১৮ মে, ২০২৩ ১৩:৩৪
বাংলাদেশ একটি জনসম্পদ সমৃদ্ধ দেশ। পৃথিবীর ১০টি জনশক্তি রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে। এ দেশ থেকে প্রতি বছর সরকারি হিসাবে ৬ লাখেরও বেশি মানুষ উন্নত জীবিকার সন্ধানে বিদেশ গমন করে। মূলত এ সংখ্যা আরও বেশি। তাদের কষ্টসাধ্য শ্রমের বিনিময়ে বিপুল পরিমাণে আসা ‘রেমিট্যান্স’ দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে ও জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
সরকারি হিসাবে ৮০ লাখের অধিক, বেসরকারি মতে ১ কোটিরও বেশি বাংলাদেশী কর্মী বিশ্বের দেড় শতাধিক দেশে বর্তমানে কর্মরত আছে। তবে এ পরিমাণ কর্মীর অধিকাংশই অদক্ষ, অপ্রশিক্ষিত শ্রমিক। দক্ষ ও উচ্চ দক্ষকর্মী প্রেরণের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার এবং প্রেরণকারী এজেন্সিগুলো যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। বিদেশে অদক্ষ শ্রমিকের চেয়ে দক্ষ, উচ্চ দক্ষ কর্মীর চাহিদা ও বেতন-ভাতা অনেক বেশি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানে দক্ষকর্মী প্রেরণের হার অনেক বেড়েছে। ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে রেমিট্যান্স ক্রমেই স্ফীত হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘হাই প্রফেশনালস’ ক্যাটাগরিতে বেশ কিছু ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, নার্স, ল্যাবরেটরি স্পেশালিস্ট, অ্যাকাউন্ট্যান্ট, শিক্ষক ও আইটি বিশেষজ্ঞ উচ্চ বেতন ও চমৎকার সুবিধাদি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাফল্যের সঙ্গে চাকরি করছে।
আশির দশকে ঘোষিত বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ আফ্রিকার সমাজতান্ত্রিক ইসলামিক লিবিয়া মূলত জ্বালানি ও খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ একটি মুসলিম প্রজাতন্ত্র। আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে ১২ গুণ বড়। লিবিয়ার দিনার আর মার্কিন ডলারের মান প্রায় কাছাকাছি। পূর্ববর্তী নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির শাসনামলে সেখানে বাংলাদেশী ‘মেডিকেল প্রফেশনালস’ নিয়োগ পেয়েছে। সরকারি চাকরি হিসেবে লিবিয়ার বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়োগপ্রাপ্ত বাংলাদেশী ডাক্তার ও নার্সরা দায়িত্বশীলতা, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন। ইতালি, ইউক্রেন, গ্রিস, ফিলিপাইন ও ভারতীয়দের তুলনায় বাংলাদেশীরা লিবীয়দের মন জয় করতে সক্ষম হয়। ধর্মীয় মমত্ববোধ ছাড়াও তারা বাংলাদেশীদের কর্মদক্ষতা ও সততায় ভীষণভাবে মুগ্ধ। সাম্প্রতিক যুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশী ডাক্তার ও নার্স যারা জীবন বাজি রেখে লিবিয়ার হাসপাতালগুলোতে দিন-রাত দায়িত্ব পালন করেছেন। লিবীয় সরকার তাদের মুক্তিযোদ্ধা বলে অভিহিত করে সম্মাননা দিয়েছেন। যুদ্ধ-পরবর্তী নতুন সরকার ‘মেডিকেল প্রফেশনালস’ আনয়নের ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহ দেখায়।
বিশ্বমন্দা ও শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশ ভালো আছে। কেন ভালো আছে? এর একটি উত্তর প্রবাসীদের বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ। এর ফলে জিডিপি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে, আমাদের চাকচিক্য বাড়ছে। আর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারে বেড়েই চলছে।
চাকরিতে নিয়াগকালে নিয়োগকর্তা কর্তৃক কোনো লিখিত বা মৌখিক শর্তারোপ করা হলে তা পালন করা কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর অবশ্যকর্তব্য। কেননা, এটা এক ধরনের চুক্তি, যার মাধ্যমে সে তা পূরণ করার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়। ইসলামের বিধানে অঙ্গীকার পূরণ করা কর্তব্য। আল্লাহ বলেছেন, ‘ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা অঙ্গীকারগুলো পূরণ কর।’ (সূরা আল মায়িদা : ১)।
নিয়োগকর্তা বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আনুগত্য করা ও তাদের বৈধ নির্দেশ পালন করা কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর অবশ্যকর্তব্য। আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের দায়িত্বশীলদের।’ (সূরা নিসা : ৫৯)।
চাকরি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিয়োগকর্তা এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দায়িত্বশীল হওয়ায় তাদের আনুগত্য করা আল্লাহর এ বাণী দ্বারা আবশ্যক সাব্যস্ত হয়। অবশ্য দায়িত্ববহির্ভূত কোনো কাজের নির্দেশ দেয়া হলে তা পালন করা ওয়াজিব নয়; কেননা, তা দায়িত্বভুক্ত নয়। আবার অন্যায় কাজে তাদের আনুগত্য করাও আবশ্যক নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো পাপ কাজে কারও আনুগত্য নেই; আনুগত্য শুধু ভালো কাজে।’ (বোখারি, মুসলিম)। এরূপ পরিস্থিতিতে আনুগত্যের পরিবর্তে সাধ্যমতো তা প্রতিহত করা কর্তব্য হয়ে যায় বলে অন্য হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। তবে যদি পাপকাজে বা অন্যায়ে এমনভাবে বাধ্য করা হয়, যা থেকে বাঁচার আর কোনো পথ থাকে না তাহলে এর নৈতিক দায় তাদের ওপর বর্তায় না।
চাকরি সংশ্লিষ্ট নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তা-কর্মচারীর কর্তব্য। ইচ্ছাকৃতভাবে দায়িত্বে অবহেলা করা ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। কেননা, এতে উপার্জন বৈধ হয় না; অথচ উপার্জন হালাল হওয়া ফরজ এবং হারাম উপার্জনের পরিণতি জাহান্নাম।
কর্তব্যে অবহেলা বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন : বিনা ওজরে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করা, কাজে দীর্ঘসূত্রতা বা অযথা সময়ক্ষেপণ, নির্ধারিত সময়ে কর্মে অনুপস্থিতি বা বিলম্ব, সেবাপ্রার্থীদের সেবা প্রদানে গাফিলতি, হকদারদের হক আদায় না করা কিংবা হয়রানি করা প্রভৃতি। কর্তব্যে অবহেলার জন্য প্রত্যেককে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল; আর তোমরা প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বোখারি)।
চাকরিজীবীদের প্রায় সবারই কমবেশি ক্ষমতা থাকে। অবস্থান ও পদক্রমানুসারে ক্ষমতার পরিধির তারতম্য থাকলেও নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্যমান ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ থাকে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কোনো কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। ফলে স্বেচ্ছাচারিতা, অর্থ-সম্পত্তি আত্মসাৎ, ভীতি প্রদর্শন ও হয়রানি, অন্যায়ভাবে স্বার্থসিদ্ধি প্রভৃতি সংঘটিত হয়। এসব কাজ ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। আত্মসাৎ দুই ধরনের হতে পারে- নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সম্পদ আত্মসাৎ এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে বা প্রভাব খাটিয়ে সাধারণ মানুষের সম্পদ আত্মসাৎ। দুটিই হারাম।
আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না।’ (সূরা নিসা : ২৯)। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমরা তোমাদের কাউকে কোনো কর্মে নিযুক্ত করার পর সে যদি একটি সূচ বা তদপেক্ষা সামান্য বস্তুও আমাদের থেকে গোপন করে, তাহলে তাও আত্মসাৎ বলে গণ্য হবে, যা নিয়ে সে কেয়ামত দিবসে উপস্থিত হবে।’ (মুসলিম)। নিয়োগকর্তা বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যেসব সম্পদ ব্যবহার করার সাধারণ অনুমতি প্রদান করে তা ব্যবহার করা বৈধ। যেমন: অফিসের কাগজ-কলম, সরঞ্জামাদি, ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহারের জন্য কোনো বস্তু প্রভৃতি।
তবে তাতেও মিতব্যয়ী হওয়া উচিত। চাকরিজীবী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এমন কারও কাছ থেকে উপহার গ্রহণ বৈধ নয়, যার সঙ্গে তার কর্তব্যের সংশ্লিষ্টতা থাকায় তাকে কর্তব্য পালনে প্রভাবিত করার সংশয় বিদ্যমান থাকে। রাসূলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে জাকাত আদায়কারী কর্মকর্তা নিয়োগ করেছিলেন। জাকাত আদায়ান্তে তিনি ফিরে এসে কিছু সম্পদকে তার প্রাপ্ত উপহার হিসেবে উপস্থাপন করলেন। এতে রাসূলুল্লাহ (সা.) অসন্তুষ্ট হয়ে তাকে কঠোরভাবে ভর্ৎসনা করেছিলেন। এ জাতীয় উপহার প্রকৃতপক্ষে উপহার না হয়ে ঘুষে পরিণত হয় এবং তা দুর্নীতির বিস্তার ঘটায় বিধায় ইসলাম এর অনুমোদন দেয় না। এভাবে সেবাপ্রার্থীদের ফাইল আটকে রেখে অর্থ দাবি করা বা ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে কারও ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করাও ইসলামের দৃষ্টিতে মহাঅন্যায়। এগুলো জুলুম; আর জুলুম হারাম।
আল্লাহ জাল্লা শানুহু রাজত্ব ও সার্বভৌমত্বের একমাত্র মালিক। প্রকৃত পক্ষেই আল্লাহ ছাড়া কোনো মালিক নেই- লা মালিকা ইল্লাল্লাহ। তিনি মানবজাতি সৃষ্টি করেছেন তারই ইবাদতের জন্য অর্থাৎ তার দাসত্বের জন্য। আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা হিসেবে তিনি মানবজাতিকে পৃথিবীতে উদ্ভব ঘটান তার রবুবিয়ত প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান-বুদ্ধি দান করেছেন, কর্মশক্তি দান করেছেন, কর্মকৌশলী উদ্ভাবনের ক্ষমতা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে শ্রমনির্ভর করে সৃষ্টি করেছেন। এই পৃথিবীটা হচ্ছে মানুষের জন্য আখেরাতের শস্যক্ষেত্র। এখানে যে যেমন কর্ম করবে আখেরাতে সে তেমন ফল পাবে। পৃথিবীতে কেউ জাগতিক কর্মের নিরিখে কর্মে নিয়োগকারী থাকে আর নিযুক্ত ব্যক্তি হয়ে যায় কর্মচারী অর্থাৎ কেউ এমপ্লয়ার আবার কেউ এমপ্লয়ি।
এই দুইয়ের মধ্যে কোনো নির্ণয় রেখা টেনে দেয়ার সুযোগ ইসলাম দেয় না। ইসলাম সব অসমতা দূর করে দিয়ে ইনসাফভিত্তিক সমতার সমাজ কায়েমের পথ নির্দেশ করে। ইসলাম কারও হক বা ন্যায্য অধিকার ক্ষুণ্ণ করার, কারও স্বার্থ বিনষ্ট করার এবং কারও ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করার সুযোগ প্রদান করে না।
একজন এমপ্লয়ার ব্যক্তির যোগ্যতা অনুসারে একজন এমপ্লয়ীকে কার্যে নিয়োগ করে। কিন্তু এমপ্লয়ার বা নিয়োগকর্তার স্মরণ রাখা উচিত যে, এমপ্লয়ি বা কর্মচারী তার অধস্তন হলেও মানুষ হিসেবে কর্মচারীর মর্যাদা তারচেয়ে কম নয়। আল্লাহ জাল্লা শানুহু এরশাদ করেন, ‘ওয়া লাকাদ কাররাম্না বনি আদাম- আর আমি তো আদম সন্তানদের দান করেছি মর্যাদা (সূরা : বনি ইসরাইল : আয়াত ৭০)।’
ইসলামে যে হক্কুল্লাহ এবং হক্কুল ইবাদ অর্থাৎ আল্লাহর হক এবং বান্দার হকের কথা বলা হয়েছে তা যথার্থভাবে পালন করার মধ্যেই রয়েছে মানবিক মূল্যবোধের সত্যিকার দিশা।
ইসলাম কোনো ব্যক্তির মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত করার ক্ষমতা কাউকে দেয় না। মৌলিক চাহিদা একজন এমপ্লয়ারেরও যেমন রয়েছে তেমনি মৌলিক চাহিদা এমপ্লয়িরও রয়েছে। কেউ খাবে আর কেউ খাবে না- এটা ইসলাম কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করে না। বরং ইসলাম বলে, বিত্তবানের ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের ন্যায্য অধিকার রয়েছে। তাই একজন নিয়োগকর্তা যখন কারও নিয়োগ করবে তখন অবশ্যই নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তির মৌলিক চাহিদার নিরিখে তার বেতন-ভাতা বা পারিশ্রমিক নির্ধারণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে কাজের ধরন বা পরিধি বিবেচনায় আনা সমীচীন হবে না। এমপ্লয়ির বেতন-ভাতা, পারিশ্রমিক সম্মানী, কিংবা মাহিনা এমন হতে হবে, যাতে তার পরিবার-পরিজন নিয়ে সে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারে, খেয়ে-পরে সুন্দরভাবে বসবাস করতে পারে, অন্ন, বস্ত্র বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি এমপ্লয়ারের সমান হয়।
এমপ্লয়ি যেমন আদম সন্তান তেমনি এমপ্লয়ারও আদম সন্তান। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে বলেছিলেন, হে মানুষ, তোমরা সবাই আদম থেকে এবং আদম মাটি থেকে। শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া।
তিনি পৃথিবীতে মনিব-চাকরের চিরাচরিত ধারণাকে নাকচ করে দিয়ে মানুষকে মানবতার সমতলে এনে দাঁড় করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা যাদের নওকর (চাকর) বল, আসলে তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। অতএব, যার ভাই তার অধীনস্থ হয়, সে যেন তাকে সেটাই খেতে দেয় সে নিজে যা খায়, সে যেন সেটাই তাকে পরতে দেয় সে যেমন কাপড়-চোপড় পরিধান করে এবং সে যেন তার ওপর এমন কোনো কাজের বোঝা চাপিয়ে না দেয়, যা তার জন্য অসহনীয় হয়। (বোখারি শরিফ : মুসলিম শরিফ : আবু দাউদ শরিফ)।’ প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমদানকারীর দেহের ঘাম শুকানোর আগেই তার ন্যায্য মজুরি দিয়ে দেবে। (ইবনে মাজাহ শরিফ)।’
ইসলামে নারীর কর্ম অবশ্যই ইতিবাচক, তবে শর্তযুক্ত। ইতিবাচক এজন্য যে, সেও একজন মানুষ, মানবীয় প্রয়োজনের মধ্য দিয়েই জীবন অতিবাহিত করতে হয়। কর্ম একটি অত্যন্ত মানবীয় প্রয়োজন। শর্তযুক্ত এজন্য যে, নারী-পুরুষের প্রকৃতিতে রয়েছে সংবেদনশীলতার বিস্তর পার্থক্য। নারীর প্রকৃতি অতিমূল্যবান সম্পদের মতো, যা অরক্ষিত রাখার কোনো যুক্তি যেমন নেই, তেমনি তার উপযুক্ত সংরক্ষক সে নিজে নয়, পুরুষ। এজন্য নারী নিরাপত্তাকর্মীরও নিরাপত্তার দায়িত্ব দিতে হয় পুরুষকে।
যেসব শর্তে ঘরের বাইরে নারীশ্রম বৈধ: প্রথমত. হজরত অয়েশা (রা.) পর্দার হুকুম নাজিল হওয়ার পরের একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, হজরত সাওদাহকে (রা.) বাইরে যেতে দেখে হজরত ‘ওমর (রা.) তার সমালোচনা করেন। তিনি ঘরে ফিরে নবীর (সা.) কাছে বিষয়টি বলেন। এর পরপরই নবীর (সা.) ওপর ওহি নাজিল হওয়ার লক্ষণ দেখা দিল। অতঃপর তিনি বললেন, ‘প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অনুমতি দিয়েছেন’। এই প্রয়োজনীয়তার তিনটি পর্যায় রয়েছে।
ক. ব্যক্তিগত প্রয়োজন : যেমন, বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা কিংবা একেবারেই বিয়ে হয়নি এমন নারী। যার কোনো আর্থিক উৎস নেই। নেই কেউ তাকে ভরণপোষণ করার মতোও। অথচ সে কর্মের মাধ্যমে জীবিকা উপার্জনের ক্ষমতা রাখে। এভাবে সে ভিক্ষাবৃত্তির লাঞ্ছনা থেকে বাঁচতে পারে।
খ. পারিবারিক প্রয়োজন : পরিবারের প্রয়োজনেও নারী অনেক সময় কর্মের বোঝা মাথা পেতে নিতে পারে। যেমন, স্বামীকে সাহায্য করা, ছোট ভাইবোনদের ভরণপোষণ করা কিংবা বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সহযোগিতা করা। উদাহরণস্বরূপ কোরআনে সূরা কাসাসের ২৩ আয়াতে বর্ণিত হজরত শোয়াইবের (আ.) দু’কন্যার ঘটনা এখানে উল্লেখযোগ্য। যারা ছাগল পালের দেখাশোনার মাধ্যমে বৃদ্ধ বাবাকে সাহায্য করত।
গ. সামাজিক প্রয়োজন : সামাজিক অনেক কর্ম আছে প্রকৃতিগতভাবে যার সম্পাদন কেবল নারীর দ্বারাই যথার্থ। এক্ষেত্রে অবশ্যই আমরা বিভিন্ন পেশার কথা বলতে পারি, যার মধ্যে মহিলাদের চিকিৎসা, শিক্ষা ও আইনি সেবা উল্লেখযোগ্য। এসব পেশায় নারীরা থাকলে সমাজ স্বাভাবিক গতিতে চলবে।
ঘ. রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন : রাষ্ট্রীয়ভাবেও মহিলা বিষয়ক অনেক সেবা আছে, যা কেবল নারীর সম্পাদন করাই বাঞ্ছনীয়। যার মধ্যে নারীদের নিরাপত্তা, কারা ব্যবস্থাপনা অনুসন্ধান অন্যতম। এসব সেবা সম্পন্ন করতে রাষ্ট্রের আহ্বানে নারী নাগরিকের সাড়া দিতে হয়।
দ্বিতীয় শর্ত : শ্রম অবশ্যই বৈধ হতে হবে; সুতরাং ওইসব চাকরি বৈধ নয়, যা মৌলিকভাবেই হারাম। কিংবা মৌলিকভাবে হালাল; কিন্তু আনুষঙ্গিক কোনো কারণে তা হারামের পর্যায়ভুক্ত হয়ে গেছে। প্রথম প্রকারের দৃষ্টান্ত হচ্ছে, বার ইত্যাদিতে মদ পরিবেশন করা, কিংবা যৌন উত্তেজক নর্তকী হিসেবে কাজ করা। দ্বিতীয় প্রকারের দৃষ্টান্ত হলো, নির্জনে অবিবাহিত লোকের সেবা করা বা তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করা। এ প্রসঙ্গে হাদিসে রয়েছে, ‘একান্ত নির্জনে বেগানা নর-নারী যখন কথাবার্তা বলে, শয়তান তখন তাদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে যায়।’ ‘নারীদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করা থেকে সাবধান হও।’
আপনার মন্তব্য