মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

১১ এপ্রিল, ২০২৩ ০৩:২৯

রমজানের শেষ দশকের ইবাদত

আল্লাহর কাছ থেকে অশেষ নেয়ামত নিয়ে আসা মাস রমজানের প্রায় দু’তৃতীয়াংশ শেষের পথে। বাকি এক তৃতীয়াংশ দেখতে দেখতেই শেষ হয়ে যাবে, আমরা টেরই পাবো না। শেষে শুধু আপসোসই করতে থাকব, হায়রে তেমন কিছুই তো করা হলো না! তাই আসুন সামনের দিনগুলো বিশেষ করে শেষ দশ দিনকে সামনে রেখে আমরা বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করি।

আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন রমজানের শেষ দশ দিন অতীব গুরুত্ব ও ফযিলতের সময়। নিম্নে বর্ণিত বিশেষ তিনটি কারণে শেষ দশদিনের গুরুত্ব ফুটে উঠে।

প্রথমত: এ দিনগুলোতে প্রিয় নবীজী (সা.) ইবাদতের পরিমাণ অনেকগুণ বাড়িয়ে দিতেন। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) শেষ দশ দিনে ইবাদতের জন্য এত বেশি চেষ্টা করতেন, যা তিনি অন্য সময়ে করতে না। (বুখারি)

তিনি আরেকটি হাদিসে বলেছেন, শেষ দশদিন এসে গেলে প্রিয় নবীজি (সা.) রাত জেগে ইবাদতে লেগে যেতেন। পরিবারের অন্যদেরকে জাগিয়ে দিতেন। কঠিন প্রচেষ্টা চালাতেন। কোমরের কাপড় বেঁধে নিতেন। (বুখারি/মুসলিম)

মোহাদ্দেসিনে কেরাম কোমরের কাপড় বেঁধে নেয়ার দুটো অর্থ করেছেন, একটা হচ্ছে কঠিন প্রয়াস চালাতেন, যেমনটি আমরা বাংলায় বলে থাকি কোন কাজে কোমর বেঁধে লাগা। আর অপর অর্থ হচ্ছে- স্বামী-স্ত্রী’র মেলামেশা থেকে নিজে দূরে রাখতেন। উদ্দেশ্য- পার্থিব তৎপরতা কমিয়ে দিয়ে ইবাদতে মনোনিবেশ করা।

কাজেই আমাদেরকে পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার যতদূর পারা যায় পার্থিব তৎপরতা কমিয়ে দিয়ে এ দশদিনে আল্লাহর ইবাদতে নিজেকে মশগুল রাখার চেষ্টা করা। তাহাজ্জুদ যেন একদিনও ছুটে না যায়। কুরআন তিলাওয়াত, যিকির এস্তেগফার ও দোয়া দরুদের আমল বেশি বেশি করে করার প্রচেষ্টা চালানো।

দ্বিতীয়ত: এ দশদিনে লুকিয়ে রয়েছে একটি বিশেষ রাত; লাইলাতুল ক্বদর। যে রাতটি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। অর্থাৎ এক হাজার মাসব্যাপী কেউ ইবাদত করলে যে সওয়াব অর্জন করবে, এই একটিমাত্র রাত্রে সঠিকভাবে ইবাদত করতে পারলে তারচেয়েও বেশি নেকি ও কল্যাণের অধিকারী হয়ে যাবে।

নবী করীম (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল ক্বদরে ঈমান ও ইহতেছাবের সাথে রাত জেগে ইবাদত করবে, তার অতীত জিন্দেগির গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে।’ (বুখারি/মুসলিম)

এ হাদিসে ঈমান এবং ইহতেছাব বলতে বুঝানো হয়েছে লাইলাতুল ক্বদরের যে মর্যাদা এবং ফযিলত আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা.)-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা এবং আমল করতে পারলে যে সওয়াব পাওয়া যাবে, তার জন্য ব্যাকুল হওয়া।

ক্বদরের রাত কোনটি? এ প্রসঙ্গে নবী করীম (সা.) হাদিস শরিফে এরশাদ করেছেন, ‘রমজানের শেষ দশদিনে লাইলাতুল ক্বদর অন্বেষণ করো’ (বুখারি)।

অন্য হাদিসে আরও ব্যাখ্যা করে বলেছেন, শেষ দশদিনের বেজোড় রাতসমূহে লাইলাতুল ক্বদরকে অন্বেষণ করো (বুখারি)।

অন্য হাদিসে তিনি বলেছেন, আমি আসছিলাম তোমাদেরকে লাইলাতুল ক্বদরের তারিখটি বলে দিতে, কিন্তু পথিমধ্যে তোমাদের দু’ভায়ের ঝগড়া থামাতে গেলে, সেটা আমাকে ভুলিয়ে দেয়া হলো। তবে সেটা অবশ্যই শেষ দশদিনের একটি বেজোড় রাত।

উপরোল্লিখিত হাদিসসমূহের আলোকে ওলামাদের মতামত হলো লাইতুল ক্বদরের ইবাদত শুধু এক রাতে না করে একুশ, তেইশ, পঁচিশ, সাতাশ এবং ঊনত্রিশ- এ সবগুলো রাতেই করতে হবে। আর রাসূল (সা.)-কে নির্দিষ্ট রাতটি ভুলিয়ে দেয়ার মাধ্যমে আল্লাহ আমাদেরকে এক রাতের পরিবর্তে পাঁচটি রাতে সবিশেষ গুরুত্ব সহকারে ইবাদত করার ব্যবস্থা করে দিলেন।

এ রাতের ইবাদত সমূহ হচ্ছে: সালাতুত্ তারাবিহ, তাহাজ্জুদ, কুরআন তেলাওয়াত, যিকর, দোয়া ও ইস্তিগফার।

হযরত আয়েশা (রা.) প্রশ্ন করেছিলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি লাইলাতুল ক্বদর পেয়ে গেলে কোন দোয়াটি বেশি বেশি করে আমল করব? তিনি বললেন, পড় ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী’। অর্থাৎ হে আল্লাহ! আপনি অনেক বেশি ক্ষমাকারী। ক্ষমা করা পছন্দ করেন। আমাকে ক্ষমা করে দিন। (আহমদ, তিরমিযি, ইবন মাজাহ)

তৃতীয়ত: রমজানের শেষ দশদিনে রয়েছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত আমল। আর তা হচ্ছে ইতিকাফ। নবী করীম (সা.) জীবনের শেষ বৎসর পর্যন্ত শেষ দশদিনের ইতিকাফ করে গেছেন। শেষ দশদিনের সময়কে পুরোপুরিভাবে আল্লাহর ইবাদতে কাজে লাগাতে ইতিকাফ একটি বিরাট সুযোগ। যারা ইতিকাফ করতে ইচ্ছুক, তাদেরকে বিশ তারিখের রোযার ইফতারের সময়ের পূর্বেই মসজিদে ঢুকে যেতে হবে।

রমজানের শেষ দশদিনের আমলের সাথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আর তা হচ্ছে যাকাত। দ্বীন ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ ফরয ইবাদতটি অনেকেই রমজান মাসে আদায় করে থাকেন। কারণ, রমজানে যেকোন আমল ৭০ থেকে ৭০০ গুণ বেশি সওয়াব নিয়ে আসে। যাকাত ফরয হয়ে গেলে কৃপণতাবশত যারা তা আদায় করবে না, তাদের জন্য রয়েছে আখেরাতে কষ্টদায়ক শাস্তি।

কুরআন হাদিসে তাদের বেলায় দু’ধরনের বিশেষ শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে- যাকাত আদায় না করা সম্পদকে ধাতুতে পরিণত করে জাহান্নামের বিশেষ আগুনে সে ধাতুর পাতগুলোকে গরম করে তাদের কপাল, পার্শ্বদেশ এবং পৃষ্ঠে সেঁক দেয়া হবে এবং বলা হবে, তোমাদের জন্য সঞ্চিত করে রাখা এ সম্পদের স্বাদ গ্রহণ কর (তাওবা: ৩৪ এবং বুখারি, মুসলিম)।

আর অন্যটি হচ্ছে- সম্পদকে আবার বিষধর কৃষ্ণকায় অজগর সাপে পরিণত করা হবে। সে সাপ সম্পদের মালিককে সমস্ত শরীর পেঁচিয়ে ধরে মাথা ও মুখকে তার চেহারার সামনে এনে ধরবে। চেহারায় ছোবল মারতে থাকবে আর বলতে থাকবে, আমি তোমার মাল, আমি তোমার গচ্ছিত সম্পদ (বুখারি, মুসলিম)।

কাজেই কেউ নেছাবের মালিক হয়ে গেলে যাকাত আদায় করে দিতে হবে। সারা বছরের প্রয়োজনীয় খরচপত্র সম্পন্ন করে যদি কারো কাছে সাড়ে সাত ভরি (৮৫ গ্রাম) স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোরা (৪৬০ গ্রাম) রূপা বা সমমূল্যের অর্থকড়ি অতিরিক্ত জমা হয়ে যায় এবং তা তার কাছে এক বৎসর পর্যন্ত থাকে, তাহলে এমন ব্যক্তির উপর যাকাত ফরয হয়ে যায়।

মহান আল্লাহ যেন রমজানের শেষ দশ দিন অতীব গুরুত্বের সাথে আমল ও পালন করার তৌফিক দান করুন। আমিন!

আপনার মন্তব্য

আলোচিত