বদনা। সে বদনার নলটা কিছুক্ষন পরপর ছেলেটার মুখে ধরছে।“

কি অপূর্ব ডিটেল। এই ডিটেলের উপাদান হুমায়ূন আহমেদ চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেননি। এই দৃশ্যগুলোর ব্যবহারে চিত্রনাট্য আরো শক্তিশালী হত বলে আমার ধারনা। এরই সাথে হুমায়ূন আহমেদ চলচ্চিত্রে অনেক দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যেরও সংযোজন করেছেন। যেমন- সুর্যাস্তের সময় ছেলের হাত ধরে পরাণ ঢুলীর বাঁশের সাঁকো পার হয়ে যাওয়া, যখন পরাণের স্ত্রী দুর্গার জীবন সংকটাপন্ন। সুর্যাস্তের বিপরীতে এই ছায়াচিত্রটি দুর্গার জীবনসংকটে পরাণের ও তার ছেলের মনের অবস্থা দর্শক মনের গভীরে দাগ কাটে।

“শ্রাবণ মেঘের দিন” চলচ্চিত্রে হাওরাঞ্চলের গ্রামের রাতের দৃশ্যে হারিকেন, মোমবাতির আলোর ব্যাবহারে বেশ পরিমিতিবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। চেষ্টা করা হয়েছে হারিকেনের আলো কিংবা মোমবাতির আলোর বাস্তবসম্মত দৃশ্যায়নের। শিল্প নির্দেশনা অনবদ্য হয়েছে আলোর ব্যবহারের পরিমিতিবোধে। কাজটা সহজ নয়। হারিকেনের কিংবা মোমবাতির আলো ফুটিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন আলোকবিদ্যার যথাযথ জ্ঞান ও প্রয়োগ। প্রয়োজন  আলো ব্যবহারের শিল্পিত রুচি। অনেক সিনেমায় দেখা যায় হারিকেন কিংবা মোমবাতির দৃশ্যে চারিদিক হাস্যকরভাবে আলোকিত হয়ে আছে। শ্রাবণ মেঘের দিনে হারিকেন ও মোমবাতির আলো আঁধারির এই খেলাকে যতটা সম্ভব তুলে ধরা হয়েছে।  

শ্রাবণ মেঘের দিন উপন্যাস ও চলচ্চিত্রে মতি মিয়া একজন গাতক। উপন্যাসে মতি মিয়ার বর্ণনায় লেখক লিখেছেন, সে গানের দলের অধিকারী- –গানের দলের অধিকারীর কদমছাট চুলে মানায় না---তার চেহারা ভাল। লম্বা চুলে তাকে ঋষি ঋষি মনে হয়। কিন্তু চলচ্চিত্রে “গাতক” মতি মিয়ার চরিত্রে জাহিদ হাসানকে আমরা লম্বা চুলে দেখি না। কিন্তু উপন্যাসের মত বাস্তবিকই ভাটির গাতকদের লম্বা চুলে দেখা যায়।

চলচ্চিত্রে মতি মিয়া নদীর পারে বাঁশের চালার ঘরে বাস করে। তার আয়না একটি গাছের ডালে আটকানো থাকে। কিন্তু উপন্যাসে মতির একটা বাড়ি আছে। চলুন দেখে আসি লেখকের দৃষ্টিতে মতির বাড়ির বর্ণনা “মতির বাড়ি এক সময় ছিমছাম সুন্দর ছিল। এখন ভগ্নদশা। দক্ষিনের ঘরের অর্ধেকটা গত কালবৈশাখীতে উড়ে গেছে। উড়ে যাওয়া অংশ পাওয়া গেলেও ঠিক করা হয়নি। বাংলোঘরও বাসের অযোগ্য। চালের খড় বদলানো হয়নি। পুরনো খড় পচে-গলে গেছে, মধ্যের ঘরটা কোনমতে ঠিকে আছে। এই ঘরটা টিনের।”

কত সুন্দর ডিটেলের উপাদান। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ মতির ঘর নদীর পারে নিয়ে গেলেন। চলচ্চিত্রে উপন্যাসের বর্ণনামত মতির বাড়ি উপস্থাপন করলে একটা উঠানও দেখতে পেতাম। যে উঠানে কুসুম গভীর মমতায় ঝাড়ু দিয়ে পরিস্কার করে। উঠানে বৃষ্টির জলে কাদামাখা একটা জলচৌকি থাকত। শ্রাবনের বৃষ্টির জলে উঠানে পানি জমে যেত। পানিতে থপ থপ শব্দ তুলে চলে যেত জয়নাল। যেমনটা বর্নিত আছে উপন্যাসে। রাজবাড়ির রাজকন্যারা মতির উঠানে দাঁড়ালে এই কাঁদাযুক্ত জলচৌকির কারনে আমরা এক বিব্রত মতিকে দেখতে পেতাম।যেমন রয়েছে উপন্যাসে। ভরা পূর্ণিমায় এই উঠান ভরে যেত জোছনায়। কুসুম (শাওন) মতিকে (জাহিদ হাসান) নিয়ে জোছনায় গোসল করতে চাইত। মতির বাড়ি নদীর কিনারে নিয়ে যাওয়ার এই জোছনা ভরা উঠান আমরা পাইনি, তবে চলচ্চিত্রে নদীর কিনারে বাড়ির জোছনায়ও কুসুম মতিকে নিয়ে গোসল করতে চেয়েছে। উপন্যাসে উঠান ভরা জোছনার বর্ণনা অনেক হৃদয়গ্রাহী।

২)

“শ্রাবণ মেঘের দিন” নামের মধ্যে একটা রোমান্টিকতা থাকলেও লেখক/পরিচালক শুধু রোমান্টিকতার বৃত্তে আবদ্ধ না রেখে আমাদের সামনে এক হাওরাঞ্চলের চিত্র তুলে ধরেছেন যেখানের মানুষ তার মৌলিক অধিকারের প্রায় প্রত্যেকটি থেকেই বঞ্চিত। তাই গ্রামের পথ ধরে শাহানা যখন হাঁটে, তখন তার মনে হয়- এই গ্রামের মানুষগুলো এত দরিদ্র কেন? ঘর বাড়ির কি অবস্থা? আহারে, একটু কিছু যদি এই মানুষগুলোর জন্য করা যেত!

কুসুমের মায়ের জন্য ওষুধের নাম লিখে দেবার জন্য শাহানা যখন কুসুমের বোন পুস্পকে কাগজ কলম নিয়ে আসার জন্য বলে পুস্প তখন কাগজ কলম আনতে রাজবাড়ির দিকে ছুটে গেল। হুমায়ুন আহমেদের বর্ননায় “বিস্ময়ে অভিভুত হয়ে শাহানা অপেক্ষা করছে। এত বড় একটা গ্রাম, কাগজ-কলম, আছে এমন কেউ নেই? স্কুল, মাদ্রাসা মক্তব কিছুই নেই? জায়গাটা কি সত্য পৃথিবীর বাইরে?”

সিনেমায় যদিও এই দৃশ্যটি সুনির্দিষ্টভাবে নেই, পুরো সিনেমা জুড়েই বিভিন্ন সময়ে এটা উপলব্দি করা যায়। তাই মুদির দোকানের ছেলেটি যখন বলে অ এ অজগর, আ এ অজগর, ই এ অজগর তখন আমাদের বুঝে নিতে কষ্ট হয় না যে এই ভাটির অঞ্চলের শিক্ষা আসলেই অজগর সাপ গিলে খেয়েছে।

সামাজিক বৈষম্যের, শ্রেনী বিভেদের কিছু চিত্রও  আমরা দেখতে পাই। যেমনঃ নীতুর হাত ধরেছে বলে পুস্পকে ইরতাজুদ্দিন  সাহেব (গোলাম মুস্তফা) শাস্তি দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেন।  নীতুকে সাপ দিয়ে ভয় দেখানোর ফলে তিনি দুই বেদেনীর চুল কেটে দেন, রাজবাড়ির রাজকন্যাদের নিমন্ত্রনে মতি রাতের খাবারের জন্য রাজবাড়িতে উপস্থিত হওয়ায় তিনি মতিকে চরম অপমান করেন। অপমানিত মতি মনের দুঃখে গায় উকিল মুন্সির সেই বিখ্যাত গান “আমার গায়ে যত দুঃখ সয়/বন্ধুয়ারে দিও তোমার মনে যাহা লয়”।

শ্রাবণ মেঘের দিন চলচ্চিত্রে গায়ক বারী সিদ্দিকীকে পরিচয় করিয়ে দেন হুমায়ূন  আহমেদ। প্রতিটি গানই জনপ্রিয়তা পায়। শুধুই জনপ্রিয়তার নিরিখেই নয় বিষয় বৈচিত্রে, ভাব গম্ভীর্যে প্রতিটি গানই আলাদা করে আলোচনাযোগ্য, এমনকি হুমায়ূন আহমেদ রচিত গানও। সিনেমার শুরুর দিকে নৌকায় মতির কণ্ঠে বারী সিদ্দিকী যখন “ পুবালী বাতাসে” বলে টান দেন তখনই দর্শক একটু নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হন। এই গানগুলো নিয়ে আলাদা করে একসময় লেখা যেতে পারে।

শ্রাবণ মেঘের দিনের শাহানা (মুক্তি) একজন চিকিৎসক। তাই ভাটি অঞ্চলের চিকিৎসা ব্যাবস্থা বেশ ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে উপন্যাস এবং চলচ্চিত্র দুটোতেই। পরাণ ঢুলীর স্ত্রী দুর্গা যখন প্রসব বেদনায় ছটফট করছে, তখন ধাই (রওশন জামিল) জানিয়ে দেন বাচ্চা উল্টা। জীবন বাঁচাতে হলে শহরে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু শহরে নিয়ে যেতে পুরো দিন লাগবে। ততক্ষণে দুর্গা বাঁচবে না। তাই পরাণ ঢুলী তার স্ত্রীর জীবনের আশা প্রায় ছেড়েই দেয়। তৈরী হয় সেই দৃশ্যের- সুর্যাস্তের বিপরীতে পরান ঢুলীর ছেলেকে নিয়ে সাঁকো পার। শেষ পর্যন্ত শাহানার চেষ্টায় দুর্গা তার জীবন ফিরে পায়। সন্তানের জন্ম হয়। সাথে সাথেই ভাটির মানুষের কাছে শাহানা দেবীর আসন পায়। পরাণ ঢুলি নতশিরে প্রনাম জানায় শাহানাকে। উত্তর পাড়ার সেই মহিলা চিৎকার করে জানিয়ে দেয় রাজবাড়ির রাজকন্যা কেন এক মাস আগে এলো না, এক মাস আগে এলে তার ছেলেটা বেঁচে যেত।  বৃদ্ধা মহিলা শাহানার মুখ ছুঁয়ে অশ্রু মুছে দিয়ে বলেন “যে মানুষের চোখের পানি দুর করে, তার চোখে কেন পানি থাকব”। কুসুম যে কিনা মনে মনে শাহানাকে ঈর্ষা করে, সেও শাহানার জন্য একটা পাখা বানালো যেটাতে লেখা ছিল “ডাক্তার আপা”। এইসব দৃশ্যে খুব সহজেই ভাটি অঞ্চলের চিকিৎসা বঞ্চিত মানুষের গল্প বলেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তাই হয়তো শাহানার তার দাদুর কাছে চাওয়া তিনটি বরের একটি বর ছিল, রাজবাড়িকে হাসপাতালের জন্য দান করে দেয়া।                   

চলচ্চিত্রের শেষের দিকে শাহানা যখন গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে তখন বিদায় জানাতে আসা অসংখ্য মানুষের ভীড়ে বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়েদের উদোম গা এবং মতির রিপু করা পাঞ্জাবী পরা,ধার করা মাফলার, চাদর পরে রাজবাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে যাওয়া এসব বর্ণনায় হাওরাঞ্চলের  মানুষের জীবনমান ছোট পরিসরে বিধৃত হয়েছে উপন্যাসে এবং চলচ্চিত্রে।

৩)

হুমাুয়ূন আহমেদের উপন্যাসের নায়িকারা সাধারনত খুব বুদ্ধিমতী হয়। তারা যুক্তি ছাড়া কথা বলে না, নানা রকম লজিক নিয়ে খেলা করে। শ্রাবণ মেঘের দিনের শাহানাও তাই। সে ডাক্তার, যে কয়দিন পর বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবে সেই শাহানা মতির গানে মুগ্ধ হয়ে মতির গানের দলে যোগ দেবার স্বপ্ন দেখে,যে স্বপ্ন দেখে ভাটির মেয়ে কুসুমও। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায় যার রূপের বর্ণনা  “দু চোখে তার আহারে কি মায়া/নদীর জলে পড়ল কন্যার ছায়া”। চলচ্চিত্রে আমরা শাহানার চোখে শুধু মুগ্ধতা দেখলেও উপন্যাসে শাহানার চিন্তা আরেকটু প্রাগ্রসর। শাহানার মেজো বোনের কাছে লেখা একটি চিঠিতে সে মতির গানে মুগ্ধতা নিয়ে লিখে “আমি এতই অভিভুত হয়েছি যে আমার মন শুধুই কাঁদছে–। বার বার মনে হচ্ছে, আমি যদি এই গ্রামের অশিক্ষিত দরিদ্র এক তরুণী হতাম- তাহলে কি চমৎকার হত! ছুটে যেতাম তাঁর কাছে। হায়রে! আমার জন্ম হয়েছে অন্য জগতে- আমি রাজবাড়ির মেয়ে-ভীরু ধরনের মেয়ে...”। কিন্তু শাহানা যেহেতু হুমায়ূন আহমেদের নায়িকা তাই চিঠির শেষে লেখে “গানের আসর থেকে জ্বর জ্বর ভাব নিয়ে ফিরেছি- শারীরিক অবস্থাও ঘোর তৈরির একটা কারণ হতে পারে”। শাহানার এই মুগ্ধতা/দুর্বলতাকে হুমায়ূন আহমেদ “ঘোর” বলে এর রেশ টেনে ধরেছেন। এই রেশ টেনে না ধরলে শ্রাবণ মেঘের দিন হয়তো আর কয়েকটা ফর্মুলা সিনেমার মতই হত। আমরা শাহানার সাথে মতিকে বনে জঙ্গলে নাচতে দেখতাম!

আমরা পাঠক/দর্শক হুমায়ূন আহমেদের সাথে শাহানার চোখে মুগ্ধতার বাইরে চিন্তা করার সাহস না দেখালেও শাহানার ঐ চোখে কুসুম হয়তো মতির প্রতি তার ভালোবাসাই খুঁজে পেয়েছিল। তাই শাহানার প্রতি কুসুমের এক নীরব ঈর্ষা আমরা সিনেমার অনেক দৃশ্যেই দেখতে পাই। কুসুম যখন জানতে পারে মতি শাহানাকে “পুবালী বাতাসে” গানটি শুনিয়েছে তখন সে রেগে গিয়ে বলে, “ঐটা আমার গান, আফনে তারে কেন শুনাইছেন”! আবার রাজবাড়িতে যাত্রা দেখতে গিয়ে মতিকে যখন শাহানা তার পাশে বসতে বলে, তখন কুসুম অশ্রুসিক্ত চোখে উঠে চলে যায় যখন যাত্রা দৃশ্যে এক পুরুষকে নিয়ে দু নারীর টানাটানি চলছিল। শাহানার ছোট বোন নীতু যখন কুসুমের কাছে মতির বাড়ির ঠিকানা জানতে চেয়ে বলে, আমার বড় বোনের গায়ক মতিকে অনেক পছন্দ, তখন কুসুম মুখ কঠিন করে বলে “গায়ক মতির বাড়ি আমি চিনি না”। উপন্যাসে মতি যখন একাকী শাহানাকে “কে পরাইল আমার চউখে কলংক কাজল” এই গানটি  শুনায়, তখন কুসুম তা দেখতে পেয়ে নীরবে চলে যায়। কুসুমের এই নীরব প্রস্থানের আড়ালেই লুকিয়ে ছিল ঈর্ষা। শ্রাবণ মেঘের দিনে এই মুগ্ধতা, ভালোবাসা, ঈর্ষা মনের গভীরেই নীরব থাকে, শাহানার কাছে, মতির কাছে এবং কুসুমের কাছে। তাই মতি কুসুমের প্রতি তার ভালোবাসাকে “স্নেহ” বলে, যেটা শুনে কুসুম অবাকই হয়। কুসুমের বিয়ে হচ্ছে জেনে মতি যখন বিয়ের দিন গানের আসর করার কথা বলে তখন কুসুম কানের দুল খুলে মতির জামার বুকের কাছে গানের অগ্রিম “মেডেল” পরিয়ে দিলেও মতি নির্বিকার। মতি নির্বিকার তখনও যখন কুসুম মতির সাথে “চান্নিপসরে” গোসল করতে চায়; আদর পেতে চায়। কিন্ত মতি এই উদাসীনতা কি সে শেষ পর্যন্ত বজায় রাখতে পারল? এদিকে কুসুম সুরুজের কাছে মিথ্যা কথা বলেও বিয়ে ভাঙ্গতে পারল না। কারণ সুরুজও ভালোবেসে ফেলেছে কুসুমকে। তার ভাষায় “সবুজ বরণ লাউ ডগায় দুধ সাদা ফুল ধরে, ভুল করা কইন্যার লাগি মন আনচান করে”।

অপ্রকাশিত ভালোবাসা কিংবা মতির উদাসীনতার কারণে কুসুমের কাছে বিষপান অনিবার্য হয়ে উঠল। কুসুমকে বাঁচাতে শাহানাদের ইঞ্জিন চালিত নৌকাকে ধরার জন্য মরিয়া হয়ে কাঠের ছোট নৌকা নিয়ে বৈঠা চালায় মতি ও সুরুজ। কুসুমের মাথা কোলে নিয়ে নিথর বসে থাকেন তার মা মনোয়ারা (আনোয়ারা)। তখন হঠাৎ কুসুমের নিথর দেহ দেখে মনোয়ারা মতিকে বলেন, নাও ফিরায়ে নেও মতি। তখন মতি হাতের বৈঠা নদীতে ফেলে দেয়।

কিন্তু সেকি! নাও ফিরায়ে নিতে হলেতো বৈঠা লাগবে। সেই বৈঠাই তো সে ফেলে দিল। কুসুমের মৃত্যুতে মতির ফিরে যাবার প্রয়োজনও ফুরিয়ে যায় তার কাছে। কোথায় ফিরবে? কার কাছে ফিরবে? তাই সিনেমা শেষ হয় নদীতে বৈঠা ভাসতে ভাসতে। মতি গেয়ে উঠে  “শোয়া চান পাখি আমি ডাকিতেছি, তুমি ঘুমাইছো নাকি”। যে গান কুসুম মতির কাছে শোনতে চেয়েছিল তার বিয়ের দিন।  

সুরুজের (মাহফুজ আহমেদ) কণ্ঠে মতি যখন “এক যে ছিল সোনার কন্যা” গানটি শুনে তখন তার অশ্রুতে যে ভালোবাসা ছিল সেটাও কুসুমের কাছে অপ্রকাশিত থেকে গেল। আবার রাজবাড়ীর রাজকন্যাদের গান শোনানোর জন্য মতির যে আয়োজন সেকি কেবলি গান শোনানো? নাকি রাজকন্যা শাহানাকেও মুগ্ধ করা! সিনেমায় সেই আয়োজনের বর্ণনা না থাকলেও উপন্যাসে গানের আয়োজনের জন্য মতিকে সুদ করে টাকা নিয়েও যন্ত্রশিল্পী ভাড়া করতে দেখা যায়, আসর সাজাতে দেখা যায়। গানের আসরে মতি গাইল হুমায়ুন আহমেদের সেই প্রিয় গান “মরিলে কান্দিস না আমার দায়”। সিনেমায় হুমায়ূন আহমেদ এই গান ব্যবহার করেননি। এর বদলে তিনি আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন রশিদ উদ্দিনের গান, উকিল মুন্সীর বিখ্যাত সেইসব গান।

৪)

মুক্তিযুদ্ধকে হুমায়ূন আহমেদ তার সৃষ্টিতে স্থান দিয়েছেন এক অনন্য উচ্চতায়। হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস, গল্প, নাটক, সিনেমা নিয়ে লেখা যায় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। সেই আলোচনা আরেকদিনের জন্য তোলা রইল। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম চলচ্চিত্র “আগুনের পরশমনি” মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র। শ্রাবণ মেঘের দিনেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন একটু ভিন্নভাবে। শাহানার দাদু ইরতাজুদ্দিন মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি মিলিটারিদের রাজবাড়িতে জায়গা দিয়ে যে অপরাধ করেছিলেন তার জন্য শাহানা তার দাদুকে বাধ্য করে গ্রামবাসীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য। ইরতাজুদ্দিনের এই ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি সে সময় খুব প্রাসঙ্গিক  ছিল এই জন্য যে তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল চারিদিকে।কিন্তু যুদ্ধাপরাধীরা ঘুরে বেড়াচ্ছিল সদর্পে। তাই ইরতাজুদ্দিনকে গ্রামবাসীর সামনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের একটি বার্তা দিয়েছেন।প্রসঙ্গত বাংলাদেশ টেলিভিশনে যখন “রাজাকার” শব্দ উচ্চারণ করা যেতনা তখন হুমায়ূন আহমেদ তার বহুব্রীহি নাটকে টিয়াপাখির মুখ  দিয়ে উচ্চারণ করান“ রাজাকার”।

হুমায়ূন আহমেদ “শ্রাবণ মেঘের দিন” চলচ্চিত্র নিয়ে হাজির হন সেই সময় যখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প অশ্লীলতায় ভাসছিল। মধ্যবিত্ত দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্র থেকে। হুমায়ূন আহমেদ তার শ্রাবণ মেঘের দিন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সিনেমাহল বিমুখ দর্শককে ফিরিয়ে আনেন সিনেমা হলে। প্রমাণ করে দেন ভালো ছবিও চলে।

মতি, কুসুম, শাহানার স্নেহ/ ভালোবাসা/মুগ্ধতা যে নামেই অভিহিত করিনা কেন হুমায়ূন  আহমেদ সারা সিনেমা জুড়েই এক নীরব মানসিক দ্বন্দ্বের মাধ্যমে সিনেমা/উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত আমাদের টেনে নিয়ে যান যা মনের গভীরে একটা প্রলেপ ফেলে, একটা দীর্ঘশ্বাসের জন্ম দেয়। যে দীর্ঘশ্বাস থেকে যায় বহুদিন। এমনকি রয়ে গেল আজও।

শ্যামল কান্তি ধর : লেখক ও ব্যাংকার।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত