ফরিদ আহমেদ

২৪ মে, ২০১৬ ২২:৩৬

টরন্টোতে বাংলাদেশি তিন সিনেমার প্রদর্শনী

গত দুই দিনে তিনটা বাংলা সিনেমা দেখলাম। তিনটাই বাংলাদেশের ছবি। ঘরে বসে নয়, রীতিমত মুভি থিয়েটারে গিয়ে দেখেছি সবগুলো ছবিই। আমার এই কথায় অনেকেই আশ্চর্য হবার কথা। সুদূর ক্যানাডায় নিশ্চয় মুভি থিয়েটারে বাংলা ছবির আসর বসে না যে আমি মুভি থিয়েটারেও বসে সেগুলো দেখতে পাবো।এর রহস্য রয়েছে অন্য জায়গায়।

টরন্টোতে এই মুহূর্তে চলছে দক্ষিণ এশিয়ান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। এই উৎসবে তিনটি বাংলাদেশি চলচ্চিত্র এসেছে প্রদর্শিত হবার জন্য। ছবিগুলো হচ্ছে গাজী রাকায়েত পরিচালিত ‘মৃত্তিকা মায়া’, মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত ‘অনিল বাগচীর একদিন’ এবং প্রসূন রহমান পরিচালিত ছবি ‘সুতপার ঠিকানা’। এই তিনটা ছবিই গত দুইদিনে দিয়ে দেখেছি আমি।



তিনটা ছবি দেখার কাজটা অবশ্য অতো সহজ ছিল না। চলচ্চিত্র উৎসবের বাংলা ছবি দেখানো হবে, এই খবর আমার ফেসবুকে এসেছিল বেশ কিছুদিন আগে। মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম দেখবো। কয়েকদিন আগে সিদ্ধান্ত নিলাম টিকেট কেনার। টিকেট কিনতে গিয়ে আমার মাথায় হাত। শুধুমাত্র ‘মৃত্তিকা মায়া’-র টিকেট আছে, বাকি দুটোরই টিকেট সোল্ড আউট। ‘মৃত্তিকা মায়া’ এবং ‘অনিল বাগচীর একদিন’ এই দুটো ছবি আবার দেখানো হচ্ছে আমার বাসার খুব কাছে অবস্থিত মর্নিংসাইড সিনেপ্লেক্সে। গাড়িতে তিন-চার মিনিটের বেশি লাগে না যেতে। ‘সুতপার ঠিকানা’ দেখানো হবে ওয়েস্টসাইড সিনেমাতে। ওয়েস্টসাইড সিনেমাও আমার বাসা থেকে খুব একটা দূরে নয়। মাত্র দশ মিনিটের ড্রাইভ। বাসার এতো কাছের থিয়েটারে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র দেখানো হবে আর আমি দেখতে পাবো না, এই আফসোসে মরে যাবার দশা হলো আমার। সমরেশ দাকে বললাম দুঃখের কথা। তাঁরও ছবি দেখার ইচ্ছা ছিল, বিশেষ করে অনিল বাগচির একদিন। দেখতে পাবেন না বলে আফসোস করলেন। তবে সেই সাথে বললেন যে, তাঁর দোস্ত সুব্রত নন্দী চলচ্চিত্র উৎসবের ব্যবস্থাপনার সাথে যুক্ত আছে। তাঁর কাছে চেক করে দেখবেন অতিরিক্ত টিকেট আছে কিনা। সুব্রত দা আমারও পরিচিত মানুষ। কিছুটা ভরসা পেলাম এই কথায়।


তবে, সমরেশ দার উপর এককভাবে ভরসা না রেখে নিজেও টিকেটের চেষ্টা চালালাম আমি। ফেসবুকে একটা অস্থায়ী স্ট্যাটাস দিলাম এই বলে যে কারো কাছে অনিল বাগচীর একদিন এবং সুতপার ঠিকানা ছবির অতিরিক্ত টিকেট থাকলে, আমাকে দিলে কৃতজ্ঞ থাকবো। দুঃখের বিষয় সেই স্ট্যাটাসের কোনো সাড়া আমি কারো কাছ থেকে পাই নি। এর মধ্যে পরের দিন সুসংবাদ দিলেন সমরেশ দা। সুব্রত দা-র কাছে নাকি অতিরিক্ত টিকেট আছে।

ফেসবুকের ইনবক্সে সুব্রত দাকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি নিশ্চয়তা দিলেন টিকেট আছে এবং আমার যতগুলো লাগবে তিনি সংরক্ষণ করে রাখবেন আমার জন্য। পরের দিন রাতে গিয়ে উনার কাছ  থেকে টিকেট নিয়ে এলাম আমি।

এমনিতে বাংলা ছবি হলে অর্কবুড়া আমাদের সাথে যায় না। ‘অনিল বাগচীর একদিন’ সিনেমাটা দেখতে যাবে কিনা জিজ্ঞেস করেছিলাম ওকে ক্যাজুয়ালি। সে উত্তর দিলো যে, ‘আমি গিয়ে কী করবো? বুঝবো নাতো।’ ওকে বোঝালাম যে, তোমার যে বাংলা জানা আছে, সেটা যথেষ্ট এই মুভি বোঝার জন্য। আর তাছাড়া মুভিতে বেশিরভাগ কথা ক্যামেরাই বলে। এর ভাষা ইউনিভার্সাল। বাকি যে সমস্ত সংলাপ হবে, সেগুলোও তোমার বুঝতে সমস্যা হবে না। এছাড়া সাবটাইটেল তো আছেই। এখানে বলে রাখি। অর্কবুড়া সাত বছর বয়সে এই দেশে এসেছে। বাংলা লেখা এবং পড়াটা ভুলে গেছে সে এর মাঝেই। কিন্তু, আমরা যেহেতু বাসায় সবসময় বাংলাতেই কথা বলি, ওর বাংলা বলাটা এবং বুঝাটা খুব একটা খারাপ না। বাংলায় কথাবার্তা বলতে বা বুঝতে তেমন কোনো সমস্যা হয় না তার। আমার কথায় ছবি দেখতে যেতে নিমরাজি হলো সে।


‘মৃত্তিকা মায়া’ আমি আর আন্না দেখলাম, ‘অনিল বাগচীর একদিন’ অর্কবুড়াসহ পরিবারের তিনজন মিলে দেখলাম, আর সুতপার ঠিকানা একা দেখা হলো আমার। ঠিক একা না অবশ্য। সাথে সমরেশ দা এবং দেবী বৌদি ছিলেন। আন্নার কাজ থাকার কারণে সে যেতে পারে নি এটা দেখতে।

যে তিনটা ছবি দেখলাম, সেগুলো নিয়ে সামান্য একটু আলোচনা করবো। তবে, আগেই বলে নেই, চলচ্চিত্র বিষয়ে আমার কোনো জ্ঞান নেই। আমার পর্যালোচনা সে কারণে হাস্যকর হতে পারে, কিংবা মারাত্মক ভুলও হতে পারে। আমি আমার সাধারণ চোখে যা দেখেছি, সাধারণ বুদ্ধিতে যেটুকু উপলব্ধি করেছি, সেটাই খুব সংক্ষেপে তুলে ধরবো।

‘মৃত্তিকা মায়া’-র কাহিনী গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের একটা গ্রামের এক হিন্দু কুমার পরিবারকে ঘিরে। কুমার পরিবারের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভালবাসা-হিংসা-বিদ্বেষ, উদারতা এবং স্বার্থপরতার কাহিনি এটি। সেই সাথে মৃৎ শিল্পের মত একটি ঐতিহ্যবাহী পেশাকে টিকিয়ে রাখা সংগ্রাম দেখানো হয়েছে এখানে।

চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র বৈশাখ। মাটির কাজ করতে করতে যে নিজস্ব প্রতিভা, ইচ্ছা আর কর্মশক্তির গুণে নিজের অজান্তেই হয়ে উঠেছে এক অনন্য ভাস্কর। কুমার পরিবারের আশ্রিত হয়েও তার হাত দিয়েই এই পরিবারের প্রায় হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য প্রাণ ফিরে পায়। তবে, এর জন্য ব্যাপক মূল্য দিতে হয় তাকে, বরণ করে নিতে হয় পঙ্গুত্বের জীবন।

এই ছবির পরিচালনা করেছেন গাজী রাকায়েত। এটি একটি অসাধারণ চলচ্চিত্র। অসাধারণ যে, সেটা বোঝা যায় এর জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির সংখ্যা দেখেই। সেরা ছবি, সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতা, সেরা অভিনেত্রীসহ জাতীয় চলচ্চিত্রের সতেরোটি শাখায় পুরস্কার জিতে নিয়েছে এই ছবি ২০১৩ সালে। এতোগুলো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে আর কোনো ছবি কখনোই জিততে পারে নি।

আমার বিবেচনায়, আমার দেখা অন্যতম সেরা বাংলাদেশি সিনেমা এটি। প্রত্যেকেই চমৎকার  অভিনয় করেছেন এই ছবিতে। রাইসুল ইসলাম আসাদ তাঁর স্বভাবজাত অসাধারণ অভিনয় করে গেছেন। তবে, বৈশাখ চরিত্রে তিতাস জিয়া যা করেছেন, তাঁকে অনবদ্য না বলে কোনো উপায় নেই। এই ছবির শুধু একটা বিষয় নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি রয়েছে আমার কাছে। কেন যেন এই ছবির ক্যামেরার কাজ দেখে একে ফিল্ম মনে হয় নি আমার কাছে, অনেকটা বড় নাটকের মতো লেগেছে। চলচ্চিত্র আর নাটকের ক্যামেরার ভাষা আলাদা। এ বিষয়টা আমি জানি, কিন্তু, এর গভীরতা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। খালি চোখে যা বুঝি, সেটার বিবেচনাতেই এই কথাটা বললাম। চলচ্চিত্রবোদ্ধারা এর বিপরীত মত পোষণ করলেও আমার কোনো আপত্তি নেই।

সবচেয়ে আগ্রহ নিয়ে যে ছবিটা আমরা  বা টরন্টোবাসী বাংলাদেশিরা এই চলচ্চিত্র উৎসবে দেখতে গিয়েছিলাম, সেটি হচ্ছে মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত ছবি ‘অনিল বাগচীর একদিন’। এই ছবির আরো বড় আকর্ষণ ছিল স্বয়ং মোরশেদুল ইসলামের এখানে উপস্থিতি। তিনি শুধু একা নন, এই ছবির নাম ভূমিকায় অভিনয় করা সৈয়দ আরেফও প্রদর্শনীর সময়ে উপস্থিত ছিল। দুজনে সিনেমা শুরুর আগে বক্তব্য রেখেছেন।  মোরশেদুল ইসলাম ছবির বিষয়ে কথা বলেছেন আর আরেফ তার নিজের অনুভূতির কথা জানিয়েছে এই ছবিতে অভিনয় করার বিষয়ে।


‘অনিল বাগচীর একদিনের’ মূল কাহিনিকার হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূন আহমেদের গল্প বা উপন্যাস যেমন হয়, এটি তেমনই। গল্পে কোনো প্যাচগোচ কিংবা জটিলতা নেই। সহজ সরল এবং অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে এগিয়ে গিয়েছে ছবির গল্প। হুমায়ুন আহমেদের ধারাটাকে পরিচালক নিজস্ব ইচ্ছায় ব্যাহত করেন নি। তিনি হুমায়ূন আহমেদের বর্ণনাশৈলীকে অনুকরণ করে ন্যারেটিভ স্টাইলেই এগিয়ে নিয়েছেন ছবির কাহিনীকে।


অত্যন্ত ভীতু ধরনের এক তরুণ অনিল। ঢাকায় একটা বেসরকারি ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ করে। বাবা এবং অবিবাহিত বড় বোন দেশে থাকে। বাবা গ্রামের একজন স্কুল শিক্ষক। একাত্তরের যুদ্ধের মধ্যে ভীতসন্ত্রস্তভাবে দিন কাটে অনিলের। সব ঝামেলা-ঝক্কি থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে সে সযত্নে। কিন্তু, রাজনৈতিক কোনো কিছুতে না জড়িয়েও শুধুমাত্র সংখ্যালঘু হবার কারণে অনিলের জীবনে নেমে আসে করুণতম পরিণতি। একদিন খবর আসে পাকিস্তানি মিলিটারি হত্যা করেছে তার বাবাকে। বড় বোন আশ্রয় নিয়েছে অন্যের বাড়িতে। বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে দেশের বাড়ির দিকে রওনা দেয় অনিল। অনিলের জীবনের মাত্র এই একদিনের ঘটনাই উঠে এসেছে এই ছবিতে। ঘটনার শেষ পরিণতি হয় মিলিটারির হাতে অনিলের মৃত্যু দিয়ে, তবে এই মৃত্যুর আগে সেই ভীতু সন্ত্রস্ত অনিলকে আর পাওয়া যায়, এক সাহসী অনিল অনিবার্যতা হিসাবে মেনে নেয় মৃত্যুকে।

এই ছবির সূত্রপাত হয়েছে দুর্দান্তভাবে। অনিল স্বপ্নে দেশে বালক অবস্থায় বাবার সাথে মেলায় গিয়েছে। চারিদিকে হৈচৈ, আনন্দ-উল্লাস। এর  মাঝে সাপের খেলা দেখাচ্ছে এক বেদেনী। হঠাৎ করে একটা সাপ দ্রুতগতিতে চলে আসে দর্শকদের মাঝে। মুহূর্তের মাঝে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে আনন্দমুখর সব মানুষগুলো। একাত্তরের বাস্তবতা দেখানোর এই শৈল্পিক এবং বিমূর্ত প্রচেষ্টা দিয়েই শুরু হয় সিনেমার গল্পের। ছবিতে একাত্তর উঠে এসেছে অবিকলভাবে। রাস্তার বাস, বেবিট্যাক্সি, ট্রাক, সব একাত্তর সালের। এর পাত্রপাত্রীদের পোশাক একাত্তরের, এমনকি দেয়াল লিখনে যে বাংলা বানান পরিচালক দেখিয়েছেন তাও একাত্তর সালের। ডিটেইলসের প্রতি মোরশেদুল ইসলামের এই আনুগত্য একাত্তরকে অবিকলভাবে পঁয়তাল্লিশ বছর পরে আমাদের চোখের সামনে তুলে এনেছে। আমরা শুধু কাহিনীর মাধ্যমেই একাত্তর চিনি না, এর সমস্ত আনুষঙ্গিক জিনিসগুলো আমাদের একাত্তরকে চিনিয়ে দেয়।

ছবিতে অনিলের চরিত্র আরেফ যে অভিনয় করেছে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এই তরুণ এই ছবির জন্য সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পেলে বিন্দুমাত্রও অবাক হবো না আমি। এর মধ্যেই মেরিল প্রথম আলোর ক্রিটিক এওয়ার্ডে সেরা অভিনেতার পুরস্কার সে পেয়ে গিয়েছে এই চরিত্রের জন্য। এখন অপেক্ষা শুধু জাতীয় পুরস্কারের জন্য। এই ছবির আরেকজন অভিনেতা, যিনি তাঁর দুর্দান্ত অভিনয় দিয়ে পুরো প্রেক্ষাগৃহকে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো জাগিয়ে দিয়েছিলেন, যাঁর সংলাপ শুনতে শুনতে দর্শক হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েছেন, তিনি হচ্ছেন গাজী রাকায়েত। আমি বহুদিন এমন জীবন্ত অভিনয় দেখি নি। সেই কবে কোন জন্মে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এমন জীবন্ত অভিনয় করতেন, তারপরে আর কাউকে দেখি নি এমন করে। তিনিও জাতীয় পুরস্কার পাবেন এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য, এতেও কোনো সংশয় নেই আমার।

আমার ঠিক দুই সারি পিছনে বসে আরেফও ছবি দেখছিল  আমাদের সাথে। বের হয়ে আসার সময় হাতে হাত মিলিয়ে অভিনন্দন জানালাম তাকে। আমার মতো আরো অনেকেই দেখলাম তাকে প্রশংসার বন্যায় ভাসাচ্ছে। কোনো কোনো মহিলা বাৎসল্যরসে সিক্ত হয়ে ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরেও স্নেহের পরশ মাখিয়ে দিচ্ছে দেখলাম।



শেষ ছবি যেটা দেখা হলো, সেটা হচ্ছে তরুণ পরিচালক প্রসূন রহমানের ‘সুতপার ঠিকানা’। এটাই তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র। ছবিটি কেন্দ্রভূমিতে রয়েছে একজন নারী, সুতপা। তাঁর কৈশোর থেকে বৃদ্ধাবস্থা পর্যন্ত এই ছবির ব্যাপ্তি। কৈশোরে সুতপা ছিল বাবার উপর নির্ভরশীল, যৌবনে স্বামীর, স্বামী অকালে মারা যাবার পরে তিনি আশ্রয় নেন বড় ভাইয়ের সংসারে গলগ্রহ হয়ে, অবশেষে বৃদ্ধ বয়সে নির্ভরশীল হন একমাত্র পুত্রের উপরে। এর কোনোটাই তাঁর নিজের ঠিকানা নয়। এই নির্ভরশীলতার বৃত্ত ভেঙ্গে একসময় আপন ঠিকানার খোঁজে অজানা গন্তব্যের দিকে হারিয়ে যান তিনি। সুতপার এই পরনির্ভরশীল জীবন বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নারীর জীবনেরই কাহিনী। যদিও সবার সাহস হয় না সুতপার মতো এই সব পরাশ্রয়ী ঠিকানা ছেড়ে আপন ঠিকানার সন্ধানে নামার।

ছবির বিষয়বস্তু দারুণ, নাড়া দিয়ে যায় আমাদের প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনাকে। ছবির শুরুটাও হয়েছিল চমৎকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কিন্তু, পরিচালক শুরুর সেই প্রতিশ্রুতিকে পুরোটা সময় ধরে রাখতে পারেন নি, খেই হারিয়েছেন মাঝে মাঝেই। আর সেকারণে অনেক জায়গায় ছন্দপতন ঘটেছে ছবিটার। ছবিটার ব্যাপ্তিকাল কমপক্ষে পঁচিশ থেকে  তিরিশ বছরের বা তারও বেশি। সুতপার কৈশোর থেকে বৃদ্ধকালকে দেখানো হয়েছে। কিন্তু, চলচ্চিত্রের পর্দায় এই সময়টাকেকে আলাদা করা যায় না তেমন করে।পঁচিশ তিরিশ বছরের মানুষের পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে আরো অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটে। সেই পরিবর্তনগুলো সেভাবে দৃশ্যমান নয় এই ছবিতে। এছাড়া বিশাল একটা ব্যাপ্তিকাল দেখাতে গিয়ে পরিচালককে প্রায়শই লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চলে যেতে হয়েছে। এতে অনেক জায়গাতেই ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়েছে। একটা উদাহরণ দেই। স্বামী মারা যাবার পরে সুতপা তাঁর ছেলেকে নিয়ে বড় ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সুতপা যে ওই বাড়িতে আকাঙ্ক্ষিত নয়, সেটা তাঁর ভাবি তাঁর ভাইকে শুরুতেই কঠোর ভাষায় জানিয়ে দেয়। অথচ সেই বাড়িতে সুতপা থেকে যায় বারো বছর। এই বারো বছর গঞ্জনা সহ্য করেছে সুতপা, এটা বোঝা যায়। কিন্তু যে মহিলা তাঁর ওই বাড়িতে ওঠার আগে থেকেই মুখ কালো করে আছেন, তিনি বারো বছর ধরে এই বোঝা সহ্য করে গেছেন তীব্রতা না বাড়িয়ে, সেটা বিশ্বাস করা কঠিন। এছাড়া, যে সুতপাকে আমরা শৈশবে দেখি, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, বড় কিছু হবার জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী, সেই সুতপাকে এই বারো বছরে খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি কেন নিজে কিছু করার চেষ্টা করলেন না এই গলগ্রহ জীবন থেকে মুক্তি পাবার জন্য, সেটা পরিষ্কার না ছবিতে। ঠিক একইভাবে এটাও পরিষ্কার না, যখন তাঁর ছেলে ব্যবসায়ে ধীরে ধীরে উন্নতি করছে, তখনই কেন মাকে নিয়ে সরে পড়ে নি মামা বাড়ি থেকে? কেন বা তাকে অপেক্ষা করতে হলো নিজের  বিলাসী এপার্টমেন্ট এবং দামী গাড়ি কিনে মাকে চমক দেওয়া পর্যন্ত?

সুতপা চরিত্রে অপর্ণা ঘোষ চমৎকার অভিনয় করেছেন। এটা এই ছবির সেরা সাফল্য। অপর্ণা সু-অভিনেত্রী,  সদ্যই জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। কিশোরী সুতপা, যৌবনের সুতপা এবং বৃদ্ধ বয়সের সুতপা, এই তিন চরিত্রকেই বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। এই কাজটা একজন তরুণীর জন্য সহজ কাজ নয়। তবে, ছবিটা এক চরিত্র কেন্দ্রিক হবার কারণে অন্য কোনো চরিত্র তেমনভাবে বিকশিত হতে পারে নি। সবাই ঘুরপাক খেয়েছে সুতপাকেই কেন্দ্র করে।

একজন তরুণ নির্মাতার জন্য এই সব সামান্য ত্রুটি মার্জনার যোগ্য। প্রসূন তাঁর প্রথম ছবিতে যে সম্ভাবনা দেখিয়েছেন, সেটাই মুখ্য বিষয়। সুস্থ চলচ্চিত্র নির্মাণে ভবিষ্যতে তিনি আরো দৃঢ় ভূমিকা পালন করবেন, সেই আশা এই ছবি দেখেই করা যায়।

দক্ষিণ এশিয়ান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সাথে জড়িত সবার জন্য রইলো সাধুবাদ। তাঁদের কারণে দূর প্রবাসে থেকেও বড় পর্দায় নিজের দেশের সদ্য নির্মিত সেরা চলচ্চিত্রগুলো দেখার সুযোগ হলো। এরকম প্রয়াস আরো হোক, আমরাও বিদেশে থেকে দেশের গন্ধ নিতে পারি, সেই কামনা রইলো।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত