জাহাঙ্গীর নোমান

২৬ জুলাই, ২০২১ ২৩:৩৭

ছাতক জেলা বাস্তবায়ন কেন জরুরি

৩৬৭০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত সিলেট বিভাগের বৃহত্তম জেলা সুনামগঞ্জ জেলা। সুনামগঞ্জে রয়েছে ১২টি উপজেলা। ফলে প্রশাসনিক বিষয় থেকে শুরু করে নানাভাবে সুনামগঞ্জ সদর থেকে এত বড় জেলা পরিচালনা করা অনেকটাই অসম্ভব। এর ফলে সমগ্র জেলায় সুষম উন্নয়নও হচ্ছে না। তাছাড়া হাওর অধ্যুষিত জেলা হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থাও অত্যন্ত খারাপ। বাংলাদেশের আর কোনো উপজেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহালদশা সুনামগঞ্জের মতো না। তাছাড়া সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনও শক্ত নয়। খাদ্যাভ্যাসেও ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া রাজনৈতিক বিভাজনও অন্যান্য জেলার তুলনায় খুবই বেশি।

সিলেট জেলায় ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ছাতক থানা। ১৯৭৬ সালে ছাতক থানা ভেঙে দোয়ারাবাজার ও কোম্পানিগঞ্জ নামক দুইটি থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্প্রতি ছাতক থানার অন্তর্গত জাউয়াবাজার পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রকে জাউয়াবাজার উপজেলা ও জাহিদপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রকে দক্ষিণ ছাতক উপজেলায় উন্নীত করতে সুপারিশ করেছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী। মোট ২৪টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে বৃহত্তর ছাতকের আয়তন ৮৩০ বর্গ কিলোমিটার যা নারায়ণগঞ্জ জেলা (৬৮৩ বর্গ কিমি), মেহেরপুর জেলা (৭১৬ বর্গ কিমি) ও ঝালকাঠি জেলা (৭৫৮ বর্গ কিমি) এর চেয়ে বেশি এবং ফেনী জেলা (৯২৮ বর্গ কিমি), মুন্সিগঞ্জ জেলা (৯৫৫ বর্গ কিমি), নড়াইল জেলা (৯৯০ বর্গ কিমি), জয়পুরহাট জেলা (৯৬৫ বর্গ কিমি) এর চয়ে সামান্য বেশি।

ছাতক অর্থনৈতিকভাবে দেশের জন্যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা জানতে হলে একটু অতীতে যেতে হবে। ১৭৭৪ সালে এইচটি রাইট ও জর্জ ইংলিশ নামে দু'জন ব্রিটিশ নাগরিক ব্যবসার জন্য ছাতক শহরে এসে 'রাইট ইংলিশ কোম্পানি' নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করেন। তারা এ কোম্পানির মাধ্যমে ছাতক থেকে পাথর, চুন, তেজপাতা ও কমলালেবু সরবরাহ করতেন ব্রিটেনে। এই চুনাপাথর মূলত মেঘালয় থেকে সরবরাহ করা হতো। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৭ সালে উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম সিমেন্ট ফ্যাক্টরি হিসেবে আসাম-বেঙ্গল সিমেন্ট ফ্যাক্টরি উৎপাদন শুরু করে ছাতকে। পরবর্তীতে বাংলাভাগ হলে নাম পাল্টে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি নামকরণ করা হয়।

এরপর ১৯৭৭ সালে কাঁচামালের সহজলভ্যতার জন্যে চালু হয় সিলেট পাল্প এন্ড পেপার মিল। ২০০৩ সালে ছাতকে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ করে ফ্রান্সভিত্তিক লাফার্জ সিমেন্ট উৎপাদন গ্রুপ যা এখন সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক লাফার্জ-হোলসিম নামে পরিচিত। এরপর আকিজ প্লাস্টিক ফ্যাক্টরি, নিটল-নিলয় পেপার মিলসহ নানা উৎপাদন কারখানা স্থাপিত হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের যৌথ বিনিয়োগে সৌদি-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ সিমেন্ট কোম্পানি নামে একটি আধুনিক সিমেন্ট কারখানা স্থাপনের লক্ষ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট বাংলাদেশের বিসিআইসির সাথে ৩,০০০ কোটি টাকার যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।

সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। ২০১৯ সালে মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমার অনুরোধের প্রেক্ষাপটে ছাতক-মেঘালয় সীমান্তে 'ছাতক অর্থনৈতিক অঞ্চল' প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসলামপুর ইউনিয়নের হাদা-চানপুর মৌজায় ২৯০০ একর জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে মেঘালয়সহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করা হবে।

যোগাযোগ ব্যবস্থার দিক দিয়ে সিলেট অঞ্চলে ছাতক উপজেলাই সবদিক দিয়ে অনুকূলে। সড়কপথে যেমন ঢাকার সাথে যোগাযোগ রয়েছে তেমনি জলপথেও নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের সাথে যোগাযোগ রয়েছে। রেলপথেও ঢাকার সাথে যোগাযোগ বিদ্যমান। এছাড়া ছাতক-কোম্পানিগঞ্জ সড়ক পুরোদমে চালু হলে মাত্র আধা ঘণ্টায় সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছা সম্ভব। তাছাড়া দোয়ারাবাজার, জাউয়াবাজার ও জাহিদপুরের সাথেও ছাতকের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ রয়েছে।

ছাতক যেমন বাণিজ্য নগরী তেমনি প্রস্তাবিত ছাতক জেলার জাউয়াবাজার, দোয়ারাবাজার, গোবিন্দগঞ্জ, দোলারবাজার ও বাংলাবাজারেও প্রচুর মানুষের সমাগম হয় যা থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পায়। অর্থাৎ প্রস্তাবিত ছাতক জেলার অর্থনৈতিক ভীত যথেষ্ট শক্ত। আর নদীবন্দর থাকায় জলপথ থেকে সরকার রাজস্ব আদায় করতে পারে। তাছাড়া সুনামগঞ্জ থেকে দোয়ারাবাজার হয়ে কোম্পানিগঞ্জ পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হলে প্রস্তাবিত ছাতক জেলায় অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি পাবে। ফলে একটা জেলার নিজস্ব আয় দিয়েই জেলার উন্নয়ন কার্যক্রম চালানো সম্ভব।

ছাতক জেলার দাবি নতুন নয়। ১৯৮৪ সালে যখন সিলেট জেলার চারটি মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয় তখন ছাতককেও জেলা করার দাবি উঠে। মুক্তিযুদ্ধকালে ছাতকের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য শামসু মিয়া চৌধুরী এমপিএ, দোয়ারাবাজার উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ ইদ্রিস আলী বীরপ্রতীক ও কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মদরিছ আলীসহ সর্বস্তরের জনতা ছাতক জেলা বাস্তবায়নের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে ছাতক জেলার দাবিতে মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। সর্বশেষ ২০২০ সালে ছাতকের আইনজীবীদের উদ্যোগে ছাতক জেলা বাস্তবায়নের দাবিতে সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। অর্থাৎ ঐতিহ্যবাহী ছাতক অঞ্চলকে জেলা বাস্তবায়নে দলমত নির্বিশেষে সবাই একাট্টা। সবার দাবিকে আমলে সরকার নিশ্চয় ছাতককে জেলা ঘোষণা করবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত