মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

২৩ মার্চ, ২০২৩ ১৮:৫০

আকাশে বাঁকা চাঁদ, বহু প্রতীক্ষার এসেছে রমজান মাস

আকাশে বাঁকা চাঁদ, রমজানে বহু প্রতীক্ষার মাস আগমন করেছে, আমাদের মাঝে এলো, শুরু হলো, রমজান মুমিনের রহমত, মাগফেরাত, নাজাতের মাস। আল্লাহর সঙ্গে প্রেমের সেতুবন্ধনের মাস। সকল চাওয়া-পাওয়া, ক্ষমা-মুক্তি, ইবাদত-বন্দেগি ও নৈকট্য লাভের মাস। সিয়াম-সাধনা ও ইবাদতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাস এটি। ইসলামের পঞ্চম ভিত্তির তৃতীয়টি হলো রোজা। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান নর-নারীর প্রতি মাহে রমজানের রোজা পালন ফরজ। একজন মুসলিমের জন্য নামাজের মতোই ফরজ রমজান মাসের রোজা পালন করা।

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা পরহেজগার হতে পার! হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা পরহেজগারি অর্জন করতে পার।’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৩)

অন্যত্র বলা হয়েছে, আমরা তা নাযিল করেছি কিয়ামতের রাতে শক্তির রাত কী তা সবাই জানে কদরের রাত- বা যখন কুরআন নাজিল হয়েছিল- হাজার রাতের মূল্য ‘অবশ্যই আমি এ কোরআনকে লাইলাতুল কদরে নাজিল করেছি। আপনি জানেন লাইলাতুল কদর কী? তা হচ্ছে এমন রাত যা হাজার মাস থেকে উত্তম।’ (সূরা কদর আয়াত ১-৩)।

এভাবেই পবিত্র কোরআনে রমজান মাসের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। রমজান মাসের সঙ্গে অন্য কোনো মাসের তুলনা নেই। এ মাসের প্রতিটি আমলেরই ১০ গুণ সওয়াব বান্দার আমলনামায় লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে।

এ ছাড়া সমাজসংস্কারেও রমজানের ভূমিকা অন্যতম। রমজানের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে একজন মানুষ হয়ে উঠে প্রকৃত মুমিন। স্বচ্ছ পানির মতো হয়ে তার আমলের দরিয়া। প্রতিশ্রুতি উঠে সকল পাপ-পঙ্কিলতা মুছে ফেলার। সকল প্রকার জুলুম অন্যায় থেকে বেঁচে থাকার জাগরণ উঠে। আত্মশুদ্ধির সিঁড়ি বেয়ে উঠে বিপ্লবের পতাকা। এ ধরনের আবেগ অনুভূতির মাধ্যমেই রমজানের মাহাত্ম্য প্রকাশ পায়। ব্যক্তি ও সমাজ তাদের সম্মান ফিরে পায়। তবে মাহে রমজানে পুণ্যের বদলে, পাপ ও বক্রতা কারো কারো জীবনে বেড়ে যায়, তবে এটা নিশ্চয়ই একটি আত্মিক পরাজয়, এটা নিশ্চয় শয়তানের ক্রীড়া, যার বিরূপ প্রভাব ব্যক্তি ও সমাজের ওপর পড়তে বাধ্য।

এ মাসে পার্থিব চাহিদা বিসর্জন
এ মাসে বান্দা পার্থিব সকল চাহিদা বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর দয়া ও রহমত লাভ করবে, অতীতের সকল পাপাচার থেকে ক্ষমা চেয়ে নতুনভাবে ঈমানি জীবনের উত্তাপ গ্রহণ করবে, তাকওয়ার অনুশীলনের মাধ্যমে পুরো বছরের ইবাদত ও আনুগত্যের শক্তি সঞ্চয় করবে, চিন্তা-চেতনা ও কর্ম-সাধনায় আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে সমর্পিত করবে এই হচ্ছে মুমিনের মাহে রমজান। এই পবিত্র মাসের বিশেষ ফরজ ইবাদত হচ্ছে রোজা। ঈমানের পর যে চারটি বিষয়কে ইসলামের রোকন বলা হয়েছে রোজা তার অন্যতম। কাজেই যার ওপর রোজা ফরজ এমন প্রত্যেকের কর্তব্য, যত্নের সঙ্গে এই ফরজ ইবাদতটি আদায় করা। ইসলামে ফরজ ইবাদত-আমলের গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি, এর মাধ্যমেই অর্জিত হয় আল্লাহর সবচেয়ে বেশি নৈকট্য। কাজেই নফল ইবাদত-আমলে কিছু ত্রুটি হলেও ফরজ-ওয়াজিবে ত্রুটি হওয়া উচিত নয়; বরং গুরুত্বের সঙ্গে তা পালন করা উচিত। একইসঙ্গে কর্তা ব্যক্তিদের দায়িত্ব রোজাদার কর্মীর কাজের ভার কিছুটা লাঘব করার চেষ্টা করা। এটি যেমন এক রোজাদার বান্দার ওপর অনুগ্রহ তেমনি একটি ফরজ ইবাদত আদায়ের ক্ষেত্রে সহযোগিতা। পাশাপাশি তা ফরজ আদায়ে উৎসাহিত করারও একটি উপায়।

আত্মিক উন্নতি
এ রমজানে যারা রোজা রাখেন তাদের জন্যেও রয়েছে উন্নতির সুযোগ। কারণ পানাহার ও স্ত্রী-মিলন থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি রোজাদারের কর্তব্য, সব রকমের অন্যায়-অনাচার থেকেও বেঁচে থাকা। কটূক্তি-ঝগড়া-বিবাদ ও অশোভন উচ্চারণ থেকেও বেঁচে থাকা। হাদিস শরীফে আছে, ‘যখন তোমাদের রোজার দিন আসে তখন তোমরা অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকবে এবং চিৎকার-চেঁচামেচি থেকে বিরত থাকবে। কেউ যদি ঝগড়া-বিবাদে প্রবৃত্ত হয় তাহলে বলবে, আমি রোজাদার।’ কাজেই রোজাদারের রোজার পূর্ণতা সাধনের জন্য সবরকমের অন্যায়-অশোভন কাজ থেকে বিরত থাকাও কর্তব্য। বলা বাহুল্য, মুমিন যদি একমাস এভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রিত রাখার চেষ্টা করে, ইনশাআল্লাহ তার স্বভাব-চরিত্রে, কথা ও কাজে পরিবর্তন সাধিত হবে।

তারাবি আদায়
মাহে রমজানের আরেক বিশেষ ইবাদত তারাবি। গোটা মুসলিম জাহানে তারাবির নামাজ অত্যন্ত আগ্রহ-উদ্দীপনার সঙ্গে আদায় হয়ে থাকে। তারাবি অতি বরকতময় সুন্নত। আল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুবারক জামানা থেকেই তারাবি মাহে রমজানের অতি ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। ঐকান্তিকতা ও একনিষ্ঠতার সঙ্গে এই ইবাদতে মশগুল থাকা কাম্য।

তারাবির নামাজের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয়ের রেওয়াজও ক্রমবর্ধমান। আর তা হচ্ছে মেয়েদের মসজিদের জামাতে শামিল হওয়া। এই প্রবণতাকে উৎসাহিত করার উপায় নেই। কারণ একে তো মেয়েদের জন্য নিজ ঘরে নামাজ পড়াই কাম্য, যা সহিহ হাদিস-আছার দ্বারা প্রমাণিত, তাছাড়া নারী-পুরুষ উভয় শ্রেণির মাঝেই প্রকৃত দ্বীনদারীর ক্রমাবনতি বিষয়টিকে আরও নাজুক করে দিয়েছে। একারণে উম্মাহ ফকীহ-মুজতাহিদগণের কোরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক সিদ্ধান্ত অনুসারে মেয়েরা যদি নিজ গৃহে নামাজ আদায়ে সম্মত হন তাহলে সেটিই তাদের জন্য অধিকতর পুণ্য ও কল্যাণের বিষয় হতে পারে।

বিশ্বাস ও চেতনার মাস
মাহে রমজান ঈমান ও ইহতিসাবের ক্ষেত্রে অগ্রসরতার মাস। ঈমান মানে বিশ্বাস, আর ইহতিসাবের মর্মার্থ প্রত্যাশা। এই মাসের সকল ইবাদত-আমলে ঈমান ও ইহতিসাব তথা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও প্রত্যাশার প্রেরণা জাগরূক রাখা কর্তব্য। হাদিস শরিফে এ মাসের সিয়াম-কিয়ামে ঈমান ও ইহতিসাবের চেতনা জাগ্রত রাখার উৎসাহ দেয়া হয়েছে। যে ব্যক্তি বিশ্বাস ও প্রত্যাশা নিয়ে রমজানের রোজা রাখে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি বিশ্বাস ও প্রত্যাশা নিয়ে রমজানের রাতে আল্লাহর ইবাদতে দাঁড়ায় তারও পেছনের গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। তাই রমজান মাস ঈমানি চেতনায় অগ্রগামী হওয়ার মাস। আল্লাহ তায়ালা যা যা সংবাদ দিয়েছেন সকল সংবাদে দৃঢ় বিশ্বাস, যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার গভীর প্রত্যাশা মুমিনের বৈশিষ্ট্য। এই বিশ্বাস ও প্রত্যাশাই আল্লাহর ইচ্ছায় মুমিনকে পরিচালিত করে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে। আমল ও ইবাদতকে করে তোলে সার্থক ও প্রাণবন্ত। অধিকারী করে দুনিয়া-আখেরাতের সৌভাগ্য ও প্রাপ্তির। এই একমাসের অনুশীলনের মাধ্যমে মুমিনের গোটা জীবনটি হয়ে উঠতে পারে ঈমান ও ইহতিসাবের জীবন; বিশ্বাস ও প্রত্যাশায় আলোকিত জীবন।

শেষ দশ দিন
রমজানুল মুবারকের শেষ দশ দিন আরও বরকতময়। এই দশকের যে কোনো বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদর হওয়ার অধিক সম্ভাবনা। তাই এসময়টা সর্বোচ্চ আগ্রহ নিয়ে ইবাদতে মশগুল থাকা কাম্য ছিল। অথচ এখন আমাদের সমাজে চালু হয়েছে ঈদ শপিংয়ের সংস্কৃতি, যার চক্করে পড়ে অনেক দ্বীনদার মানুষেরও দশকের পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যায়। অন্তত দ্বীনদার মানুষের এই ক্ষতিকর রেওয়াজ থেকে বেরিয়ে আসা কর্তব্য।

মাহে রমজান আমাদের সবার জীবনে মোবারক হোক। ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসুক। আমাদের ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবন থেকে সকল আবিলতা দূর হয়ে যাক। আমাদের চিন্তা-ভাবনা মন-মানস, কর্ম ও আচরণ উজ্জ্বল হয়ে উঠুক মাহে রমজানের শিক্ষায়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের ক্ষমা করুন ও কবুল করুন!

আপনার মন্তব্য

আলোচিত