মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা

৩০ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০৭

আবুল মাল আবদুল মুহিত: মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

আটাশি বছরের ‘মহাতৃপ্তির, মহাপ্রাপ্তির’ জীবন কাটিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার এক বছর পূর্ণ হলো আবুল মাল আবদুল মুহিতের। গত বছরের ৩০ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ঢাকায় মারা যান। ভাষা সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, অর্থনীতিবিদ কতো পরিচয় ছিল তাঁর। সব পরিচয়কে ছাপিয়ে তিনি হয়ে ওঠেছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় এক বিবেকী আশ্রয়ে।

মৃত্যুর মাসখানেক আগে গত বছরের ১৬ মার্চ নিজ জন্মস্থান সিলেটে "গুণীশ্রেষ্ঠ" সম্মাননা পাওয়ার জবাবে তিনি বলেছিলেন, তিনি জীবন নিয়ে মহাতৃপ্ত। তাঁর আর কোনো চাওয়া নেই। এখন চলে যেতে চান অমৃতলোকে। সেই চাওয়া তাঁর কিছু দিনের মধ্যেই পূর্ণ হয়। সফল কর্মবহুল জীবনের পরিণতি টেনেছেন গভীর আত্মপ্রত্যয়ে। কাঁদিয়ে গেছেন হাজার হাজার মানুষকে। তাঁর শেষ যাত্রায় সঙ্গ দিয়েছেন সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী। সিলেট বিভাগের প্রায় সকল সংসদ সদস্য দলমত নির্বিশেষে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে এসেছিলেন সর্বশেষ নামাজে জানাজায়। সিলেটের সর্ববৃহৎ ময়দান, যেখানে সরকার প্রধানরা বৃহৎ সমাবেশে মিলিত হন। সেই আলিয়া মাদ্রাসা মাঠ পূর্ণ ছিল তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।

তিনি গতানুগতিক রাজনীতি করতেন না। সস্তা জনপ্রিয়তার ধার ধারতেন না। সাধারণের সঙ্গে ছিলো না নিবিড় যোগাযোগ। কর্মীবান্ধব নেতা যে অর্থে বলা হয় তিনি তার ধারে কাছেও ছিলেন না। কিন্তু কি এক আকর্ষণে দলমত নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিল তাঁর শেষ যাত্রায়। তিনি বলেছিলেন মাহাত্ম্যের কাছে তিনি মাথা নত করেন। তাঁর মাহাত্ম্য আর মুগ্ধতার টানেই জনসমুদ্রে পরিণত হয়ে ওঠেছিল আলিয়া ময়দান। তিনি জীবনকে নিয়ে গর্বিত ছিলেন। জন্মভূমির মানুষকেও তিনি গর্বিত করেছেন। জাতির অগ্রযাত্রায় নিষ্কলুষ ভূমিকা রেখে পরিণত হয়েছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় অভিভাবকে।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ছাত্র জীবন থেকেই প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অবদান রেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। পরবর্তীতে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সর্বোচ্চ ধাপে যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে অবসর জীবনে হয়ে ওঠেছিলেন দেশের সুশীল সমাজের এক গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। সেখান থেকে আকস্মিকভাবেই ২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে যোগ দেন দেশের অন্যতম প্রাচীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে। সিলেট ১ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হলেন। সেই থেকে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছেন জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে। সেই যে জড়িয়ে গেলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি জনবিচ্ছিন্ন হননি। তাঁর নিজস্ব স্টাইলে জনকল্যাণে নিবেদিত ছিলেন আমৃত্যু। তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁকে রাজনীতিতে না জড়াতে বলেছিলেন। তিনি এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন। সফলও হয়েছিলেন। জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে সরকারে সম্পৃক্ত হয়ে দেশ ও দলের কাছে হয়ে ওঠেছিলেন অপরিহার্য ব্যক্তিত্বে। সারস্বত সমাজেরও আস্থা অর্জন করে দলীয় রাজনীতি করেও হয়েছেন সর্বদলীয় অভিভাবক।

৮৯ বছরে পা দিয়েছিলেন। পরিতৃপ্ত, কর্মবহুল ও বর্ণাঢ্য জীবন অতিবাহিত করে চলে গেলেন গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করে। এই শূন্যতাই তো ভালোবাসা, এই শূন্যতাই তো নির্ভরতা। মৃত্যুর কয়েকমাস আগে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসা শেষে অনেকটা সুস্থ হলেও শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। এই দুর্বলতাই বার্ধক্যের উপর ভর করে ছিনিয়ে নিয়ে যায় এই পরিশীলিত মানুষকে। দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ এ মানুষটি বাংলাদেশের উন্মেষ ও রূপান্তরের এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব। সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী, অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিক, লেখক, গবেষক, পরিবেশবিদ ইত্যাদি নানা পরিচয়ে দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে রেখেছেন গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন আবুল মাল মুহিতের ওপর। সেই দায়িত্ব শুধু পালন করেননি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আমূল বদলে দিয়েছেন বাস্তবিক পরিকল্পনায়। টানা দশ বছর অর্থমন্ত্রীর কর্তব্য পালন করে দেশকে নিয়ে গেছেন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায়। বৃহৎ বাজেট, বৃহৎ প্রকল্প তারই ধ্যান ধারনার ফসল। যা বাংলাদেশ এখন বাস্তবায়ন করছে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্প তিনিই সূচনা করেন। সকল নাগরিকের জন্য পেনশন ব্যবস্থা তাঁরই মস্তিষ্ক প্রসূত প্রকল্প। দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার ভিত তিনি তৈরি করে দিয়েছেন। এক দশক আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সভরিন বন্ডের ফাঁদ থেকে রক্ষা করেছেন বাংলাদেশকে। যার সুফল ভোগ করছে এখন বাংলাদেশ।

এই মানুষটি ছিলেন আপাদমস্তক একজন কুসংস্কারমুক্ত, কুপমুন্ডকতামুক্ত অসাম্প্রদায়িক মানুষ। মৃত্যুর প্রস্তুতি নিচ্ছেন জানিয়ে তাই কেবল তাঁর পক্ষেই বলা সম্ভব হয়েছে " সাম্প্রদায়িক অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করা, এটিকে ভদ্রতার মধ্যে নিয়ে আসা একজন জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির জীবনের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আমি নিজে মনে করি এই উদ্দেশ্য নিয়েই আমি ৮৮ বছর পূর্ণ করেছি। এটাই আমার মহা তৃপ্তির কারণ; এটাই মহা প্রাপ্তির কারণ"।

আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রথাগত রাজনীতির পথে না হেঁটে জাতির বিকাশমান ধারাকে অগ্রবর্তী করেছেন। ঐতিহ্যের পরম্পরা ধারণ করে যুগোপযোগী মিশেলে আধুনিকতা লালন করেছেন। প্রযুক্তির উৎকর্ষকে কাজে লাগিয়ে রূপান্তরের নায়ক হয়েছেন জীবনের অধিক্ষেত্রে। অনেক সময় অসংগতির বিরুদ্ধে হয়েছেন উত্তেজিত আবার রাজনৈতিক কারণে হয়েছেন সংযত। বুদ্ধিবৃত্তিক মন ও রুচিশীল ভাবনায় সক্রিয় থেকেছেন আজীবন। নিজস্ব চিন্তাধারায় ছিলেন স্থির। রাজনৈতিক কারণে অনেক বিষয় মেনে নিতে হলেও স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে আত্মমর্যাদা হারাননি । এমন কর্মতৎপর মানুষ সত্যিই বিরল। নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন জাতির অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার অন্যতম নায়ক। আর্থরাজনীতির সফল এই মানুষটি পরকালে চিরপ্রশান্তিতে থাকুন এই প্রার্থনা। প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত