মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

১৫ মে, ২০২৩ ১১:৫৪

নির্বাচনী রাজনীতি ও এলিট তত্ত্ব

নির্বাচন যখন সন্নিকটে, তখন আমাদের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা জরুরি। রাজনৈতিক দিক থেকে দেখলে আমাদের বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো এক সংকটে রয়েছে। এই অবস্থায় যে কোনো রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যে থিওরি খুব আলোচিত এবং রাজনৈতিক দলের রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলমন্ত্র বিবেচিত, তাকে এলিট থিওরি হিসেবে অভিহিত করা হয়।

এলিট থিওরিতে দুটি রেসিডিউস (ভাবাবেগ) থাকে। কেউ কেউ এ দুটিকে রেসিডিউস-১ ও রেসিডিউস-২; আবার কোনো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রেসিডিউস-এ ও বি হিসেবে নামকরণ করেছেন। তবে মূলকথা একই। এই দুটি রেসিডিউস দ্বারা রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে ওই সরকারের ভবিষ্যৎ। অর্থাৎ বলা হয়, যখন কোনো সরকারের পরিচালক, পরিচালনা পর্ষদ ও রাষ্ট্রযন্ত্রে রেসিডিউস-এ তীব্র মাত্রায় বিদ্যমান, তখন ওই সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে এবং পরবর্তী সময়েও ক্ষমতায় আসে শুধু রেসিডিউসকে শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করার ফলে।

এবার আসি এর মূলকথা কী? রেসিডিউস-এ হলো, রাষ্ট্র পরিচালনার ওই নীতি, যা দ্বারা রাষ্ট্রের সবকিছুকে কঠিন হাতে নিয়ন্ত্রণ, দমন ও তত্ত্বাবধান করা এবং সেই সঙ্গে রেসিডিউস-বিকে শক্তিশালী হতে না দেওয়া। অন্যদিকে সংক্ষেপে বললে রেসিডিউস-বি হলো ওই নীতি, যা রাষ্ট্র পরিচালনায় উদারনীতি ও আপসের পথকে নির্দেশ করে।

এই তত্ত্বের বিবরণ অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালকরা থাকেন রেসিডিউস-এ এবং বিরোধী পক্ষ থাকে রেসিডিউস-বিতে। বলা হয়, যদি কখনও রেসিডিউস-এ দুর্বল হয় এবং রেসিডিউস-বি শক্তিশালী হয় অর্থাৎ এ-র ওপর বি শক্তিশালী হয়, তবে ওই সরকারের সবকিছু অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে এবং ক্ষমতায় থাকা ও পুনরায় ক্ষমতায় আসা কঠিন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে যদি রেসিডিউস-বিকে শক্তিশালী না করা যায় এবং এ-র ওপর বি-কে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারা যায়, তবে নতুন শক্তির ক্ষমতায় আসা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের পটভূমিতে বলা যায়, বর্তমানে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার দোলাচলে দুটি গ্রুপ বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ পরিচালকের আসনে বসার জন্য প্রতিযোগিতায় মত্ত। এ ক্ষেত্রে সরকারি দলের মধ্যে এক নম্বর রেসিডিউস তীব্র মাত্রায় বিদ্যমান। অন্যদিকে বর্তমান সরকারের পতন ঘটিয়ে যারা নতুন সরকার গঠনের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে, তারা দুই নম্বর রেসিডিউসে অবস্থান করছে।

অনেক দেশে এ তত্ত্ব প্রয়োগ করার ফলে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের প্রভাব লক্ষণীয়। যেমন মালয়েশিয়ার সাবেক শাসক ড. মাহাথিরের শাসন ব্যবস্থায় রেসিডিউস-এ তীব্র মাত্রায় বিদ্যমান ছিল বলে মনে করা হয়। তবে সেই রেসিডিউস ধারণ করলেও রাষ্ট্রের উন্নয়ন তাকে অনন্য মাত্রায় সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। অন্যদিকে রেসিডিউস-বি শক্তিশালী হওয়ার ফলে লিবিয়া, ইরাকসহ আফ্রিকার অনেক দেশে শাসকমণ্ডলীর পরিণতি হয়েছে খুবই অপ্রত্যাশিত বলে মনে করা হয়। উল্লেখ্য, রেসিডিউস-বিকে শক্তিশালীকরণের ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা ও তৎপরতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রেসিডিউস-একে শক্তিশালীরূপে ধরে রাখার সফলতার মাত্রা খুবই কম। কারণ রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করায় ক্ষুদ্র ও দরিদ্র জাতিরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের রয়েছে বিশাল স্বার্থ। তাই তারা তাদের সুবিধা ও বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব বলয়কে শক্তিশালী করতে কখনও 'এ' আবার কখনও 'বি'কে শক্তিশালী করতে তৎপরতা চালায়।

ধরা যাক, বাংলাদেশ জন্মেরও আগে যখন অখণ্ড পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিল, তখন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সর্বক্ষেত্রে শুধু বঞ্চিতই করে, তারা পূর্ব পাকিস্তানের ওপর এক ধরনের বল প্রয়োগের নীতি কঠোরভাবে কার্যকর করেছে। এতে যে ঘটনাটা ঘটেছিল বলে ধারণা করা যায় তাহলো, অধিক বল প্রয়োগ করে কিছুটা সময় শাসন করা গেলেও জনগণের তীব্র গণজোয়ার শাসক দলকে খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যেতে একটু সময়ক্ষেপণ করেনি। এলিট তত্ত্বে মূলত এ ঘটনাই ঘটে।

এবার আসি শত্রুর সঙ্গে মিত্রতা প্রসঙ্গে। যখন আস্থা ও বিশ্বাসের মূল্যবোধ সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রকাঠামোয় অনুপস্থিত থাকে, তখন ঘটে বিপত্তি এবং রাষ্ট্রের রাজনৈতিক শক্তিগুলো উল্লিখিত রেসিডিউস-একে টিকিয়ে রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা অব্যাহত রাখতে চায় অথবা রেসিডিউস-বিকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চায়। আর তখনই 'শত্রুর সঙ্গে মিত্রতা' অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। তবে শত্রুর সঙ্গে মিত্রতার ধারণাটা খুব পুরাতন সামাজিক প্রত্যয় হলেও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এর প্রয়োগ একদম নতুন।

সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ আন্নি নাশিদের বক্তৃতায় বিষয়টি আরও গুরুত্ব পায়। তা হলো, মালয়েশিয়ার সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের দলের ক্ষমতায় আসা ও তার মুক্তি সম্ভব হয়েছে শুধু শত্রুর সঙ্গে মিত্রতার ফলে। তিনি বলেন, লন্ডনে নির্বাসনে থাকাকালীন আনোয়ার ইব্রাহিমের মেয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি পরামর্শ দেন যে, তার বাবাকে মুক্ত ও দলকে ক্ষমতায় আনার ক্ষেত্রে শুধু একটা পথই বাকি রয়েছে। আর তা হলো, আনোয়ার ইব্রাহিমের বন্ধু থেকে শত্রুতে পরিণত হওয়া মাহাথিরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে এবং তার নেতৃত্ব, প্রজ্ঞা ও প্রভাবকে কাজে লাগাতে হবে এবং হয়েছেও তাই। এমনকি তার নিজ দেশ মালদ্বীপেও একই কায়দায় আবদুল্লাহ ইয়েমেনিকে ক্ষমতা থেকে সরানোর ক্ষেত্রে এই তত্ত্বই কাজে লেগেছে বলে তিনি তার বক্তৃতায় ইঙ্গিত দেন।

বাংলাদেশে এই এলিট তত্ত্বের প্রয়োগ ও শত্রুর সঙ্গে মিত্রতা নামক রাজনৈতিক কর্মপরিকল্পনা সজ্ঞানে বিস্তার ও প্রয়োগ করা হচ্ছে কিনা, জানা নেই এবং বলাও সম্ভব নয়। তবে তরুণ প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি হিসেবে একটা আস্থা ও বিশ্বাসের রাষ্ট্রকাঠামো প্রত্যাশা করি, যেখানে থাকবে চূড়ান্ত রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক মূল্যবোধ, যাতে কোনো দলের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বিঘ্ন ঘটাবে না এবং কোনো সামাজিক অনিশ্চয়তা তৈরি করবে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত