জাহাঙ্গীর নোমান

০৭ জুলাই, ২০২১ ২২:২৭

চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজা গৌড় গোবিন্দ ও শ্রীহট্টের গণভোট

শ্রীহট্টমণ্ডল বা শ্রীহট্টদেশ বা সিলেট অঞ্চল অনেকগুলো দেশীয় রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এরমধ্যে লাউড়, গৌড়, জৈন্তিয়া, কাছাড় রাজ্য গুরুত্বপূর্ণ। যদিও কাছাড় রাজ্য সিলেট জেলাভুক্ত ছিল না কিন্তু সিলেটী ভাষাভাষী ওই জেলার বাসিন্দা ছিলেন। তবে সিলেট অঞ্চলে নগররাষ্ট্র গৌড় রাজ্যের রাজধানী শ্রীহট্ট শহর অত্র অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজনৈতিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেই ভগদত্তের আমল থেকে চন্দ্রবংশীয় শাসন পর্যন্ত। ৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ২০,০০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়। রাজা শ্রীচন্দ্র এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

১৩০৩ খ্রিস্টাব্দের একদিন, গৌড়ের রাজধানী শ্রীহট্ট শহর। রাজা গৌড় গোবিন্দ তার সভাসদ নিয়ে বসেছেন। গুপ্তচর খবর নিয়ে এসেছে গৌড়ের সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ এবার তার প্রধান সিপাহশালার সৈয়দ নাসিরউদ্দিনকে পাঠাচ্ছেন বিপুল সৈন্যবাহিনী দিয়ে গৌড় রাজ্য দখল করতে। সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধে যুদ্ধ কৌশল নির্ধারণে পারিষদ নিয়ে বসেছেন গোবিন্দ। রাজা গোবিন্দ ছিলেন অস্ট্রিক বংশোদ্ভূত। শ্রীহট্ট অঞ্চলের অন্যান্য রাজ্য লাউড়, কাছাড়, আর জৈন্তিয়া সবগুলোর রাজাই অস্ট্রিক বংশোদ্ভূত। পাহাড় থেকে নেমে সমতলেই তাদের রাজধানী বানিয়েছিলেন যাতে খাদ্যশস্যের সরবরাহ ঠিক থাকে। কিন্তু প্রজাদের অনেকেই পশ্চিম থেকে আগত ইন্দো-ইয়োরোপীয় জনগোষ্ঠী যারা এখানে এসে বসতি করেছে অনাবাদি ও উর্বর জমির সহজলভ্যতায়। তবে খাসিয়া, গারো ও হাজংরাও সংখ্যায় বেশ ভালোই ছিল।

সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ অনেকদিন ধরেই গৌড় রাজ্য দখলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তার ভাগ্নে সিকান্দার খান গাজী দুইবার গৌড় গোবিন্দের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর হাতে পরাজিত ও ব্যর্থ হয়েছিলেন। শেষমেশ সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ তার প্রধান সেনাপতি সৈয়দ নাসিরউদ্দিন ও ভাগ্নে সিকান্দার খান গাজীকে পাঠালেন গৌড় রাজ্য দখল করতে। একই সময়ে দিল্লি থেকে ইসলাম প্রচারের জন্যে সুফি সাধক শেখ জালাল উদ্দিন ও তার ৩৬০ জন অনুসারী নিয়ে গৌড় শহরে এসে পৌঁছান। এরা মূলত ছিলেন তুর্কিস্তান থেকে আগত মুজাহিদবাহিনী যাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল যেসব জায়গায় ইসলাম ধর্ম বিকশিত হয়নি বা হিন্দুরাজ্য রয়েছে তাদের ওখানে ইসলাম প্রচার করা।

সিলেট যে সহস্র বছর পুরনো পরিকল্পিত শহর তা শহরের বিভিন্ন পাড়া ও মহল্লার নামের দিকে খেয়াল করলেই সহজে বোঝা যায়। রাজা গৌড় গোবিন্দ শ্রীহট্টের লোহারপাড়ায় যুদ্ধাস্ত্র বানাতেন যেসব কামার দিয়ে তাদের দলপতিকে খবর পাঠালেন যাতে যুদ্ধাস্ত্র শাণিত হয়। দাঁড়িয়াপাড়ার মাঝিমাল্লাদের বললেন সব নৌকা শ্রীহট্টের উত্তর পাড়ে বেঁধে রাখতে যাতে সুরমা নদী পার হতে না পারে শত্রুবাহিনী। তোপখানার কামান প্রস্তুত রাখতে নির্দেশ দিলেন। মজার বিষয় হলো তাঁতিপাড়ায় তৈরি হতো রাজা গৌড় গোবিন্দের রাজকীয় পোশাক-আশাক, সেইসব পোশাক ধোয়া হতো ধোপাদিঘিতে। জল্লারপাড়ে থাকত জাউল্লা বা জেলে সম্প্রদায়, কুমারপাড়ায় তৈজসপত্র বানাতো কুমোররা। হাওয়াপাড়ায় থাকতো পাখাটানা লোকজন, কাষ্ঠঘরে কাঠের গুদাম যার পাশেই রয়েছে শ্মশান, ব্রাহ্মণপাড়ায় ব্রাহ্মণরা। এছাড়া নদীবন্দরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বন্দর বাজার। পাশেই ছিল কালীঘাট যেখানে মা কালীর পূজা হতো। এছাড়া ব্রাহ্মণপাড়া, কায়স্থপাড়াও ছিল শহরে।

চাঁদনিঘাটের দিকে হামলা করে ব্যর্থ হয়ে সৈয়দ নাসিরউদ্দিন শেখ জালাল উদ্দিন (রহ.) এর পরামর্শে বর্তমান শেখঘাটের দিকে নৌকা জোড়া দিয়ে বানানো হয় ভ্রাম্যমাণ সেতু যেটা দিয়ে শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের সৈন্যরা শ্রীহট্ট শহরর প্রবেশ করে। এটা রাজধানীর পেছন দিক হওয়ায় গৌড় গোবিন্দ গুরুত্ব দেননি। তবে জায়নামাজ দিয়ে নদী পাড় হওয়ার প্রচলিত একটা মিথ রয়েছে ধারণা করা হয় শেখঘাট দিয়ে শেখ জালাল উদ্দীন ওরফে হযরত শাহজালাল (রহ.) জায়নামাজ দিয়ে সুরমা নদী পার হন। ধারণা করা হয় নদীর দক্ষিণ পাড়ে তাবু গেড়ে স্থানীয় মানুষদের দিয়ে নৌকার ব্রিজ তৈরি করা হয় রাতের আঁধারে। যেহেতু গৌড় গোবিন্দ পাহাড় থেকে নেমে আসা মঙ্গোলয়েড বংশোদ্ভূত রাজা ছিলেন এবং রাজকর আদায় করতে আশেপাশের প্রজাদের অত্যাচার ও নিপীড়ন করতেন ফলে প্রজারা ক্ষুব্ধই ছিল রাজার উপরে। তাই বিদেশী আক্রমণকে স্থানীয়রা স্বাগতই জানায়। এভাবেই লালেং বা পাত্র সম্প্রদায়ভুক্ত রাজা গৌড় গোবিন্দের পতন হয়।

শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ শেখ জালাল উদ্দিনকে শ্রীহট্টের শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। শেখ জালাল উদ্দিন শ্রীহট্টের নাম জালালাবাদ ঘোষণা করে নিজেকে জালালাবাদের শাহ বা বাদশাহ ঘোষণা করে নাম ধারণ করেন শাহ-ই-জালাল যা তার মৃত্যুর পর ভক্তরা হযরত শাহজালাল (রহ.) নামে ভক্তিসহকারে স্মরণ করেন। শেখ জালাল উদ্দিন শ্রীহট্টের বিভিন্ন জায়গা শাসন করতে, প্রজাদের নিকট থেকে কর আদায় করতে ও ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে ৩৬০ জন সহযোগীর মধ্যে বেশিরভাগকেই রাজধানীর বাইরে পাঠান। এভাবেই সিলেট অঞ্চলে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটে। শ্রীহট্টের শেষ স্বাধীন নৃপতি গৌড় গোবিন্দের রাজবাড়ীতে এখন সিলেট জজ কোর্টের বিচারপতির বাসভবন যা অগ্রহণযোগ্য। এরকম প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা সংরক্ষণের দায়িত্ব সিলেটের দলমত নির্বিশেষে সবার। জজদের বাসভবন অন্যত্র সরিয়ে রাজবাড়ীকে পুরাতাত্ত্বিক স্থাপনা ঘোষণা দিয়ে দর্শনার্থীদের জন্যে উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্যে সবার কাজ করা উচিত।

১৮৭৪ সালে নবসৃষ্ট আসাম প্রদেশের রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে বৃটিশরাজ বাংলা থেকে বৃহত্তর গোয়ালপাড়া ও সিলেট জেলাকে কেটে আসামের অন্তর্ভুক্ত করে। ১৯০৫ সালে বাংলা ভাগ করে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ - আসাম প্রদেশ তৈরি করা হলে সিলেট আবার পূর্ববঙ্গে ফিরে আসে কিন্তু এই ফিরে আসা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হলে সিলেট জেলাকে আবার আসামে সংযুক্ত করা হয়। ১৯৪৭ সালে সিলেটের বাংলাভুক্তির সুবর্ণ সুযোগ আসে।

এই সময় সিলেট জেলার ছিল পাঁচটি মহকুমা—উত্তর শ্রীহট্ট (সিলেট), করিমগঞ্জ, হবিগঞ্জ, দক্ষিণ শ্রীহট্ট (মৌলভীবাজার) ও সুনামগঞ্জ। গোটা বাংলা ও পাঞ্জাবে গণভোট না হলেও সিলেটে গণভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। এই গণভোটের পেছনে আসামের মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বড়দলৈ এর বিরাট ভূমিকা রয়েছে। তিনি চেয়েছিলেন বাঙালি অধ্যুষিত সিলেট জেলা পাকিস্তানভুক্ত হলে তারা শান্তিতে অহমীয়া রাজ্য ও শাসন চালাতে পারবেন আসামে। গণভোটে কংগ্রেস ‘কুঁড়েঘর’ প্রতীক নিয়ে ভারতের পক্ষে এবং মুসলিম লীগ ‘কুড়াল’ প্রতীক নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে ভোটের লড়াইয়ে নেমেছিল। যদিও দেওবন্দী কওমিরা কংগ্রেসের সাথে তাল মিলিয়ে ভারতেই সিলেটকে রাখতে চেয়েছিলো। এছাড়া গণভোটে পাকিস্তানে সিলেট জেলা আসলে সিলেটকে প্রদেশে উন্নীত করার এক প্রতিশ্রুতি মুসলিম লীগ নেতাদের ছিল কিন্তু তা আর বাস্তবায়ন করা হয়নি।

গণভোটে মোট ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৮১৫ জন ভোট দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ জুলাই সিলেট জেলাজুড়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানে থাকার জন্য কুড়াল প্রতীকে ভোট পড়ে ২ লাখ ৩৯ হাজার ৬১৯টি। অন্যদিকে আসামে থাকার জন্য কুঁড়েঘর প্রতীকে ভোট পড়েছিল ১ লাখ ৮৪ হাজার ৪১টি। পাকিস্তানে থাকার পক্ষে ভোট বেশি পড়ে ৫৫ হাজার ৫৭৮টি। ফলাফল ঘোষণার পর বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কোনো ঘটনা সিলেটে ঘটেনি। গণভোটে সিলেট জেলার চারটি মহকুমা পাকিস্তানের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট দিলেও দক্ষিণ শ্রীহট্ট (মৌলভীবাজার) মহকুমায় ৩৩,৪৭১ জন ভারতের পক্ষে ও ৩১,৭১৮ জন পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেয়। সেক্ষেত্রে দক্ষিণ শ্রীহট্ট ভারতভুক্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু মনিপুর, মিজোরাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের যাতায়াতের সুবিধার্থে করিমগঞ্জ মহকুমা ভারতভুক্তি জরুরি ছিল। ফলে কুশিয়ারার ওপারের থানা নিয়ে করিমগঞ্জ মহকুমা ভারতভুক্ত হয় আর দক্ষিণ শ্রীহট্ট (মৌলভীবাজার) পাকিস্তান তথা সিলেট জেলায় থেকে যায়।

শ্রীহট্ট যদি আজ আসামের অন্তর্ভুক্ত থাকতো তাহলে আমাদের অবস্থার উন্নতি হতো কি না? আসাম প্রদেশ ভারতের বিচ্ছিন্ন এক প্রদেশ যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের তেমন কোনো মনোযোগ নেই। তাছাড়া আসামে জাতিগত দাঙ্গা ও হানাহানি থাকায় রাজনৈতিক অবস্থাও অস্থিতিশীল। ফলে বড়সড় বিনিয়োগ হচ্ছে না। সর্বোপরি আসামের অবকাঠামোগত উন্নয়ন খুবই নিম্নমানের। সেই হিসেবে বলতে গেলে সিলেট বিভাগের উন্নয়ন একেবারে খারাপ না। তবে শিল্প-কারখানায় সিলেট পিছিয়ে আছে এটাও সত্য। ১৯৪৭ থেকে ২০২১ দীর্ঘ ৭৪ বছরে সিলেটের যে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত