মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

০১ ফেব্রুয়ারি , ২০২৩ ১৩:০২

আত্মহত্যা-অপরাধ ও ইতিহাস

আত্মহত্যা কি শুধু modern crisis? নাকি সমাজের সিস্টেমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ? নাকি জীবন আর মৃত্যুর মতোই মানব-অস্তিত্বের এক অপরিহার্য অংশ? ৭৩ সালে মাসাদায় ১০০০ ইহুদি আত্মহত্যা করে রোমান অধিকার ও দাসত্বে থাকার প্রতিবাদে। ওল্ড টেস্টামেন্টে চার ব্যক্তির আত্মহত্যার কথা বলা আছে : স্যামসন, শৌল, অবিমেলক ও অহিয়থোপেল। নিউ টেস্টামেন্টে জুডাস আত্মহত্যা করে। সিমোন দি বোভোয়ার তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ আ ইজি ডেথ-এ বলেন, 'মানুষের জীবনের মতোই মৃত্যু একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। মানুষের চারপাশের বাস্তবতা যখন অর্থহীন হয়ে উঠে মৃত্যুই অর্থবহ হয় প্রতিবাদস্বরূপ।

গ্রিক পুরান ভর্তি হয়ে আছে আত্মহত্যার কাহিনিতে। রোমান দৃষ্টিতে আত্মহত্যা হচ্ছে আদর্শ নির্গমনের পথ। সেনেকা আত্মহত্যাকে বলেছেন 'মন্দের সমাপ্তি'। সেনেকারা মৃত্যুর সমর্থন দিতেন। সেনেকা বলেন—'যখন বুঝব আমার দুঃখের শেষ নেই, তখন জীবন থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়াব।'

ম্যাকবেথ-এর পঞ্চম অঙ্কে ম্যাকবেথের উক্তি ছিল—'রোমান যোদ্ধারা মরব না হয় নিজের অসিতে', অর্থাৎ রোমানরা পরাজয় বা মর্যাদা রক্ষার জন্য আত্মহত্যা করত। উল্লেখ্য শেক্সপিয়ারের নাটকে ৫০-এর বেশি আত্মহত্যার ঘটনার কথা আছে।

জাপানে বা উন্নত দেশে দলবেঁধে সুইসাইড পয়েন্টে আত্মহত্যা করার প্রবণতাও প্রাচীন। তখন ব্যর্থতা বা কর্তব্যচ্যুত অবস্থায় লজ্জা থেকে বাঁচার জন্য সংগঠিত আত্মহত্যা করত। এরা "হারাকিরি" মর্যাদা লাভ করত।

সমাজবিজ্ঞানী এমিলি দুরকহাইম তার বিখ্যাত গ্রন্থ সুইসাইড-এ চার ধরনের আত্মহত্যার কথা বলেন- ইগোয়িস্টিক, ম্যানিয়াক, এ্যানোমিক, পরার্থবাদী অলট্রুইসটিক। ইগোস্টিক সুইসাইড ঘটে যখন ব্যক্তি তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না। এক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজেকে outsider ভাবে।

অলট্রুইসটিক আত্মহত্যা আগেরটার বিপরীত। এক্ষেত্রে ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমূহ সমাজের সিস্টেমের বিরুদ্ধে বা একটা সমাজ-গোষ্ঠীর জন্য, সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ ত্যাগ করে। সক্রেটিস, ১০০০ ইহুদির আত্মহত্যা এ ধরনের।

ম্যানিয়াক আত্মহত্যা সংস্কৃতিগত, জাতির প্রবণতা। দুইশ বছর আগেও আত্মহত্যাকে 'ইংরেজ অসুস্থতা' বলে ইউরোপীয়রা অভিহিত করত। ফরাসিরা ইংরেজদের বলত আত্মহত্যাপ্রবণ।

মন্টেস্কু দি স্পিরিট অব দি ল-তে বলেন, 'রোমানরাও মহৎ কারণে প্রাণ দিত। তবে ইংরেজরা কোনো দায়বদ্ধতা ছাড়াই আত্মহত্যা করে। চরম সুখেও তারা তা করে।' জাপানিরাও প্রতিবছর গড়ে ৩৫ হাজার আত্মহত্যা করে। অনেকে আবহাওয়াকে দায়ী করলেও একই আবহাওয়া সত্ত্বেও সুইডিশদের আত্মহত্যার হার নরওয়ের চেয়ে বেশি।

আধুনিক সমাজের আত্মহত্যার অন্যতম কারণ অ্যানোমিক বা অন্বয়বাদী আত্মহত্যাকে দায়ী করেছে। অ্যানোমিক বা অন্বয়বাদী আত্মহত্যার ক্ষেত্রেও সমাজ-সম্পৃক্ততা রয়েছে। হঠাৎ বিশাল প্রাপ্তি বা চ্যুতি, ব্যাপক ও মারাত্মক লাভ-লোকসান, পারিবারিক বিচ্ছেদ—সব অনুষঙ্গ অ্যানোমিক আত্মহত্যা বলে অভিহিত।

ক্যামু মানুষের হৃদয়ের মুক্তির উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। আত্মহত্যার চিন্তা খুব কম সময়ের। তবুও ঘটে। কোথা থেকে সংকট দেখা দেয় তা অজানাই থাকে। মূলত এক অজানা অদৃশ্যে জন্ম নেয়া এক পোকা কুট কুট করে কেটে দেয় বাঁচার অদ্ভুত স্নায়ুমণ্ডলীকে।

ফ্রয়েড বিয়ন্ড দি প্লেজার প্রিন্সিপাল-এ আত্মহত্যা বিষয়ে বলেন—'মানুষ আত্মহত্যা পছন্দ করে না। তবে প্রত্যেকটা মানুষের মনে death instinct (মৃত্যুর প্রবণতা) আছে। আমাদের স্বাভাবিক সত্তার ভেতর এক ইচ্ছামৃত্যু আছে। মানুষ জীবনে অসংখ্যবার আত্মহত্যা করতে চায়। প্রতীকী অর্থে বহুবার করেও। তাই সব মৃত্যুই ছদ্মবেশী আত্মহত্যা।'

Of human bondage-এ মম বলেন- 'মানুষকে ল, পাবলিক অপিনিয়ন, কনসিয়েন্স বাধা দিয়ে রেখেছে বলে সে অবদমন করে রাখে মৃত্যু ইচ্ছাকে।' ভ্যানগগ একবার মপাসাঁকে বলেন- একটা রিভলবার দাও তো, এই জীবন আর ভালো লাগে না।' উল্লেখ্য, অসংখ্য সাহিত্যিক আত্মহত্যা করে এবং অনেকে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।

আলভেজ তাঁর বিখ্যাত বই দ্য সেভেজ গড-এ দুই হাজার বছর ধরে ইতিহাস ও সাহিত্যে আত্মহত্যার দিকটি তুলে ধরেন। মধ্যযুগ থেকে রেনেসাঁ হয়ে যুক্তির যুগ এবং রোমান্টিক কালের আত্মহত্যার কথা ব্যাপকভাবে এসেছে। বস্তুত উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর স্মরণীয় ও বরণীয় লেখকই হ্যামলেটের মতো মৃত্যুতে আবিষ্ট কিংবা আত্মহত্যাস্পৃষ্ট।

সাহিত্যও আত্মহত্যাকে একটা শৈল্পিক রূপ দিয়েছে। সিলভিয়া প্লাথ বলেন—'মৃত্যুবরণ এক শিল্প, অন্যসব কিছুর মতোই আমি তা চমৎকারভাবে করি।' রোমান্টিকদের কাছে মৃত্যু ছিল এক সাহিত্যিক সম্পাদন। ১৮৩০ সালের দিকে ফ্রান্সে রোমান্টিকরাই মৃত্যুকে সবচেয়ে জনপ্রিয় করে তোলেন। দাদাবাদী জাক ভাশে বলেছিলেন- 'যুদ্ধে মারা যেতে আমার আপত্তি, আমি তখনই মরব যখন মরে যেতে চাই।' মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা-য় যাদবের এক অদ্ভুত ইচ্ছেমৃত্যুর দেখা পাই, যে তার মৃত্যুর দিবস, ক্ষণও ঠিক করে রাখে।

আবার অনেকেই আছেন সবকিছু থাকার পরও আত্মহত্যা করে। নাম, যশ, প্রতিপত্তি থাকার পরও হঠাৎ জীবন দিয়ে ফেলে। মনোবিজ্ঞানীরা এটাকে বলে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার। সুস্থ মানুষ ডিপ্রেশনে ভোগে। তবে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত মানুষ কখন কী করে আদৌ বলা সম্ভব নয়। মানুষের মস্তিষ্ক যে অর্ডারে চলার কথা তাদের মস্তিষ্ক সেভাবে চলে না। এরকম মনোরোগীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিভাবান হতে পারেন। প্রচণ্ড ধনী এবং সফল অভিনেতা রবিন উইলিয়ামস আত্মহত্যা করেছিলেন। সুইডেনের এক তরুণ ফিল্মমেকার ডকুমেন্টারি ছবি বানিয়ে অস্কার পুরস্কার জিতেছিলেন। চারদিক থেকে প্রশংসা পাচ্ছিলেন। দ্বিতীয় ছবি বানানোর জন্য প্রচুর টাকাও পাচ্ছিলেন। দ্বিতীয় ছবিটি যখন বানাচ্ছিলেন, স্যুটিং স্পট থেকে একদিন সোজা হেঁটে গেলেন রেললাইনে, রেলগাড়ি আসছে দেখে ঝাঁপ দিলেন। আত্মহত্যা করলেন।

প্রাচ্যের দিকে তাকালে, আত্মহত্যার এত মর্মান্তিক ইতিহাস নেই। যদিও 'মনুসংহিতা' হিন্দুদের অন্যতম বিধানগ্রন্থ বা কোড তবু মহাভারত-এ পাওয়া যায়, মানুষ দুঃখ-দুর্দশার ফলে আত্মহত্যা করে। উল্লেখ আছে, 'দেহধারী জীব বিপরীত বুদ্ধির বশে অসৎ কর্মে প্রবৃত্ত হয়; সে অতিভোজন করে বা অনাহারে থাকে, পরস্পরবিরোধী বস্তু ভোজন ও পানাহার করে, ভুক্ত খাদ্য জীর্ণ না হতেই আবার খায়, দিবসে নিদ্রা যায়, অতিরিক্ত পরিশ্রম বা স্ত্রী-সংসর্গের ফলে দুর্বল হয়ে যায়। এইরূপে বায়ুপিত্তাদির প্রকোপিত করে এবং পরিশেষে প্রাণান্তকর রোগের কবলে পড়ে। কেউ কেউ উদ্বন্ধনাদির দ্বারা আত্মহত্যা করে।' তবে রামায়ণ, মহাভারতে ইচ্ছামৃত্যু চোখে পড়ে। প্রাণত্যাগের উল্লেখ আছে, যা প্রাচীন রোমানদের সাথে মেলে। যদিও ইসলাম ও হিন্দুধর্মে আত্মহত্যা নিষিদ্ধ। মূলত প্রাচ্যের দর্শনে আত্মহত্যার বীভৎসতা নেই। এর মূল কারণ, এখানকার দর্শনে মানুষ আত্মমগ্নতা, ধ্যান, নির্বাণ তত্ত্ব, বৈষ্ণববাদ, সুফিবাদের প্রভাবে আত্মার ভেতর ডুব দিয়ে একজন তপসী বা সাধক হয়ে জন্ম নেয়। সুখে, দুঃখে নির্বিকার থাকার এক চৈতন্যবোধ বা প্রাচীন গ্রীসের stoicism যেটাকে বলে। জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিশে যাবার এক আকুতি প্রাচ্যের মানুষকে বাউল সাধকে রূপান্তরিত করত।

অন্যদিকে ফ্রয়েড, জাং, এডলারদের সাইকো-এ্যানালাইসিস মেথড মানুষের মনোবৈকল্য, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, নিহিলিজম খুঁড়ে বের করে, যা অধুনা মনোবিদদের দ্বারা একটা ব্যবসা ছাড়া আর কিছু না বলে প্রমাণিত হয়েছে। যেমন—আত্মহত্যা, ডিপ্রেশন থেকে বাঁচার জন্য মোটিভেশনাল স্পিচ, বই, ইউটিউব গুরু, থেরাপি, মনোবিজ্ঞানী কোনো কাজে আসে না। এই মোটিভেশনাল গুরুরাই (ডেল কার্নেগি) আত্মহত্যা করেছেন। ফ্রয়েড, যিনি আত্মহত্যার উপর ব্যাপক গবেষণা চালান, উনিও বিষাদে, হতাশায় ১৯৩৯ সালে রোগী দেখা বন্ধ করে দেন। তিনি তার চিকিৎসককে বলেন প্রাণনাশক মরফিন দেয়ার জন্য। সে বছরের সেপ্টেম্বরে মারা যান। তার মৃত্যু তার নিজস্ব ভাষারই অনুরূপ 'এক ছদ্মবেশি আত্মহত্যা'।

'Man is not made for defeat. A man can be destroyed not defeated.' এই বিখ্যাত, মোটিভেশনাল কথা যে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে The old man and the sea-তে বলেন, তিনিও অসংখ্যবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।

তবে এটাও ঠিক, এখন পুঁজিবাদ, শিল্পযুগ আর প্রযুক্তির আশীর্বাদে জীবনের বেগ বাড়লেও মানুষ ধীরে ধীরে আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। এবং এর দূষণ পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এখন মানুষ নীরব ভাষায় বেশি কথা বলে। নিজের সাথে পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার দ্বন্দ্ব সংঘাত, অসহায়ত্ব সবকিছু একধরনের চাপা কান্না হয়ে ভেতরে জমে থাকে। মানুষ যখন কারো সাথে শেয়ার করতে পারে না তখন ধীরে ধীরে সে আরও নীরব হয়ে পড়ে। এটাকে স্পাইরাল অব সাইলেন্স বা ক্লাউড অব সাইলেন্সও বলেছেন গ্রিফিনির মতো অনেক বিশেষজ্ঞরা। এ থেকেও আত্মহত্যার পথ অনেকে বেছে নেয় অনেকে। এখানে বলে রাখা দরকার, প্রাচীন গ্রিস কিংবা রোমানে যে নীরবতার প্র্যাকটিস করা হতো সেটার সাথে আধুনিক যুগের নীরবতার কোনো মিল নেই।

দেখা গিয়েছে ভিন্ন দুটি সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব, আইডেন্টিটি ক্রাইসিসকেই আত্মহত্যার কারণ হিসেবে নিরূপণ করা হয়েছে। গবেষণায় এও উঠে এসেছে যে, ২০০২ সালের পর থেকে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি সেই তরুণীদের মধ্যে যারা তালিবান সরকারের সময় পালিয়ে ইরান বা পশ্চিমা কোনো দেশে গিয়েছিল এবং ২০০২-এ তালিবান সরকারের পতনের পর আফগানিস্তানে ফিরে আসে। গবেষকরা দেখেছে, মেয়েরা দেশ থেকে পালিয়ে ভিন্ন ধারার এক সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়েছিল। তবে আবার যখন পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসে তখন তাদের মাঝে তৈরি হয় তীব্র মানসিক দ্বন্দ্ব।

তাছাড়াও নিজেকে শাস্তি দেয়া, যৌন ঈর্ষা এবং সন্তানের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা, সিস্টেমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, শৃঙ্খল ভাঙতে না পারার ক্ষোভ—সবকিছুই আত্মহত্যার জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করেছেন ইংল্যান্ডের একদল গবেষক। পরিশেষে গ্রেগরি জিলবোর্গ-এর কথা টেনে বলা যায়—'মানব জাতির মতোই আত্মহত্যা প্রাচীন, এটা সম্ভবত নরহত্যার মতোই পুরোনো এবং সব স্বাভাবিক মৃত্যুর মতো শাশ্বত। সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে আত্মহত্যার হার বৃদ্ধি এবং আবহাওয়ার সাথে এর মাত্রা বৃদ্ধি ভিত্তিহীন। আত্মহত্যা পরিসংখ্যানের বিষয়ও নয়। মানুষের মনোজগতে বাস করে দৈনন্দিন জীবনের অসংখ্য মৃত্যুযন্ত্রণা। মূলত আত্মহত্যার ইতিহাস লুকিয়ে আছে সংস্কৃতি, দর্শন, পুরাণ, ও জন-ইতিহাসের গোপন অলিখিত দস্তাবেজে।'

  • মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান: গবেষক, কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য

আলোচিত