মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

১০ ফেব্রুয়ারি , ২০২৩ ১২:৪৫

শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, সমাধান কোন পথে

আত্মহত্যা মানুষের নিজের বিরুদ্ধে একটি আত্মঘাতীমূলক অপরাধ, যা পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্ম ও সভ্যতা নিষিদ্ধ করেছে। তবে আত্মহত্যা নিষিদ্ধকরণ ও দমনে ইসলাম বিধান সামগ্রিক ও অতুলনীয়। ইসলামে মানুষের জান ও মালের প্রকৃত অধিকারী মানুষ নয়; বরং এগুলোকে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে মানুষের নিকট নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আমানত হিসেবে রাখা হয়েছে। আত্মহত্যা কিংবা মালে অপচয় করার মাধ্যমে মানুষ আমানতের খেয়ানত করে আল্লাহ হক বিনষ্টকারী হিসেবে গণ্য হয়। এজন্য স্বীয় আত্মা বিনষ্ট করার অধিকার মানুষের নেই। পাশাপাশি ইসলামে বেঁচে থাকার অধিকারকে মানুষের সর্বোচ্চ মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। তাই জীবন বিনষ্ট করে, জীবনের ক্ষতিসাধন করে এবং জীবননাশের প্রতি উৎসাহিত করে এমন সকল কাজকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। এমনকি মৃত্যু কামনা করাকেও ইসলাম নিষেধ করেছে।

সারাদেশে ২০২২ সালে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন বলে এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এই সমীক্ষার তথ্য বলছে, আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৪০ জন বা ৬৪ শতাংশই স্কুল পর্যায়ের। এছাড়া কলেজ পর্যায়ে ১০৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। সমমান প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাদ্রাসাগামী শিক্ষার্থী রয়েছেন ৫৪ জন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৮৬ জন শিক্ষার্থী এই এক বছর আত্মাহুতি দিয়েছেন এক সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। দেশের দেড় শতাধিক জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টাল থেকে শিক্ষার্থীদের আত্মহননের তথ্য নেওয়া হয়েছে এ সমীক্ষায়।

দেশের আট বিভাগে আত্মহত্যা করা স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে, যা মোট আত্মহত্যার প্রায় ২৩.৭৭ শতাংশ। আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। আত্মহত্যা করা স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৩.৯০ শতাংশ, অর্থাৎ ২৮৫ জনই মেয়ে; বাকি ১৬১ জন, অর্থাৎ ৩৬.১ শতাংশ ছেলে। তথ্য-উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। ২০২২ সালে যে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করেছে, তাদের মধ্যে ৪০৫ জন বা ৭৬.১২ শতাংশই টিনএজার। তাদের মধ্যে ৬৫.৯৩ শতাংশ মেয়ে; ৩৪.০৭ শতাংশ ছেলে। আবার আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের ৪৩ জন বা ৮.০৮ শতাংশের বয়স ছিল ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। তাদের মধ্যে ৪৬.৫২ শতাংশ মেয়ে। আর ছেলেদের সংখ্যা তার চেয়েও বেশি, ৫৩.৪৮ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের সাথে শিক্ষার্থীদের মানিয়ে নিতে প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হতে হয়, সে কারণে ওই বয়সে আত্মহত্যার হার বেশি।

প্রস্তাব: হতাশা, একাকিত্ব ও নেতিবাচক ভাবনা থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে রাখতে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ বৃদ্ধি করা। সন্তানদের মানসিক বিকাশ এবং তাদেরকে সহানুভূতির সাথে শুনতে ও বুঝতে অভিভাবকদের জন্য প্যারেন্টিং কার্যক্রম চালু করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষক-কর্মচারীদের আচরণ ও পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে কৌশলী ও সহানুভূতিশীল হতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। স্কুল, কলেজ পর্যায়ে আত্মহত্যা প্রতিরোধী পোস্টার প্রদর্শন করা। প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনায় পরিবারের ভূমিকা খতিয়ে দেখতে ও দায় বৃদ্ধিতে তাদের আইনি বাধ্যবাধকতার অন্তর্ভুক্ত করা। স্কুল-কলেজের ছাত্রকল্যাণ ফান্ডের কার্যক্রম ত্বরান্বিত করে তা সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আর্থিক সমস্যা সমাধান অনেকাংশে সম্ভব। এতে আর্থিক সংকটজনিত আত্মহত্যার হার কমে আসবে। প্রেম-প্রণয় ঘটিত সম্পর্কে বা অজ্ঞাতসারে ধারণ করা গোপন ছবি, ভিডিও ইত্যাদি প্রচার তথা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ ও সাইবার ক্রাইমের বিষয়ে শাস্তি উল্লেখপূর্বক বিশেষ প্রচারাভিযান পরিচালনা করা। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা সতর্কতা চিহ্ন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। এর মধ্য দিয়ে সম্ভাব্য আত্মহত্যাকারীকে বাঁচানো যাবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেন্টাল হেলথ কর্নার খোলা। শিক্ষার্থীদেরকে বৃত্তির আওতায় এনে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক ট্রেনিং দেওয়া। কার্যকর মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য ক্লিনিক্যাল সুবিধার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা। শিক্ষার্থীদের আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল ও ধৈর্য্যশীলতার পাঠ শেখানো।

দেশের প্রাচীনতম ও সর্ববৃহৎ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৪ বছরে ২৩ জন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আত্মহত্যার কারণ জানার দায়িত্ববোধ করছে না। অপরদিকে, নিহত শিক্ষার্থীদের পরিবার-পরিজন এবং সহপাঠীদের সূত্রে জানা যায়- বিষণ্ণতা, শিক্ষাজীবন নিয়ে হতাশা, কর্মজীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা, সম্পর্কের টানাপড়েন প্রভৃতি কারণে তারা আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। শুধু ঢাকায় নয়, রাজধানীর বাইরেও বিশ্ববিদ্যালয়-ছাত্রের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ, গত সোমবার শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এই উদ্বেগজনক প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মনোবিজ্ঞানী বলেছেন, ‘বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী খাপ খাওয়ানোর সমস্যা নিয়ে এখানে ভর্তি হয়। অনেকে আসে কিছু সমস্যা নিয়ে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- পরীক্ষাভীতি, মানসিক চাপ, বিষণ্নতা, সম্পর্কের জটিলতা ও ভাঙন প্রভৃতি।’ অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ৩০ জন শিক্ষার্থী তাদের কোর্সের অংশ হিসেবে ছয় মাস কাজ করছেন পরামর্শদান দপ্তরের খণ্ডকালীন পরামর্শদাতা হিসেবে। ঢাবির ভিসি জানান, পরামর্শদান দপ্তরে জনবল বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। তাছাড়া, সম্প্রতি সব শিক্ষককে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানানো হয়েছে, তারা যেন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের জীবন ও এর গুরুত্ব প্রসঙ্গে প্রেরণাদায়ী বক্তব্য রাখেন।

কলেজ-ভার্সিটির শিক্ষার্থী তথা তরুণসমাজ জাতির ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি। তারাই আগামী দিনে রাষ্ট্রের হাল ধরবেন। তাই তাদের মানসিক সুস্থতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ার জন্য তাদের পর্যাপ্ত অনুপ্রেরণা প্রদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের রয়েছে বিরাট ভূমিকা। দেখা যাচ্ছে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নিচের দিকে বহু শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে ছাত্রজীবন থেকে। আর ওপরের দিকে অনেকে একেবারে ইহজীবন থেকেই চিরতরে ঝরে পড়ছেন আত্মহত্যার মাধ্যমে। দুটোই আমাদের দেশ ও জাতির জন্য খুবই উদ্বেগজনক। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই যদি শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণ জানার কোনো প্রয়াস না থাকে এবং মানসিক বিষয়ে পরামর্শদানকারী থাকেন খুব নগণ্য, তাহলে বাংলাদেশের অন্যান্য উচ্চশিক্ষালয়ে এ ক্ষেত্রে কী অবস্থা বিরাজ করছে, তা সহজেই বোধগম্য। কিন্তু এমন অবস্থা আর চলতে দেয়া যায় না।

আমরা মনে করি, যেকোনো শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা কিংবা এজন্য চেষ্টা করার কারণ জানা এবং সে মোতাবেক অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া অপরিহার্য। এ জন্য অন্তত সব ক’টি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্তসংখ্যক কাউন্সিলর বা পরামর্শদাতাসহ আলাদা দপ্তর খোলা উচিত। তদুপরি, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, শিক্ষাঙ্গনের বৈষম্যমুক্ত সুষ্ঠু পরিবেশ এবং শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত-পারিবারিক সমস্যা দূর করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ থাকা দরকার।

ইসলাম মানুষের দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ; তার জান, মাল, দীন, বিবেক-বুদ্ধি ও পরিবারসহ সকল কিছুর সংরক্ষণের বিধান প্রণয়নের মাধ্যমে তাদেরকে সর্বাপেক্ষা সম্মানিত করেছে। ইসলাম মানবজীবন সুরক্ষায় হালাল পানাহারের নির্দেশ দিয়েছে; বৈধ বিবাহ প্রথার নির্দেশনা দিয়েছে; পারিবারিক শৃঙ্খলা ও অর্থায়নের বিধান রচনা করেছে; অনন্যোপায়ে জীবন বাঁচাতে নিষিদ্ধ পানাহারের অনুমোদন দিয়েছে; আক্রান্ত হওয়ার আগেই রোগ প্রতিরোধের নির্দেশনা দিয়েছে;আত্মরক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছে। পাশাপাশি জীবন সুরক্ষার পরিপন্থী অবৈধ যৌনাচারকে ইসলাম হারাম করেছে; মানব হত্যাকে সর্বোচ্চ অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং মানুষের দৈহিক ক্ষতিসাধনকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আত্মঘাতী হামলার নিষিদ্ধকরণে ইসলাম আত্মহত্যা, মানব হত্যাসহ সকল প্রকার হত্যাকে সর্বোচ্চ বড় অপরাধের তালিকায় এনে এটিকে কুফরি হিসেবে আখ্যায়িত দিয়েছে। শুধু তাই নয় বরং হত্যার সহায়ক সকল কাজকে হারাম করেছে। পাশাপাশি মানব হত্যার যথোপযুক্ত দণ্ডবিধি রচনা করেছে।

  • মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান: গবেষক, কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য

আলোচিত