প্রণবকান্তি দেব

২৩ এপ্রিল, ২০২১ ১৬:৪৪

বই পড়া, না পড়া

আমাদের দেশে এখন বই নিয়ে কথা উঠলেই সবচেয়ে বেশি যে কথাটি উচ্চারিত হয়, 'তা হলো ' এখনকার ছেলেমেয়েরা বই পড়ে না, সারাদিন মোবাইল, ট্যাব নিয়ে পড়ে থাকে'। কথাটি যেমন বিলকুল সত্য নয় তেমনি আবার বিলকুল মিথ্যাও তো নয়। কিন্তু এটা সত্য যে, পাঠক সৃষ্টি কিংবা বই পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরির জন্য যে কাজগুলো আমাদের করা উচিত, তা অনেকাংশেই হচ্ছে না।

বইপড়ার মতো একটি অনিন্দ্য সুন্দর চর্চাকে উৎসাহিত করতে আমাদের নীতি নির্ধারকদের এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতার ফলে বারবার হোঁচট খাচ্ছে একটি মানবিক, সৃজনমনস্ক সমাজের স্বপ্ন। ইউনেস্কো ঘোষিত ২৩ এপ্রিলের বিশ্ব বই দিবস আমাদের কাছে এ বছর এসেছে সেই বাস্তবতায়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড়ো উদ্বেগের বিষয় হলো নীতি নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিবর্জিত এক শ্রেণির মুনাফালোভী, প্রচারমুখী লেখকের আবির্ভাব। যারা কিশোর - তরুণদের আবেগকে পূঁজি করে রাতারাতি 'বেস্ট সেলার' বনে যাওয়ার নেশায় উন্মুখ। লেখক তো নয়ই সারাদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ভঙ্গিতে ইনিয়ে বিনিয়ে আত্মপ্রচারে মত্ত এই গোষ্ঠী বস্তুতপক্ষে আদর্শ, চিন্তাশীল পাঠক গড়ার পথে হয়ে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকাল। ফলস্বরূপ, পাঠরুচির দৈনতাসৃষ্টির পাশাপাশি ভাবনার জগতে তৈরি হচ্ছে নেতিবাচকতা। বিশেষত, যে বয়সী তরুণ-তরুণীদের কেন্দ্র করে, যাদের মেধা,মনন ও চিন্তার উপর ভর করে একটি নান্দনিক, মুক্তচিন্তার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা হয় ঠিক তাদেরকেই টার্গেট করে লেখক নামধারী ঐ গোষ্ঠী ও তাদের দোসররা মাঠে নেমেছে।

এই অপশক্তি, অশুভ চিন্তার লেখক নামের প্রতারক এবং মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করা হতে পারে এ বছরের বই দিবসের অন্যতম প্রতিজ্ঞা।

আরেকটি উদ্বেগের ব্যাপার হলো, সরকারিভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগারগুলো কেবল সরকারি কর্মসূচি পালনেই আটকে আছে। স্থানীয় পর্যায়ে পাঠাভ্যাস সৃষ্টির জন্য তাদের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। আর ওদিকে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠাগার পরিণত হয়েছে গাইড বইয়ের ভাগাড়ে। এ প্লাসের নেশায় মত্ত প্রজন্মের কাছে পাঠ্যক্রমের বাইরের সৃজনশীল বইগুলো বড়ো বেরসিক মনে হয়। আবার বাড়িতে এলেই মোবাইল, টিভি, ইন্টারনেট। বইপড়ার সময় কই! সেই অবস্থার পরিবর্তনে একটি পরিকল্পিত,বাস্তবসম্মত কর্ম উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে।

অথচ অজানাকে জানা এবং অচেনাকে চেনার মানুষের যে চিরন্তন আগ্রহ, সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের সবচেয়ে সহজ পথ আজো বই পড়া। এই কথাগুলো আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই যে, বই মানুষকে যুক্তিবুদ্ধি জোগায়, তাকে চিন্তাশীল করে; সৃজনশীল করে, তাকে স্বপ্ন দেখায়, তার ভেতরের সম্ভাবনাগুলোকে জাগিয়ে তোলে। কিন্তু পাঠাভ্যাস কমে যাওয়ার ফলে সকল সম্ভাবনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। এতে করে একটি সৃজনশীল ও মননশীল জাতি হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার পথে একদিকে আমরা ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছি অন্যদিকে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সমাজ জীবনে।

সাম্প্রতিককালে তরুণদের মধ্যে যে হতাশা, স্বপ্নহীনতা, জঙ্গিবাদসহ নানা সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা আমরা দেখছি তার মূলে কিন্তু সেই সুন্দরতম অনুভূতিগুলোর চর্চা না করা,জ্ঞানের অবাধ ও উন্মুক্ত চর্চার অভাব এবং সর্বোপরি মূল্যবোধের বিকাশ না হওয়া।

অথচ একটি সহনশীল ও মানবিক সমাজ গঠনে বই পড়ার বিকল্প নেই। পাঠাভ্যাসের চেয়ে মানুষের সুন্দর আর কোনো অভ্যাস থাকতে পারে না। তবে এ জন্য শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। আমাদের পরিবার হচ্ছে সকল অভ্যাস গড়ে দেয়ার প্রথম পাঠশালা আর মা-বাবা হচ্ছে সবচেয়ে বড়ো প্রভাবক। শুরু করতে হবে বাসা থেকেই। জন্মদিনে চকলেট আর কেকের সাথে যদি বই স্থান করে নেয় তাহলেই দেখবেন বাকি কাজগুলো সহজ হয়ে যাবে। তাছাড়া সেই আগের মতো পাড়ায়-মহল্লায় পাঠাগার ও পাঠচক্র গড়ে তোলার আন্দোলন শুরু করা দরকার। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ। মা বাবা থেকে শুরু করে পাড়ার মুরব্বী, লেখক, প্রকাশক, রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারক সবারই দায়িত্ব এটি। সবার সম্মিলিত উদ্যোগে বই পড়াকে সামগ্রিক একটি সামাজিক আন্দোলনের রূপ দিতে হবে। পাঠক বইয়ের কাছে না গেলেও বইকে নিয়ে যেতে হবে পাঠকের কাছে।

আশার কথা হচ্ছে, এসবের অনেক কিছুই এখন হচ্ছে। বইয়ের গাড়ি মানুষের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে, ব্যক্তি উদ্যোগে পাঠাগার বাড়ছে, দেশের আনাচে কানাচে উদ্যমী তরুণ প্রজন্ম পাঠাভ্যাস সৃষ্টির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এমনকি ছেলেমেয়েরা "মোবাইল আসক্ত" বলে যে প্রচারণা চালানো হয় তার বাইরে গিয়ে ভার্চুয়াল মাধ্যমে বইপড়া নিয়ে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এগুলো আমাদের আশার সংবাদ। কিন্তু বিচ্ছিন্ন এই উদ্যোগ ও ভাবনাগুলোকে একত্রিত করে একটি সার্বজনীন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে আমরা সেই আলোকিত সমাজের স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে যেতে পারতাম।

প্রণবকান্তি দেব: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক; প্রধান উদ্যেক্তা, ইনোভেটর বইপড়া উৎসব, সিলেট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত