১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ১০:৫৯
প্রত্যেক ব্যক্তির জীবিকার জন্য প্রয়োজন কর্মের। প্রতিটি মানুষই তার যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করে। সকল মানুষেরই জন্মগতভাবে কমবেশি কর্মদক্ষতা ও প্রতিভা আছে। আল্লাহ প্রদত্ত এ যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতাকে অকর্মণ্য, নিষ্ক্রিয় ও অকেজো করে রাখার অধিকার কারো নেই। নবী-রাসূলগণকেও জীবিকা নির্বাহ করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। মানুষের একান্ত প্রয়োজনীয় বস্তুসমূহ অর্থ ছাড়া অর্জন করা যায় না। অর্থসম্পদ উপার্জনে ইসলাম সকল মানুষকে উৎসাহিত করে। উপার্জনকারী ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়। জীবন এবং সম্পদ একটি অপরটির পরিপূরক। সম্পদ ছাড়া যেমন জীবনধারণ সম্ভব নয়, তেমনি প্রাণহীন ব্যক্তির জন্য অর্থেরও কোন মূল্য নেই। অর্থসম্পদ মানুষের কল্যাণের জন্য কিন্তু এ সম্পদই আবার কখনোও কখনোও অকল্যাণের কারণ হয়ে থাকে। বিত্ত-বৈভব যেমন মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে অনুরূপভাবে তা আবার মানুষের ক্ষতিকর কাজেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম শর্ত হলো, বান্দার হালাল উপার্জন। কেননা রিজিক যদি হালাল পন্থায় উপার্জিত না হয় তাহলে তার কোনো দুআ কিংবা ইবাদত কোনটাই কবুল হয় না। আল্লাহ আমাদেরকে হালাল রিজিক দিয়ে জীবনধারণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, আমি তোমাদের জন্য যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে পবিত্র বস্তু তোমরা ভক্ষণ কর। আর বৈধ পেশায় নিয়োজিত থেকে সম্পদ উপার্জনের জন্য পবিত্রতম ও হালাল বস্তুর খোঁজ করার নির্দেশও আল্লাহ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘হে মুমিনগণ! জুমুআর দিন যখন সালাতের জন্য আহবান করা হয় হয় তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ কর, এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয় যদি তোমরা উপলব্ধি কর। সালাত শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে যাতে তোমরা সফলকাম হও।
রসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, পৃথিবী মিষ্ট ও শ্যামল। এখানে যে ব্যক্তি হালাল সম্পদ উপার্জন করবে এবং ন্যায়সঙ্গত পথে তা ব্যয় করবে, আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দেবেন এবং তাকে জান্নাত দান করবেন। আর যে ব্যক্তি হারাম পন্থায় সম্পদ উপার্জন করবে এবং অন্যায় পথে ব্যয় করবে, আল্লাহ তাকে অপমানজনক স্থানে নির্বাসিত করবেন। আর যারা হারাম সম্পদ হস্তগতকারী, কিয়ামতের দিন তারা আগুনে জ্বলবে।
সম্পদ উপার্জনের জন্য মেধা ও শ্রম বিনিয়োগ করে তা আহরণ করতে হয়। আল্লাহ বনী ইসরাঈলের জন্য যেমন মান্না “ ‘মান্না’ এক ধরনের সুস্বাদু খাবার, যা শিশিরের মত গাছের পাতায় ও ঘাসের উপর জমে থাকত। আল্লাহ বিশেষভাবে তা বনী ইসরাঈলের জন্য প্রেরণ করেছিলেন। ‘সালওয়া’ পাখির গোশত জাতীয় এক প্রকার খাদ্য, যা আল্লাহ বনী ইসরাঈলের জন্য বিশেষভাবে প্রেরণ করেছিলেন।” নাযিল করতেন তেমনটি এ যুগে আর হবার সম্ভাবনা নেই। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন: ‘আর আমি তোমাদের উপর মেঘের ছায়া দিলাম এবং তোমাদের প্রতি নাযিল করলাম ‘মান্না’ ও ‘সালওয়া’। তোমরা সে পবিত্র বস্তু থেকে আহার কর, যা আমি তোমাদেরকে দিয়েছি। মুসলিম উম্মাহকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সম্পদ উপার্জনের শিক্ষা রসূলুল্লাহ্ স. দিয়েছেন। এজন্য মানুষকে পরিশ্রমের জন্য নিত্য নতুন উপায় বের করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। তন্মধ্যে একটি হলো চাকরি করা এবং নিজের পরিশ্রমের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করে তা দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করা। চাকুরির ক্ষেত্র হালাল হতে হবে। হারাম কোনো কাজে চাকরি নিয়ে তার দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করলে তা কখনই হালাল হবে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন: ‘‘আর মানুষ প্রচেষ্টা ছাড়া কিছুই অর্জন করতে পারে না।’’ আর এই যে মানুষ যারা চেষ্টা করে, তাই সে পায়। আর এই যে, তার প্রচেষ্টার ফল শীঘ্রই তাকে দেখানো হবে। তারপর তাকে পূর্ণ প্রতিফল প্রদান করা হবে।’’ এ আয়াতের প্রেক্ষিতে রসূলুল্লাহ স. বলেছেন: ‘‘নিজ হাতের উপার্জন মানুষের উত্তম খাদ্য। আর সন্তান মানুষের নিজ হাতের উপা৮র্জনের অন্তর্ভুক্ত।’’
সম্পদ উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে শ্রম। কুরআন মাজিদেও এ মাধ্যমটির উল্লেখ করা হয়েছে। এটাকে অবলম্বন করে মানুষ কোন রকম পুঁজি ছাড়াই নিজের জীবিকা অর্জন করতে পারে। কুরআনে দু’জন নবীকে শ্রমিক-মালিক হিসেবে পেশ করা হয়েছে। মুসা (আ.) মোহরের বিনিময়ে তাঁর স্ত্রীর বকরী চরিয়েছিলেন বলে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা শুআইব (আ.)-এর বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন: ‘‘আমার একান্ত ইচ্ছা, আমার এই কন্যা দু’টির একটিকে বিবাহ দেব তোমার সাথে এ শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার কাজ করে দেবে, আর যদি দশ বছর পুরো করে দাও, তবে সেটা হবে তোমার অনুগ্রহ।’’
বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম বলতে ঐ সমস্ত পুঁজিহীন পেশাকে বোঝায়, যেগুলোর মধ্যে দেহের চেয়ে মস্তিষ্ক বেশি খাটানো হয়। পবিত্র কুরআনেও সেগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে। ইউসুফ (আ.)-এর জীবনীতে বলা হয়েছে যে, মিসরের বাদশাহ তাঁর সাথে আলাপ-আলোচনা করার পর তাঁকে চাকরিতে ইচ্ছা প্রকাশ কর যা বলল তা আল্লাহ তাআলা আল-কুরআনে ঘোষণা করেছেন এভাবে আজ তুমি আমাদের দৃষ্টিতে বিশেষ মর্যাদাশীল ও বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত হলে।’’ তখন ইউসুফ (আ.) তাঁর প্রস্তাবিত চাকরিকে গ্রহণ করে নিজের সম্পর্কে যে কথা উপস্থাপন করেছিলেন তাহলো: ‘‘আমাকে দেশের ধনভাণ্ডারের কর্তা পদে নিযুক্ত করুন। আমি ঐগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করব এবং সে সম্বন্ধে আমার জ্ঞানও আছে।’’
মানুষ তার যোগ্যতা অনুযায়ী যে কোন চাকরির জন্য সরকারের কাছে আবেদন করতে পারে। আর সে আবেদনের মধ্যে নিজের যোগ্যতার উল্লেখ করা বৈধ। শ্রম, চাকরি ও অন্যান্য পেশার প্রতি উৎসাহ প্রদান করে নবী (স.) বলেন: ‘‘আল্লাহর প্রত্যেক নবীই বকরী চরিয়েছিলেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন: আপনিও? রসূলুল্লাহ (স.) বললেন: আমিও কয়েক কিরাত মজুরিতে মক্কাবাসীদের বকরী চরাতাম।
উপার্জনের জন্য ব্যবসা একটি উত্তম পন্থা। আল-কুরআনেও ব্যবসায়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘‘... এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য সুদকে হারাম করেছেন আর ব্যবসাকে করেছেন হালাল।
বিশ্বের অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্যায়-অনাচার ও অবৈধ পন্থায় উপার্জনের ছড়াছড়ি। এর মধ্য থেকে আমাদের সঠিক ও বৈধ পন্থায় উপার্জন করে তা জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সকলেরই মনে রাখা উচিত যে, সৎভাবে যে কোনো কাজই হোক না কেন তা পবিত্র, যতই তা নগণ্য হোক না কেন। হালাল উপার্জন আল্লাহর পছন্দনীয়, বেকার লোককে কাজের ব্যবস্থা করে দেয়া ঈমানী দায়িত্ব, কাজের বিনিময়ে মজুরি প্রদান ও গ্রহণ সম্পূর্ণ বৈধ। বেতন সম্মানজনক হতে হবে যাতে পরিবারসহ মৌলিক চাহিদা পূরণ হতে পারে, চাকরির পূর্বেই বেতন মজুরি নির্ধারণ করে নিতে হবে, মালিকের পক্ষ থেকে একতরফাভাবে কোন চুক্তি ও শর্ত শ্রমিকের ওপর চাপিয়ে দেয়া সম্পূর্ণ অন্যায়। কাজের সময় ও মেয়াদ নির্ধারিত থাকতে হবে, মালিক-শ্রমিকের সম্পর্ক হবে আত্মীয়তার মত, অসহায় মানুষকে সাহায্য করা ঈমানদার লোকদের দায়িত্ব।
আপনার মন্তব্য