মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ১৩:২৫

রবিউল আউয়াল মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মানবজীবন সময়ের সমষ্টি। সময়কে আল্লাহ তায়ালা মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহারোপযোগী করে প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন রাত, দিন, মাস, বছর ইত্যাদি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনিই সে মহান সত্তা, যিনি বানিয়েছেন সূর্যকে উজ্জ্বল আলোকময়, আর চন্দ্রকে স্নিগ্ধ আলো বিতরণকারীরূপে এবং অতঃপর নির্ধারিত করেছেন এর জন্য গতিপথগুলো, যাতে করে তোমরা চিনতে পার বছরগুলোর সংখ্যা ও হিসাব। আল্লাহ এর সব কিছু এমনিতেই সৃষ্টি করেননি, কিন্তু যেসব লোকের জ্ঞান আছে, তাদের জন্য তিনি নিদর্শনগুলো প্রকাশ করেন।’ (সুরা ইউনুস: ০৫)

আরবি মাসগুলোর মধ্যে রবিউল আউয়াল মাস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এটি ইসলামি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আরবি তৃতীয় মাস। রবি শব্দটি ‘ইরতিবাউন’ শব্দ থেকে নির্গত। অর্থ হলো, ঘরে থাকা। যেহেতু এ মাসে লোকেরা ঘরে বসে থাকত, এ জন্য একে রবি নাম দেওয়া হয়েছে। আবার রবি অর্থ বসন্তকালও। এ মাসে আরবের প্রকৃতিতে বসন্ত লাগত, তাই এর নাম রবিউল আউয়াল বা প্রথম বসন্ত দেওয়া হয়েছে।

কেউ কেউ নামকরণের কারণ বলতে গিয়ে বলেছেন, আরবে বসন্তকাল দুই মাসজুড়ে হয়ে থাকে; রবিউল আউয়াল এবং রবিউল আখের। অর্থাৎ বসন্তের প্রথম ও শেষ বসন্ত। যে জিনিসের গণনায় তিন আছে সে ক্ষেত্রে ‘সানি’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এ দুই মাসের পরে যেহেতু এ নামে আর কোনো মাস নেই তাই রবিউস সানি না বলে রবিউল আখের বলাই ভালো। অনেকের মতে তো ‘সানি’ শব্দ ব্যবহারের অবকাশই নেই।

এ পৃথিবী যখন পাপের অন্ধকারে ভরে গিয়েছিল। মানবতা বিদূরিত হয়ে পশুত্বের বিজয়পতাকা উড্ডীন হয়েছিল। মানবজাতি পঙ্গপালের ন্যায় জাহান্নামে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। গোটা বিশ্ব যেন জাহিলিয়াতের ছোঁয়ায় আচ্ছন্ন ছিল। ঠিক সে সময়ের কোনো এক রবিউল আউয়াল মাসে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার সৃষ্টির ওপর দয়া করে নবী মুহাম্মদকে (সা.) ধরার বুকে রহমত হিসেবে প্রেরণ করেন। তাঁর আগমন বিশ্ববাসীর জন্য রহমত। মুমিন, কাফের, জিন-ইনসান সকলের জন্য তিনি রহমত। তাই ইসলামের ইতিহাসে রবিউল আউয়াল হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। জন্ম তাঁর যেমন এ মাসে। আবার এ মাসেই তিনি তাঁর ওপর অর্পিত রিসালাতের দায়িত্ব পালন শেষে নিজ প্রভুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে এই নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন এবং মহান আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্যে গমন করেন।

এ মাসেই তিনি মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করেন। সুতরাং একদিকে এ মাসে রাসুল (সা.)-এর শুভাগমন বিশ্ববাসীকে পুলকিত করে, অন্যদিকে এ মাসে তাঁর প্রস্থান মুসলিম বিশ্বকে শোকাভিভূত করে। তাই এ মাসটি একই সঙ্গে শোক ও আনন্দের। সে কারণেই এ মাসের আলাদা একটি মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে অন্যান্য মাসের ওপর।

সঙ্গত কারণেই এ মাসের দাবি হলো, নবীজির (সা.) মহব্বত-ভালোবাসা ও তাঁর স্মরণে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগিতে মনোযোগী হওয়া, নেক ও কল্যাণমূলক কাজ দিয়ে জীবনটাকে সজ্জিত করা। আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতগুলোর শুকরিয়া আদায় করা।

আর কিছু না হোক অন্তত এ মাসে সুন্নত বিরোধী কোনো কাজ না করা, বিদআত ও অপছন্দনীয় বিষয় হতে বিরত থাকা। নবীজির (সা.) কষ্টের কারণ হয় এমনসব কাজকর্ম হতে দূরে থাকা। তার আনিত শরিয়তের সাংঘর্ষিক ছোট ছোট কাজগুলোকেও অপছন্দের দৃষ্টিতে দেখা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, এসব ব্যাপারে অনেক নামধারী নবী প্রেমিকদের ধর্মের ব্যাপারে দুঃসাহস প্রদর্শন করতে দেখা যায়। তারা মূলত ধর্মের নামে অধর্ম ছড়ায়। ধর্মবিরোধী কর্মকাণ্ডগুলোকে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে প্রচার চালায়।

মহানবীর আগমনে একজন মুসলমান সবসময় কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আনন্দিত থাকবে, আনন্দ প্রকাশ করবে এটা তার কর্তব্য। তবে যুগে যুগে প্রতিবছর যখনই আল্লাহর নবীর আগমনের এ মাস আসে তখন আল্লাহর নবী প্রেমিকের মাঝে আনন্দ প্রকাশ, নতুন উদ্দীপনা শুরু হয় এবং আনন্দ প্রকাশের ধরন ও কাল পাত্রভেদে বিভিন্নরূপে রূপান্তরিত হয়। আনন্দ প্রকাশের বাহ্যিক রূপ হলো নবীজির জীবন-আদর্শ নিয়ে বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সভা-সমাবেশ করা। আর তার আধ্যাত্মিক রূপ হলো নবীজির নির্দেশনা, পয়গামকে ধারণ করা। নিজের জীবনকে নবীর সুন্নত অনুযায়ী গড়ে তোলা।

জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি অবস্থায়, লেনদেন, বিয়েশাদি, বেচাকেনা, খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম, হাসি-কান্নাসহ সর্বাবস্থায় প্রিয়নবীর সুন্নত অনুযায়ী জীবনযাপন করাই নবীর প্রতি ভালোবাসা। শুধু মুখে মুখে নবীর ভালোবাসার দাবি করলে ভালোবাসা হয় না। বরং নবীর সুন্নত মোতাবেক জীবনযাপন করলে নবীর ভালোবাসা হয়।

আল্লাহ তায়ালা বোঝার ও আমলের তওফিক দান করুন। আমিন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত