সাদিয়া হুমায়রা

০৩ জানুয়ারি, ২০২৪ ১১:৫৮

রাজনীতির ময়দানে তারকাদের ভিড়

দীর্ঘদিন ধরেই ব্যবসায়ী ও আমলারা রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের পাশাপাশি এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের লড়াইয়ে নেমেছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রূপালী পর্দা ও খেলার মাঠের তারকা। রাজনীতির ময়দানে এত তারকার আনাগোনা শুভ নাকি অশুভ তা নিয়ে সবমহলে চলছে জোর বিতর্ক।

রাজনীতি নিঃসন্দেহে রাজনীতিবিদদের হাতেই সবচেয়ে বেশি সুন্দর ও মানানসই। তবে অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা রাজনীতিতে একেবারেই আসতে পারবেন না—গণতান্ত্রিক দেশে এমন কোনো কঠোর নিয়ম নেই। বিভিন্ন পেশাজীবীদের মধ্যে তুমুল রাজনীতি সচেতন এবং নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শের ধারক অনেক ব্যক্তি থাকেন, যাদের রাজনীতিতে আসা নিয়ে কারোই সাধারণত আপত্তি থাকে না।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীরা কিংবা স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়রা রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধ করেননি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান অনস্বীকার্য এবং তারাও আমাদের মুক্তিযোদ্ধা। এই মানুষগুলোর দেশপ্রেম কিংবা রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন থাকার কথা নয়।

সেলুলয়েডের মিষ্টি মেয়ে কবরী চলচ্চিত্রের পাশাপাশি রাজনীতির মাঠেও সফল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ ও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ ও পোশাক সংগ্রহকারী শিল্পীদের একজন ছিলেন কবরী। বাংলাদেশের জন্য বিশ্ববাসীর কাছে সহায়তার আহ্বান সম্বলিত কবরীর একটি ভাষণ মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের ‘আকাশবাণী' থেকে অনেকবার বাজানো হয়েছে। তাছাড়া শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে রাজনীতির বই পড়তেন তিনি। আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচনও করেছিলেন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের টালমাটাল সময়ে যা প্রয়াত এই সংসদ সদস্যের রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রমাণ দেয়।

জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রেসিডিয়াম সদস্য চিত্রনায়ক মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগের প্রয়াত সংসদ সদস্য চিত্রনায়ক ফারুকও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে থাকাকালীন ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন।

আবার অনেকে রাজনীতি না করেও নানান রকম গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকেন যা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের "নিরাপদ সড়ক চাই" আন্দোলনের কথা বলা যায়। এ ধরনের সামাজিক আন্দোলনের উদ্যোক্তা মানুষকেও রাজনীতির ময়দানে স্বাগতই জানানো হয়ে থাকে। কিন্তু অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা যখন রাজনীতিতে আসতে চাইবেন তার আগে তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা, জনসম্পৃক্ততা, দেশপ্রেম ও নির্দিষ্ট আদর্শের প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ দিয়ে রাজনীতিতে আসার রীতিটি শক্তভাবে চালু থাকা উচিত। অথবা তাদের সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিজের দক্ষতার প্রমাণ রাখতে হবে। কিন্তু প্রায় সময়ই দেখা যাচ্ছে, পুরোপুরি জনবিচ্ছিন্ন এবং ন্যূনতম রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়াই বাংলাদেশের বিভিন্ন জগতের তারকারা সরাসরি এমপি হওয়ার আবদার করছেন যা একটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য ইতিবাচক নয়।

বাংলাদেশ ছাড়াও উপমহাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংস্কৃতি কর্মী ও খেলোয়াড়েরা রাজনীতিতে এসেছেন। ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নায়ক-নায়িকার ভিড় লেগে আছে। রাজনীতি করছেন পাকিস্তানের ক্রিকেটার ইমরান খান এবং নেপালি সেলেব্রিটি বালেন শাহ, রবি মালিচানরা।

রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের সামনে নিজেদের একটা সজীব, স্বচ্ছ ইমেজ তৈরি করতে তারকাদের বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে, সাধারণ জনগণ পার্টিগুলোর পরিবারতন্ত্র চর্চার প্রতি বিরক্তি এবং মূলধারার নেতাদের দুর্নীতি-সন্ত্রাসের প্রতি ঘৃণা থেকে তারকাদের রাজনীতি অঙ্গনে দেখতে আগ্রহী হচ্ছেন। তবে বাংলাদেশের জনগণের একটা বিরাট অংশ সার্বজনীন তারকাদের শরীরে দলীয় তকমা লাগানোকে অপছন্দের চোখেই দেখেন। তারপরও চলচ্চিত্র, সংগীত ও ক্রীড়া জগতের তারকারা উৎসাহ নিয়ে আমাদের দেশে রাজনীতিতে আসছেন এটাই বাস্তবতা।

এই বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়েই আমাদের হিসাব কষতে হবে, তারকারা আসলে কী উদ্দেশ্যে রাজনীতিতে আসছেন। নিজেদের সামাজিক মর্যাদা, প্রতিপত্তি কিংবা অর্থ উপার্জনই কি তাদের লক্ষ্য, নাকি আদৌ তারা জনগণকে কিছু দিতে পারছেন? সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কিংবা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ত্রুটি-বিচ্যুতি সারাতে তারকাদের কোনো ভূমিকা আছে কি না সেটাও জনগণকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসের নিচে রেখে যাচাই করতে হবে। কারণ দিনশেষে রাজনীতির মুখ্য উদ্দেশ্য দেশ ও জনগণের সেবা করাই। এই উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হলে তারকাদের রাজনীতির ময়দানে আসার কোনো অর্থই থাকে না।

  • সাদিয়া হুমায়রা: লেখক ও সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য

আলোচিত