প্রণবকান্তি দেব

০৩ এপ্রিল, ২০২০ ২২:৫৪

সাহসী হও মানুষ, আশাবাদী হও মানুষ

এই যে এতো দুঃখ, এতো মন খারাপ, এতো বিষণ্ণতা- হাহাকার এখন চারদিকে, এতো উদ্বেগ-শঙ্কা, এতো ধুকপুক বুকে- সেটাই কী শেষ কথা? এই যে প্রতিদিন জীবনের তীর ছেড়ে এসে মৃত্যুর খবরগুলো ধনুকের মতো বিঁধছে আমাদের বুকে, এই যে অহর্নিশ আমাদের ভাবনার ঘরদোর জুড়ে কেবলই আতঙ্ক, কেবলই হা হুতাশ- তার পরে কী? এই যে এখন প্রতিমুহূর্তেই কেবল মনে হচ্ছে, জীবন ক্ষণিকের, জীবন নিরানন্দ, জীবন কেড়ে নেয় সবকিছু -সেটারও কী অবসান হবে না কোনো?

আমি বিশ্বাস করতে চাই, হবে। আবারো পৃথিবী মানুষের হবে। আলো আসবেই, দিন হাসবেই। 'করোনা', যা দিয়ে যাবে-তা হয়তো মনের গভীরে ক্ষত হয়ে দহনে পোড়াবে বহুকাল। কিন্তু, আমি বাঁচতে চাই, মেঘ সরে যাবার পর ঐ রোদটুকু দেখব বলে। আমি তাই বলি, মানুষ তুমি আশাবাদী হও। মানুষ তুমি ভেঙে পড়ো না। মানুষ তুমি মরার আগে মরে যেওনা। বিশ্বাস রাখো কীটস এ- " If Winter Comes/ Can Spring be far behind?"

জীবনের তো ধর্মই এমনই। এই হাসি তো ঐ কান্না, এই উজ্জ্বল তো ঐ মলিন। যে জীবন হাসি-কান্নার পালাবদল মেনে নিতে পারে না, কেবল আনন্দ চায়, কেবল সুখই চায়... সেটাতো সত্যিকারের জীবন নয় অথবা স্বার্থপরতার জীবন। এখানে আপনি বেঁচে থাকলেই কী আর মরে গেলেইবা কী!

তবু আমরা সকলেই একটি সফল, সার্থক, সুন্দর জীবন কামনা করি। অনিন্দ্য, নিরুপম একটি জীবনের স্বপ্ন দেখে সবাই। জীবনে সত্যিকারের আনন্দ তো আসে তখন, যখন এ জীবন অন্যের কাজে লাগে। করোনা আতঙ্কে এই রুদ্ধদ্বার সময়ে, গৃহসর্তককালীন মুহূর্তগুলো যখন নানা মনখারাপের বার্তায় বিষণ্ণ, তখন এক চিলতে রোদ নিয়ে আসে কিছু খবর।

এই যে দেখুন , এই দুঃসময়ে মানুষ কীভাবে মানুষের জন্য এগিয়ে আসছে। পৃথিবীর অন্য দেশের কথা না হয় বাদ দিলাম, আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের দিকে তাকান; শহর কেবল নয়, গ্রাম-বন্দরেও তাকান, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কীভাবে একদল মানুষ অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। এটাই তো জীবনকে মহিমা দান করে!

ক'দিন থেকে দেখছি আমার চেনা অস্থির ছেলেটা, সবচেয়ে ক্যারিয়ার পাগল তরুণ, নাটক- গানের মেয়েটা, কবিতায় ঝংকার তোলা ছেলেমেয়েগুলো, রাজপথে প্রতিবাদে স্লোগানের বন্ধুগুলো, করপোরেটের সুহৃদজন... সবাই হয়ে উঠছে 'স্বেচ্ছাসেবী'। কেউ মাস্ক দিচ্ছে, কেউ সড়কে ছিটাচ্ছে জীবাণুনাশক, কেউ খাবারের প্যাকেট পৌঁছে দিচ্ছে, কেউ পিঠে করে নিয়ে আসছে চালের বস্তা, ডাক্তারবন্ধুরা বলছে ঘরে বসেই ফোন দিন, সেবা নিন.. এভাবেই তারা নিজ জীবনের একটা অংশ উৎসর্গ করে দিচ্ছেন মানুষের মুখে একটু হাসি ফোটানোর জন্য! পেশার চেনা গণ্ডি পেরিয়ে এগিয়ে আসছেন রাষ্ট্রের কর্মকর্তা, কর্মচারীগণ, নিজের বেতনের টাকা তুলে দিচ্ছেন বিপন্ন মানুষের কল্যাণে। এটাই তো জীবনের মহত্ব!

এই মানুষগুলোর ভালোবাসা দেখে, সহমর্মিতা দেখে অবাক হই। কেউ কেউ বলছে, আপনি আসা লাগবেনা, আপনার পরিচয়ও গোপন রাখা হবে, শুধু একটা ফোন দিন, আপনার ঘরে সাহায্য পৌঁছে যাবে... স্বজনের প্রতি কী হৃদয় নিংড়ানো সহানুভূতি! এখানে কি বেদনার বাস বেশি দিন হতে পারে? এই খবরগুলোই আমাকে আশ্বস্ত করে, সুদিন আসবেই। ঐ যে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলে গিয়েছিলেন, "মানুষ ধ্বংস হতে পারে কিন্তু পরাজিত হতে পারে না কখনো"। বলুন, মানুষই যদি পরাজিত হয়ে যায়, এ পৃথিবী তবে কার তরে! এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো সৌন্দর্যের নাম যে 'মানুষ'।

মানুষের ভেতরে এখনও মানবিক আকাশটা জেগে আছে বলেই দেখি, তারা পশুপাখির জন্য খাবার নিয়ে যায়, প্রতিবন্ধী, মানসিক ভারসাম্যহীন যারা- তাদের জন্য নিজে তৈরি করে খাবার পৌঁছে দেয়। এগুলোই তো আশাসঞ্চারী, জীবনপাত্রে মধু ঢেলে এই খবরগুলোই। জীবনকে অমৃতের সাধ এনে দেয় এই উদ্যোগগুলো।

এজন্যই বলি, করোনার ভয়াল থাবা একদিন পুরোনো হয়ে যাবে, মানুষের ভেতরে গাঁথা থাকবে মানুষ হয়ে কাছে আসার, পাশে দাঁড়ানোর এই গল্পগুলি। তাই বলি, সাহসী হও মানুষ, আশাবাদী হও মানুষ। বিরহ-বেদনা, দহন-যাতনা জীবনেরই অংশ। ভেঙে পড়লে কিচ্ছু থাকবে না, দাঁড়িয়ে থাকলে কিছুটাতো থাকবে।

  • প্রণবকান্তি দেব: সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত