রাজু আহমেদ

২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ১২:৪২

ক্ষমতা, সমাজ ও শিক্ষকতা

একজন শিক্ষক তাঁর কর্মকালের চেয়েও অবসরকালে বেশি সম্মানিত হন। শিক্ষকতা ব্যতীত অন্য কোন পেশায় অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা/কর্মচারীকে মানুষ মনে রাখে? সম্মান করে?-সেটা জানা নাই। তবে সম্মান পাওয়ার জন্য আদর্শ শিক্ষক হতে হবে। শিক্ষকতাকে পেশার চেয়ে ব্রত হিসেবে যারা বেশি নিতে পেরেছেন, যুগে যুগে তারাই শিক্ষকতার পেশাকে মহৎ পেশায় রূপ দিয়েছেন।

শিক্ষকদের বঞ্চনার লম্বা ফর্দ আছে। তবে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়ানো একজন শিক্ষকের কোন আক্ষেপ নাই। কাউকে বাধ্য করা ছাড়াই সালামের উত্তর দিতে দিতে মুখ ব্যথা হয়ে যায়। বাজারের বড় মাছটি, দোকানের ভালো পোশাকটি শিক্ষকের পরিবার ভোগ করতে পারে না বটে, তবে এক ঢালি সম্মানের পল্লবে জীবন মোড়ানো থাকে।

সমাজ সুস্থতার দিকে যাচ্ছে নাকি অসুস্থতার পথে হাঁটছে তাঁর মানদণ্ড বোধহয় সমাজস্থদের চিন্তা-আচরণ। মানুষ এখন ক্ষমতা এবং টাকাকে সবচেয়ে দামী মনে করছে। ক্ষমতার কাছে মস্তক অবনত করছে। টাকার কাছে বোধ বিক্রি করছে। রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত মাইনেতে শিক্ষকের চেয়ে খুব বেশি অর্থ লাভে অন্যকোন পেশাজীবী এগিয়ে নাই। অথচ কোন শিক্ষকের বেগমপাড়ায় বাড়ি হয় না, দুর্নীতির হটলিস্টে শিক্ষকের নাম থাকে না। কাউকে বেদম পেটানো, যত্রতত্র কান ধরানো, গৃহছাড়া করা, সর্বোপরি অসীম ক্ষমতা প্রদর্শনের ক্ষমতা শিক্ষকের কোন কালেই ছিল না। যেহেতু সমাজ সম্মানের জায়গাকে সংকুচিত করে ক্ষমতাকে পূজো করছে সেহেতু শিক্ষকতায় মেধাবীরা ঝুঁকছে না, কেউ ক্ষণকালের জন্য শিক্ষকতায় আসলেও তাকে ধরে রাখা যাচ্ছে না। এই সমাজ নির্মাণ করলো কারা? তাদের দায় কী?

একজন শিক্ষক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের চেয়ে সম্মানিত কোন আমলার চিহ্ন রাষ্ট্রের কাছে নাই। রাষ্ট্র বিনির্মাণে, সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে সকল পেশাজীবীদের দরকার। শিক্ষকদের যদি কোণঠাসা করে রাখা হয় তবে রাষ্ট্রে সমালোচিত নেতাদের জন্ম হবে, রুচিহীন নাটক-সিনেমাওয়ালাদের উত্থান ঘটবে, বেগম পাড়ায় দেশের অর্থপাচারকারী কর্তৃপক্ষের সংখ্যা বাড়বে, রাতারাতি কোটিপতি হওয়াদের সারি দীর্ঘ হবে, বৈষম্যের পাহাড় মাথা তুলবে কিন্তু সমাজে মানুষের সংখ্যা কমে যাবে। হচ্ছেও তাই। মানবিক মানুষের সংখ্যা ক্রম হ্রাস পাচ্ছে। সহিংস রাজনীতির উত্থান হচ্ছে, লুটেরা গোষ্ঠীর দ্বারা দেশের অর্থ পাচার হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমানে শিক্ষাঙ্গনকে শিক্ষক যতোটা প্রভাবিত করতে পারছেন তার থেকে বহিরাগত গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপ বাড়ছে। শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ শিক্ষকদের অধিকার থেকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।

সমাজের গতিশীল অধঃপতনের কারণে, নীতি-নৈতিকতার দুর্লভ চর্চার কারণে কেবল বইতে শুদ্ধাচার বাড়ছে। কিন্তু সামগ্রিক ব্যক্তিজীবন এবং সমাজজীবনে শুদ্ধাচার যে সংকীর্ণতায় ডুবে যাচ্ছে তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে ক্ষমতা ও অর্থের জন্য অবৈধ প্রতিযোগিতা। কেউ শিক্ষকতা করছে-সেটাকে সমাজে ভালো চোখে দেখা হয় না কিন্তু দু’পয়সা বাড়তি কামাইয়ের সুযোগ আছে এমন সব পেশা ও পেশাজীবীদের প্রতি মানুষের প্রবল আকর্ষণ। ঘুষ-দুর্নীতি করা যায় এমন কোন পেশার কথা শুনলেই সমাজস্থদের চোখ চকচক করে ওঠে। যিনি ক্ষমতা দেখাতে পারেন, পদানত করতে পারেন ন্যায়কে তার কাছে সমাজ নুইয়ে থাকে। ঘুষ-দুর্নীতিবাজদের কাছে সমাজ ন্যাংটো হতেও দ্বিধাবোধ করে না। অথচ একজন স্কুল শিক্ষককে সম্মানের চোখে দেখা, প্রাপ্য সম্মান দেয়ায় এই সমাজের কৃপণতার সীমা নাই।

শিক্ষক সমাজের মধ্যে ক্ষয়িষ্ণুতার স্পর্শ লাগেনি তা দাবি করার সুযোগ নাই। শিক্ষকরাও শেষমেশ মানুষ! সমাজের হালচাল তাদের প্রভাবিত করে। চারদিকে ক্ষমতা ও অর্থের যে ঝনঝনানি তা যদি পুরোমাত্রায় শিক্ষকদের আচ্ছন্ন করে ফেলে-তবে এই সমাজের কী হাল হবে তা আন্দাজ করা যাচ্ছে? বৃহৎ জনগোষ্ঠীর শিক্ষক সমাজকে অবহেলা করে করে বৈষম্যের যে দেয়াল তোলা হচ্ছে তা ভালো কোন নিদর্শন নয়। লক্ষণ বলছে, খুব সহজে সে দেয়াল ভাঙবেও না।

মনে রাখতে হবে, নীতিবান-দেশপ্রেমিক প্রজন্ম গড়ার জন্য শিক্ষকদের ওপরেই ভরসা করতে হবে। শ্রেণিকক্ষের চেয়ে রাজনৈতিক মিছিল মিটিংকে বেশি ক্ষমতাশালী করলে কী হাল যে হতে পারে তার কিছু কিছু প্রকাশ বোধহয় রাষ্ট্রকে জানান দেয়া হয়েছে। শিক্ষকসমাজকে যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরেও সম্মানিত করা শুরু হবে তখনই শিক্ষার্থীরা পুরাদস্তুর সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে আরম্ভ করবে। যে শিক্ষকদেরকে তাদের অধিকার থেকে উপেক্ষিত রাখা হয়, বঞ্চনার ইতিহাস বুকে লালন করে যে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়ায়, সে শিক্ষকদেরকে শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করতে পারে না। শিক্ষার্থীরা যখন বুঝতে পারে তাদের শিক্ষক এই সমাজে মূল্যহীন তখন তারা গোটা শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই কিছু শেখার নাই-এমনটা মনে করে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত