মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

১২ জানুয়ারি, ২০২৪ ১৭:৫৬

দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি রোধ: ইসলামী দৃষ্টিকোণ

সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ সমাজবদ্ধভাবে একত্রে মিলেমিশে বসবাস করে। প্রয়োজনের তাগিদে একে অন্যের সাথে পারস্পরিক লেনদেন এবং জিনিসপত্রের আদান-প্রদান করে থাকে। প্রাত্যহিক লেনদেনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ব্যবসায়-বাণিজ্য। ব্যবহারিক জীবনে ব্যবসায়-বাণিজ্যে পণ্য ও মূল্যের বিনিময় হয়ে থাকে। ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে পণ্য ও মূল্যে যৌক্তিক বিনিময় আদান প্রদান হওয়া কাম্য হওয়া সত্ত্বেও যখন বিক্রেতা অতি মুনাফার লোভে চড়া মূল্যে বিক্রয় করার জন্য পণ্য সামগ্রী কুক্ষিগত করে, তখন একে বলে মজুদদারি। এর ফলে পণ্যের মূল্য বেড়ে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায় এবং জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ইসলাম এ সমস্যা সমাধানে যথাযথ দিক-নির্দেশনা দিয়েছে। ইসলাম মজুদদারিকে হারাম ঘোষণা করত: অতি মুনাফা অর্জনের মানসিকতা পরিহারের নির্দেশ দিয়েছে। মজুদদারির কারণে কোন ভাবেই যেন জনজীবন বিপর্যস্ত না হয়ে পড়ে, সে জন্য কুরআন ও হাদিসে এর প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে মজুদদারির বিভিন্ন দিক আলোচ্য প্রবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে।

মজুদদারি-এর পরিচয়: পারস্পরিক সম্পর্ক ও লেনদেনের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখার স্বার্থে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ইসলাম নিয়ম-নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ব্যবসায়-বাণিজ্য। ইসলাম ব্যবসায়-বাণিজ্য উৎসাহিত করতে যেমন বিভিন্ন রকম জাগতিক ও পারলৌকিক প্রাপ্তির ঘোষণা দিয়েছে তদ্রূপ বিভিন্ন ধরনের নৈরাজ্যকর ও অবাঞ্ছনীয় পদক্ষেপ প্রতিরোধে জাগতিক এবং পারলৌকিক শাস্তিও ঘোষণা করেছে। পণ্য সামগ্রী জমা রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সমাজের দুর্ভোগ বৃদ্ধি ও অতি মুনাফা অর্জন করাকে দণ্ডনীয় কাজ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

আভিধানিক অর্থ: মাওজুদ ও মজুদ শব্দ থেকে মজুদদারি শব্দটি এসেছে। মাওজুদ অর্থ হচ্ছে, সঞ্চিত, জমা, হাজির, উপস্থাপিত ইত্যাদি। আর মজুদদারি অর্থ হচ্ছে, দ্রব্যাদি অন্যায়ভাবে মজুদ বা জমা রাখা। যে ব্যবসায়ী অন্যায়ভাবে দ্রব্যাদি মজুদ করে রাখে তাকে মজুদদার বলা হয়। ‘‘শৈলেন্দ্র্যে বিশ্বাস, সংসদ বাংলা অভিধান, কলকাতা সাহিত্য সংসদ, ২০০২, পৃ. ৬৭৬’’।

আরবি ভাষায় মজুদদারিকে ইহতিকার বলা হয়। ইহতিকার শব্দের অর্থ হচ্ছে: একচেটিয়াকরণ, একচ্ছত্র সুবিধাভোগ, মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পণ্য ধরে রাখা ইত্যাদি। ‘‘ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, আধুনিক আরবি বাংলা অভিধান (আল-মুজামুল ওয়াফী), ঢাকা: রিয়াদ প্রকাশনী, ২০০৯, প. ৪২’’।

লিসানুল আরব গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, ইহতিকার শব্দটি (হাকরুন) শব্দমূল থেকে এসেছে। শব্দের অর্থ হচ্ছে, খাদ্য সামগ্রী আটকে রেখে পুঞ্জীভূত করা। যে আটক রাখে তাকে (মুহতাকির) বলে। ‘‘ইবনে মানযুর, লিসানুল আরব, আল-কাহেরা: দারুল হাদিস, ২০০৩, পৃ. ৫৩৭’’। আররায়িদ প্রণেতা বলেন শব্দের অর্থ হচ্ছে, অন্যায়ভাবে হ্রাস করা, দুর্ব্যবহার করা, পণ্য সামগ্রী আটকে রাখা এবং উচ্চমূল্যে লাভবান হওয়া ইত্যাদি। কিন্তু ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শেষ অর্থটিই উদ্দেশ্য। ‘‘জাবরান মাসউদ. আর-রায়িদ, বৈরুত: দারুল ইলম লিল-মায়ায়িন, ১৯৯২, পৃ. ৩১৩’’। আল-মুনজিদ অভিধানে বলা হয়েছে, ‘‘পণ্য মজুদ করে চড়া মূল্যের অপেক্ষায় আটকে রাখা। অতঃপর মূল্য বৃদ্ধি পেলে অধিক মুনাফায় তা বিক্রি করা’’। ‘‘কামিল ইসকান্দর হুশাইমার তত্ত্বাবধানে রচিত, আল-মুনজিদ ফিল লুগাতি ওয়াল-আলাম, বৈরুত: দারুল মাশরিক, ২০০০, পৃ. ১৪৬’’।

পারিভাষিক অর্থ: ইসলামী আইনশাস্ত্রবিদদের মতে, ইসলামী পরিভাষায় মজুদদারি হচ্ছে, খাদ্যশস্য মজুদ করে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করা। অত:পর মূল্য বৃদ্ধি পেলে তা বিক্রি করে প্রচুর পরিমাণে লাভবান হওয়া।

আল-হিদায়া প্রণেতার ভাষায়: অর্থাৎ-ইহতিকার বা মজুদদারি হচ্ছে, খাদ্য সামগ্রী ক্রয় করে মূল্য বৃদ্ধির আশায় গুদামজাত করা। ‘‘বুরহানুদ্দীন আল-মারগিনানী, আল-হিদায়া, দিল্লী: মাতবায়া মুজতাবাই, ১৯০৭, পৃ. ৪৫৪’’।

‘‘ইহতিকার হচ্ছে, খাদ্য সামগ্রী বা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী ক্রয় করে উচ্চ মূল্যের জন্য চল্লিশ দিন পর্যন্ত পর্যন্ত আটক রাখা’’। ‘‘ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, রাদ্দুল মুহতার, সাহারানপুর: মাকতাবায়ে যাকারিয়া, ১৯৯৬, খ. ৯, পৃ. ৫৭১’’।

ইমাম আবু ইউসূফ’র এর মতে- ‘‘যে সকল জিনিস আটকে রাখলে সর্বসাধারণের কষ্ট হয়, তাকে ইহতিকার বা মজুদদারি বলে’’। ‘‘বুরহানুদ্দীন আল-মারগিনানী, আল-হিদায়া, দিল্লী: মাতবায়া মজুতাবাই, ১৯০৭, পৃ. ৪৫৪’’।

ইমাম গাযালী র. বলেন, ‘‘মজুদদারি হলো, খাদ্য শস্য ক্রয় করত: মূল্য বৃদ্ধি পেলে বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে মজুদ করে রাখা’’। ‘‘ইমাম গাযালী, (অনু. আব্দুল খালেক) সৌভাগ্যের পরশমণি, ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৯৩, খ. ২, পৃ. ৭২’’।

ফাতওয়ায়ে রাহমানিয়ায় বর্ণিত হয়েছে, ‘‘মানুষ বা প্রাণির প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী ও জিনিসপত্র সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে ক্রয় করে এমনভাবে জমা করে রাখা যে, বিশেষ প্রয়োজনের মুহূর্তেও (অর্থাৎ যখন উক্ত মালের অভাবে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণির কষ্ট হয়) আরও বেশি মুনাফার আশায় বিক্রয় না করাকেই ইহতিকার বা মজুদদারি বলা হয়’’। ‘‘মুফতি মাওলানা মানসূরুল হক, ফাতাওয়ায়ে রাহমানিয়া, ঢাকা: মাকতাবাতুল আশরাফ, ১৪২৭ হি., খ. ২, পৃ. ১৬৭’’।

অর্থনীতির দৃষ্টিতে- Wikipedia-তে অর্থনীতির ভাষায় মজুদদারির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, Hoarding is the practice of buying up and holding resources so that they can be sold to customers for profit. ‘‘মজুদদারি হচ্ছে, পণ্য সামগ্রী ক্রয় করে আটকে রাখার কারবার, যা পরে অধিক মুনাফায় ক্রেতার কাছে বিক্রি করা হবে’’।

পুঁজিবাদী তত্ত্বের ভিত্তিতে মজুদদারির সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এভাবে, If this is done so that the resource can be transferred to the customer or improved upon, then it is a standard business practice (eg buying up a bunch of wood to turn into a house); however, if the sole intent is to hold an otherwise unavailable resource it is considered hoarding. ‘‘যদি এ কারবার এমন হয় যে, এই পণ্য সামগ্রী ক্রেতার কাছে হস্তান্তর করা হবে বা এ থেকে উৎকৃষ্ট কিছু উৎপন্ন করা হবে, তাহলে এটা একটি উত্তম ব্যবসায়িক কারবার যেমন: কাঠ ক্রয় করে ঘর তৈরি করা; আর যদি ক্রয়ের উদ্দেশ্য হয় দু®প্রাপ্য পণ্য সামগ্রী আটকে রাখা, তাহলে তা মজুদদারি হিসেবে বিবেচিত হবে’’। ‘Internet, I: \Food Hoarding\Hoarding (economics)- Wikipedia, the free encyclopedia.htm’|

মজুদদারির ধরন: মজুদদারি বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। ক্রেতা ও বিক্রেতার উপর নির্ভর করে এর ধরনের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে কয়েকটি ধরন উপস্থাপিত হলো-
আংশিক মজুদদারি: অল্প সংখ্যক উৎপাদনকারী বা বিক্রেতা কোন একটি নির্দিষ্ট পণ্য মজুদ করে রাখবে। আর তাদের এই মজুদের কারণে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির পাবে।

পারস্পরিক মজুদদারি: বিক্রেতা বা উৎপাদনকারী নির্দিষ্ট একটি পণ্য আটকে রাখবে। আর এই পণ্যের ক্রেতা থাকবে একজন। ক্রেতাও এই পণ্যের ক্রয় আটকে রাখবে। এখানে পণ্যের মূল্য এই ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে পারস্পরিক দরকষাকষির উপর নির্ভরশীল থাকবে।

পূর্ণাঙ্গ মজুদদারি: কোন ব্যক্তি একটি পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রয় আটকে রাখবে। আর এই পণ্যের বিকল্প দেশের ভিতরে বা বাইরে কোথাও পাওয়া যাবে না।

রাষ্ট্রীয় মজুদদারি: কোন রাষ্ট্র কোন একটি পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করবে। পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি বা পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে কখনো পণ্যের উৎপাদন কমিয়ে দিবে বা সরবরাহ যাতে ব্যাহত হয়, সে জন্য বিভিন্ন অপকৌশল গ্রহণ করবে।

আল-কুরআন মজুদদারি প্রসঙ্গ: ইসলাম ব্যবসায়-বাণিজ্যকে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু খাদ্য সামগ্রী ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আটকে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে অধিক মুনাফা অর্জনের মানসিকতাকে ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। দুনিয়া ও আখিরাতে মজুদদারির ভয়াবহ শাস্তির কথা কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। ইহতিকার সম্পর্কে আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন, ‘‘যারা সোনা রূপা (ধন-সম্পদ) জমা করে এবং আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না তাদের জন্য আপনি যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সংবাদ দিন। সে দিন এসব ধন-সম্পদ আগুনে গরম করা হবে। অত:পর তা দিয়ে তাদের কপাল, পাঁজর আর পিঠে দাগ দেয়া হবে। (বলা হবে), তোমরা যা কিছু নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে এগুলো তো সেসব ধন-সম্পদ। সুতরাং তোমরা যা কিছু জমা করে রেখেছিলে, এখন তার স্বাদ আস্বাদন করো’’। ‘‘আল কুরআন, ৯: ৩৪-৩৫’’। অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘যাতে ধন-সম্পদ শুধু বিত্তবানদের মধ্যে পুঞ্জীভূত না হয়’’। ‘‘আল-কুরআন, ৫৯:৭’’। এ সকল আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে, ধন-সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখাকে অর্থনৈতিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কেননা এতে ধন-সম্পদ বিকেন্দ্রীকরণ ও বণ্টন হওয়ার পরিবর্তে শ্রেণী ও সম্প্রদায়-বিশেষের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে আর সাধারণ মানুষ হয় নি:স্ব ও দরিদ্র। লেনদেনেও স্থবিরতা দেখা দেয় এবং উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। অনুরূপভাবে পণ্য সামগ্রী আটকে রাখার ফলেও একই রকম সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং সম্পদ পুঞ্জীভূতকারী এবং পণ্য মজুদকারী সমান অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়কে শাস্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

আল্লাহ তাআলা দৃষ্টান্ত স্বরূপ আল-কুরআনে কারুনের ঘটনা উল্লেখ করেন। কারুন ধন-সম্পদ জমা করে স্বীয় সম্প্রদায়ের প্রতি অন্যায় আচরণ করে এবং জমিনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ফলে আল্লাহ তাআলা তাকে, তার ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পদসহ জমিনে ধসিয়ে দিয়ে শাস্তি দেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘‘কারুন ছিল মুসা আ. এর সম্প্রদায়ভুক্ত। সে তার প্রতি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করল। আমি তাকে এত ধন-ভাণ্ডার দান করেছিলাম, যার চাবি বহন করা কয়েক জন শক্তিশালী লোকের পক্ষে কষ্টসাধ্য ছিল। যখন তার সম্প্রদায় তাকে বলল, দম্ভ করো না নিশ্চয় আল্লাহ দাম্ভিকদের ভালবাসেন না। আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন, তা দ্বারা পরকালের গৃহ অনুসন্ধান কর এবং ইহকাল থেকে তোমার অংশ ভুলে যেয়ো না। তুমি অনুগ্রহ কর যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ অনর্থ সৃষ্টিকারীদেরকে পছন্দ করেন না। সে বলল, আমি এই ধন-সম্পদ আমার নিজস্ব জ্ঞান-গরিমা দ্বারা অর্জন করেছি। সে কি জানে না যে, আল্লাহ তার পূর্বে অনেক সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছেন, যারা শক্তিতে ছিল তার চাইতে প্রবল এবং ধন-সম্পদে অধিক সমৃদ্ধ। পাপীদেরকে কি তাদের পাপ কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে না’’। ‘‘আল-কুরআন, ২৮: ৭৬-৭৮’’। কারুন ছিল অহংকারী। সে অঢেল ধন-সম্পদের মালিক ছিল। তার সম্প্রদায় তাকে এ থেকে দান করার জন্য উপদেশ দিয়েছিল কিন্তু সে দান করেনি। বরং আরও ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে বলেছিল; ধন-সম্পদ সে নিজ জ্ঞান-গরিমায় অর্জন করেছে। আল্লাহ সীমালঙ্ঘন ও অবাধ্যতার কারণে তাকে তার ধন-সম্পদ, সহায়-সম্পত্তি ও বাড়ি-ঘরসহ ধ্বংস করে দেন।

আল-হাদিসের মজুদদারি প্রসঙ্গ: ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে অতি মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী মজুদ করে আল্লাহর সৃষ্টিকে কষ্ট দেয়া ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ। রসুলল্লাহ স. পণ্য মজুদ করাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেন। তিনি বলেছেন, ‘‘যে লোক চল্লিশ দিন খাদ্য শস্য মজুদ করে রাখল, সে আল্লাহ থেকে নি:সম্পর্ক হয়ে গেল এবং আল্লাহও নি:সম্পর্ক হয়ে গেলেন তার থেকে’’। ‘‘ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ, আল-কাহেরা: দারুল হাদিস, ১৯৯৫, খ. ৪, পৃ. ৪৩৭, হাদিস নং ৪৮৮০’’।

অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য পণ্যদ্রব্য মজুদ করা থেকে বিরত থাকতে রসূলুল্লাহ স. নির্দেশ দিয়েছেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে ‘‘অধিক মূল্যে বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে খাদ্যদ্রব্য আটক করে রাখতে নবী স. নিষেধ করেছেন’’। ‘‘মুয়াফ্ফিকুদ্দীন ও শামসুদ্দীন, আ-মুগনী ওয়াশ শারহুল কাবীর আলা মাতানিল মুকনি ফি ফিকহিল ইমাম আহমদ, বৈরুত: দারুল ফিতর, তাবি, খ. ৪, পৃ. ৩০৫’’।

যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে রাখে সে চরম অপরাধী। এ প্রসঙ্গে রসূলুল্লাহ স. বলেন, ‘‘অপরাধী ব্যক্তি ছাড়া কেউ পণ্য মজুদ করে রাখে না’’। ‘‘ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: আল-মুসাকাত ওয়াল মুযারায়াত, অনুচ্ছেদ: তাহরীমুল ইহতিকার ফিল-আকওয়াত, আল-কুতুবুস সিত্তাহ, রিয়াদ: দারুল সালাম, ২০০০, পৃ. ৯৫৭’’।

এ অপরাধী কথাটি সহজ অর্থে নয়। যে পণ্য মজুদ করে সে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে। কুরআন মাজীদে ফিরাউন, হামান প্রভৃতি বড় বড় কাফির আল্লাহ দ্রোহীদের সম্পর্কে এ শব্দটির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন বলা হয়েছে, ‘‘নিশ্চয় ফিরাউন ও হামান এবং তাদের সৈন্য সামন্ত বড় অপরাধী ছিল”। “আল-কুরআন, ২৮:৮” মজুদদরাও খাদ্য সামগ্রী পুঞ্জীভূত রেখে আল্লাহর সৃষ্টিকে কষ্ট দেয়ার কারণে এরাও কাফির ও আল্লাহ দ্রোহীদের ন্যায় জঘন্য অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে।

রসূলুল্লাহ স. আরও বলেছেন, “বাজারে পণ্য আমদানীকারক রিজিক প্রাপ্ত হয়। আর পণ্য মজুদকারী অভিশপ্ত হয়”। “ইমাম ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, অধ্যায়: আত-তিজারাত, অনুচ্ছেদ: আল-হুকারাতু ওয়াল জালব, আল-কুতুবুস সিত্তাহ, দারুস সালাম, ২০০০, পৃ. ২৬০৬”। আল্লামা ইউসুফ কারযাভী এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, “ব্যবসায়ী দুই ভাবে মুনাফা লাভ করে। একটি হচ্ছে, সে পণ্যদ্রব্য মজুদ করে অধিক মূল্যে বিক্রয় করার আশায় অর্থাৎ পণ্য আটক করে রাখলে বাজারে তার তীব্র অভাব দেখা দেবে তখন যতো চড়া মূল্যই দাবি করা হোক না কেন, তাই দিয়েই তা ক্রয় করতে বাধ্য হবে।

আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ব্যবসায়ী পণ্য বাজারে নিয়ে আসবে এবং অল্প অল্প মুনাফা নিয়েই তা বিক্রয় করে দেবে। পরে এই মূলধন দিয়ে সে আরও পণ্য নিয়ে আসবে এবং তাতেও সে মুনাফা পাবে। এভাবে তার ব্যবসায় চলতে থাকবে ও পণ্যদ্রব্য বেশি কাটতি ও বিক্রয় হওয়ার ফলে অল্প অল্প করে মুনাফা হতে থাকবে। মুনাফা লাভের এই নীতি ও পদ্ধতিই সমাজ সমষ্টির পক্ষে কল্যাণকর।” “আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী, অনু. মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, ইসলামে হালাল হারামের বিধান, ঢাকা: খায়রুন প্রকাশনী, ২০১০, পৃ. ৩৫৫”। মজুদদাররা হিংস্র মনোভাব পোষণকারী হয়ে থাকে। এরা সব সময় উচ্চ মূল্যের প্রত্যাশায় থাকে। এরা যদি কখনো শুনতে পায় যে, পণ্যমূল্য কমে গেছে, তাহলে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। আর যদি শুনতে পায় মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে তাহলে উল্লাসিত হয়। এ জন্য অন্য আরেক হাদিসে এসেছে, পণ্য মজুদকারী ব্যক্তির উপর সমস্ত সৃষ্টিকুলের অভিসম্পাত বর্ষিত হয়।

মজুদদারি বিষয়ে খোলাফায়ে রাশেদীনের ভূমিকা ঃ খোলাফায়ে রাশেদীনও মজুদদারির বিষয়ে কঠোর ছিলেন। খলিফা উমর রা. ব্যবসায়ীদের পণ্য মজুদকরণ সম্পর্কে ঘোষণা করেছিলেন, “আমাদের বাজারে কেউ যেন পণ্য মজুদ করে না রাখে। যাদের হাতে অতিরিক্ত অর্থ আছে তারা যেন বহিরাগত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সমস্ত খাদ্যশস্য কিনে তা মজুদ করে না রাখে। যে ব্যক্তি শীত-গ্রীষ্মের কষ্ট সহ্য করে আমাদের দেশে খাদ্যশস্য নিয়ে আসে সে উমরের মেহমান। অতএব সে তার আমদানির খাদ্যশস্য যে পরিমাণে ইচ্ছা বিক্রি করতে পারবে, আর যে পরিমাণে ইচ্ছা রেখে দিতে পারবে”।“ইমাম মালিক, আল-মুয়াত্তা, আল-কাহেরা: দারু ইবনিল হায়সাম, ২০০৫, পৃ. ২৭৫, হাদিস নং-১৩২৯”

উসমান রা. তাঁর খিলাফত কালে পণ্য মজুদ নিষিদ্ধ করেছিলেন। আলী রা. মজুদদারির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তাঁর খিলাফাতকালে মজুদকৃত খাদ্যদ্রব্য আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। যেহেতু মজুদদারি জনসাধারণের স্বার্থের পরিপন্থী তাই ইসলামে তা নিষিদ্ধ। মজুদদারির কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে। কেননা এমন অনেক প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী রয়েছে যেগুলো পরিহার করে চলা যায় না। তাই ইসলাম নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সুলভ মূল্যে বিক্রয় করার জন্য কঠোর নির্দেশ দিয়েছে। আর যে কোন ধরনের মজুদদারিকে জঘন্য ধরনের অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছে। রসূলুল্লাহ স. থেকে শুরু করে খোলাফায়ে রাশেদীনসহ পরবর্তী সাহাবা কিরামগণ মজুদদারির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।

মজুদদারির পরিণাম: যারা আল্লাহর সৃষ্টজীবকে কষ্ট দিয়ে অধিক মুনাফা অর্জনের লক্ষে দ্রব্য সামগ্রী মজুদ করে রাখে, তাদের জন্য আখিরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। দুনিয়াতেও তাদের ভয়াবহ পরিণতির কথা কুরআন ও হাদিসে ঘোষণা করা হয়েছে। কুরআনে আল্লাহ কারুনের ঘটনা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ কারুনকে তার ধন-ভাণ্ডার ও গৃহ-আসবাবসহ জমিনে দাবিয়ে দিয়ে শাস্তি দিলেন। রসূলুল্লাহ স. বলেছেন, “যে ব্যক্তি মুসলিম সম্প্রদায়ের খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে রাখবে আল্লাহ তাকে দুরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দিয়ে শাস্তি দিবেন”। “ইমাম ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬০৬”

মজুদদারির প্রভাব: বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের অর্থব্যবস্থা চালু রয়েছে। অর্থব্যবস্থার ভিন্নতার প্রেক্ষিতে মজুদদারিতেও বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় রাষ্ট্র দ্রব্য সামগ্রী মজুদ করে রাখে। আবার পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তি পণ্য মজুদ করে থাকে। তবে দুই অর্থব্যবস্থাতেই মজুদদারির পরিণতি ভয়াবহ। এ ছাড়াও আরও কিছু ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যেমন-
১. ব্যক্তি ও রাষ্ট্রসমূহের মাঝে প্রতিযোগিতার মনোভাব নষ্ট হয়ে যায়। কেননা প্রতিযোগিতা না থাকলে ব্যবসায়-বাণিজ্যে গতি সঞ্চার হয় না এবং উৎপাদনও বৃদ্ধি পায় না। ফলে জাতীয় অর্থনীতি মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়।

২. অনেক সময় আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমে যাওয়ার আশংকায় আমদানিকৃত পণ্য সামগ্রী ধ্বংস করে দেয়া হয়। কেননা আমদানিকৃত পণ্যের অবাধ প্রবাহের ফলে দ্রব্যমূল্য কমে যায়। মুনাফা স্থিতিশীল রাখতে ব্যবসায়ীরা আগুনে পুড়িয়ে বা সমুদ্রে ফেলে পণ্য ধ্বংস করে। ফলে খাদ্যের মারাত্মক সংকট ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।

৩. মজুদদারি সমাজে লোভ, হিংসা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ার কারণ হয়। ফলে সামাজিক মূল্যবোধ হ্রাস পায়। মানুষের মাঝে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এক সময় সমাজের কাঠামো ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়।

৪. সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব বেড়ে যায়। ফলে আইন শৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি ঘটে। আর অর্থনীতিতে চরম মন্দা ও অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করে।
মজুদদারি নিষিদ্ধ হওয়ার শর্তাবলী ঃ আল্লামা ইউসুফ কারযাভী বলেন, মজুদদারি দু’টি শর্তে হারাম। যথা- ১. এমন এক স্থানে ও এমন সময় পণ্য মজুদ করা হবে যার কারণে জনগণের তীব্র অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে। ২. মজুদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে অধিক মূল্য হরণ। যার ফলে মুনাফার পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে। “আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী, অনু. মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, ইসলামে হালাল হারামের বিধান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫৬”

আল-মুগনী ওয়াশ মারহুল কাবীর আলা মাতানিল মুকনি ফি ফিকহিল ইমাম আহমাদ গ্রন্থকারের মতে তিনটি শর্তে মজুদদারি হারাম। যথা- ১. পণ্য ক্রয়কৃত হতে হবে। যদি পণ্য আমদানিকৃত হয় বা নিজস্ব উৎপাদিত হয়, আর তা মজুদ করে রাখে তাহলে ইহতিকার হিসেবে গণ্য হবে না। ২. পণ্য একান্ত প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য হতে হবে। সুতরাং মসলা, হালুয়া, মধু, যায়তুন, গবাদি পশুর শুকনো খাদ্য ইত্যাদি মজুদ করে রাখলে তা হারাম হবে না। ৩. পণ্য ক্রয়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগে নিপতিত হওয়া। এর আবার দু’টি পর্যায় রয়েছে- ক. ছোট শহর যেখানে পণ্য মজুদ করলে মানুষের কষ্ট হবে এবং মূল্য বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। এমতাবস্থায় ইহতিকার হারাম। খ. পণ্য সামগ্রীর সংকট বা অভাবের সময় যদি কোন বণিকদল দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে শহরে প্রবেশ করে আর ধনী লোকেরা দ্রুত তাদের কাছ থেকে তা কিনে নেয়, ফলে মানুষের মাঝে পণ্যের সংকট দেখা দেয়, তাহলে ইহতিকার হারাম হবে। আর যদি খাদ্য সামগ্রী বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুদ থাকে এবং কম মূল্যে ক্রয় করা যায়। আর এতে মানুষের কষ্ট না হয় তাহলে ইহতিকার হারাম হবে না।“মুয়াফ্ফিকুদ্দীন ও শামসুদ্দীন, আল-মুগনী ওয়াশ শারহুল কাবীর আলা মাতানিল মুকনি ফি ফিকহিল ইমাম আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০৬”। আল-হিদায়া গ্রন্থকারের মতে, পণ্য মানুষ ও চতুষ্পদ জন্তুর খাদ্য হতে হবে এবং মজুদদারির কারণে মানুষ ও জীবজন্তুর কষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে হবে। আর যদি কষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে তাহলে ইহতিকার করা নিষিদ্ধ নয়।“বুরহানুদ্দীন আল-মারগিনানী, আল-হিদায়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৪”

মজুদদারির বিধান: মালিকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবের অধিকাংশ আলেমের মতে মজুদদারি সম্পূর্ণ হারাম। কিন্তু হানাফী আলিমগণের মতে মজুদদারি মাকরূহ। রাদ্দুল মুহতার গ্রন্থকার বলেছেন, মানুষ ও পশুর খাদ্যদ্রব্য মজুদ করার কারণে যদি সেখানকার অধিবাসীদের কষ্ট বা ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে তাহলে মজুদ করা মাকরূহ। আর যদি ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে তাহলে মাকরূহ হবে না।“ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, রদ্দুল মুহতার, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৭১”
ইমাম গাযালী র. এর মতে, মজুদদারি হারাম। তিনি এর কারণ উল্লেখ করে বলেন, এতে আল্লাহর বান্দাগণের কষ্ট ও অনিষ্ট সাধিত হয়ে থাকে। কোন ব্যক্তি সমস্ত শস্য ক্রয়পূর্বক আটক করে রাখলে অবশিষ্ট সকলেই এ থেকে বি ত থাকবে। এ উদ্দেশ্যে খাদ্যশস্য খরিদ ও মজুদ করে রাখা পাপ।“ইমাম গাযালী, অনু. আব্দুল খালেক, সৌভাগ্যের পরশমণি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৩”

ইহতিকার এর উদ্দেশ্য যদি হয় মাল আটক রেখে মূল্য প্রচুর বৃদ্ধি পেলে তা বিক্রি করা এবং অন্যান্য প্রাণির কষ্ট দুর্ভোগ বিবেচনা না করে সম্পদ আটক রাখা তবে তা শরীয়তে জায়েয নয়। কিন্তু যে ব্যক্তি নিজের উৎপাদিত প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী জমা করে বা দূরবর্তী এলাকা যেখান থেকে সাধারণত সংশ্লিষ্ট এলাকায় খাদ্য সামগ্রী ও জরুরী জিনিসপত্র আসে না, সেখান থেকে ক্রয় করে এনে জমা করে রাখে বা নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী ও জিনিসপত্র ছাড়া অন্য জিনিসপত্র যা মৌলিক প্রয়োজনে পড়ে না এমন জিনিস জমা রাখে, তাহলে সে ব্যক্তি শরীয়তের দৃষ্টিতে মজুদদার গণ্য হবে না।

তবে উল্লেখিত অবস্থায় যদি মানুষ কিংবা প্রাণির বিশেষ প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে সম্পদ আটক না রেখে ন্যায্য মূল্যে বিক্রয় করা ইসলাম ও মনুষ্যত্বের দাবি।“আশ-শায়েখ নিজামুল হিন্দ আল-আলাম, ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী, সাহারানপুর: মাকতাবায়ে যাকারিয়া, তা.বি. খ. ৩, পৃ. ২১৩-১৪”

মজুদদারি নিষিদ্ধকরণে সরকারের কর্তৃত্ব: আলিমগণের সর্বসম্মত মত হলো, যদি সর্বসাধারণের উপর দুর্ভিক্ষের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে বা নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর ঘাটতি দেখা দেয় এবং সর্বসাধারণের মাঝে হাহাকার লেগে যায়, তখন সরকার ন্যায্য মূল্যে খাদ্য সামগ্রী বিক্রি করতে মজুদদারদের বাধ্য করতে পারবে। বাজারের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে। অতি মুনাফার লোভে খাদ্য সামগ্রী আটক রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির অপরাধে সরকার ব্যবসায়ীকে শাস্তিও প্রদান করতে পারবে। ইমাম ইবনে আবেদীন র. তাঁর রাদ্দুল মুহতার গ্রন্থে বলেন, মজুদদারির কারণে দেশে খাদ্য শস্যের অভাবে চরম দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সরকার মজুদদার শ্রেণিকে তাদের প্রয়োজনীয় খোরাকী রেখে অবশিষ্ট সমস্ত সম্পদ ন্যায্য মূল্যে বাজারজাত করতে নির্দেশ প্রদান করবে। সরকারের নির্দেশ অগ্রাহ্য করলে সরকার শক্তি প্রয়োগ করে দেশের সকল হাট-বাজারে সুলভ মূল্যে তাদের গুদামজাত খাদ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করবে। এমনকি অভাবের কারণে জনগণ নগদ মূল্য পরিশোধ করতে অক্ষম হলে তাদের সচ্ছল হওয়া পর্যন্ত মেয়াদ ধার্য করে বাকীতে খাদ্য হস্তান্তর করবে। পরে তাদের হাতে খাদ্য শস্য আসলে সরকার তাদের নিকট থেকে তা উসূল করে দাতার নিকট পৌঁছি দিবে। “ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, রাদ্দুল মুহতার, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৭১”

প্রচলিত আইনে যা বলা হয়েছে: East Bengal Act-এর আওতায় অত্যাবশ্যকীয় কিছু পণ্যের সরবরাহ, বিতরণ এবং মজুদ নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৫৩ সালে The Essential Articles (Price Control and Anti-Hoarding) Act, ১৯৫৩ শিরোনামে এই আইনটি প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের অধীন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বলতে The Control of Essential Commodities Act, ১৯৫৬ এর ধারা ২ এ উল্লেখিত পণ্যসমূহকে বুঝানো হয়েছে। ধারা ৮ অনুযায়ী কোন ব্যবসায়ী সরকার কর্তৃক দেয় পূর্ব কর্তৃত্ব ছাড়া কোন ব্যক্তির কাছে কোন অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বিক্রি আটকে রাখতে পারবে না বা বিক্রি করতে অস্বীকার করতে পারবে না। “The Essential Artilcles (Price Control and Anti-Hoarding) Act, 1953.

The Essential Articles (Price Control and Anti-Hoarding) Act, ১৯৫৩ এর ধারা ৩ অনুযায়ী সরকার বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সময়ে সময়ে খুচরা, পাইকারি বা অন্য কোন ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রির ক্ষেত্রে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারবে। দেশের বিভিন্ন অ লে অবস্থাভেদে বিভিন্ন এলাকায় আলাদা আলাদা মূল্য নির্ধারণ করতে পারবে। জনগণের সুবিধার্থে সরকার ব্যবসায়ীদেরকে পণ্যের নির্ধারিত সর্বোচ্চ মূল্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদেশ প্রদান করতে পারবে। ব্যবসায়ীগণ সুবিধাজনক জায়গায় বা নিজেদের দোকান ও গুদামের সামনে পণ্যের সর্বোচ্চ মূল্য তালিকা প্রদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য থাকবে। নির্ধারিত সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রয়ের তারিখ ও মেয়াদও সরকার নির্ধারণ করে দিতে পারবে। “The Essential Articles (Price Control and Anti-Hoarding) Act, 1953” যদি কোন ব্যক্তি এই আইনের কোন বিধান লঙ্ঘন করে তবে সে The Hoarding and Black Market Act, ১৯৪৮ এর ৩নং ধারার অধীনে শাস্তি যোগ্য অপরাধী বিবেচিত হবে।

The Control of Essential Commodities Act, ১৯৫৬ অনুযায়ী সরকার বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের পণ্যকে প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে অতি জরুরী বলে ঘোষণা করতে পারে এবং অন্য যে কোন পণ্যের উৎপাদন, বিপণন, সংরক্ষণ, ব্যবহার এবং ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ আইনের আওতায় কিছু পণ্যের বিপণনের ক্ষেত্রে লাইসেন্স প্রদান এবং মূল্য নির্ধারণ করে নির্দিষ্ট মূল্যে বিক্রির বিধান নিশ্চিত করা হয়েছে। “The Control of Essential Commodities Act, 1956-এর ৩নং ধারা” ধারা ৬ অনুযায়ী উক্ত আইন ভঙ্গকারীর জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছর কারাদণ্ড অথবা এক হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে।

মজুদদারির মেয়াদ: কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বেশি মুনাফা অর্জন করা বা দুর্ভিক্ষের অপেক্ষায় থেকে পণ্য চড়া মূল্যে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে পণ্য সামগ্রী মজুদ রাখা একেবারেই নিষিদ্ধ। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় অল্প দিনের জন্য মজুদ করা হলে তাতে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না। আর যদি বেশি দিন মজুদ করে রাখা হয় তাহলে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। কোন কোন আলিমের মতে, সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে চল্লিশ দিন। কেননা রসূলুল্লাহ স. বলেছেন, “যে ব্যক্তি চল্লিশ রাত্র খাদ্যশস্য মজুদ করে রাখল, সে আল্লাহ থেকে সম্পর্কহীন হয়ে গেল এবং আল্লাহও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন”। “ইমাম আহমদ, আল-মুসনাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৩৭” আবার কেউ বলেছেন, এক মাস। কেননা এক মাসের নিচে হলে তা কম হিসেবে ধরা হয়। আর এক মাসের বেশি হলে তা সর্বোচ্চ হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু চল্লিশ দিনের অধিক রাখলে দুনিয়াতে তাকে শাস্তি দিতে হবে। মোটকথা শরীয়তের দৃষ্টিতে খাদ্য সামগ্রী ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আটক রাখা সমীচীন নয়। “বুরহানুদ্দীন আল-মারগিনানী, আল-হিদায়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৫”

১. নিজের জমির উৎপাদিত ফসল মজুদ করে রাখা যাবে। “ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, রাদ্দুল মুহতার, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৭২” অনুরূপভাবে পরিবারের বাৎসরিক ব্যয়ভার বহনের প্রয়োজনীয় পরিমাণ পণ্য মজুদ রাখা যাবে। কেননা উমর রা. বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ স. বনী নযীরের খেজুর গাছ বিক্রি করে দিয়েছিলেন এবং তাদের এক বছরের খাদ্য সামগ্রী তার পরিবারের জন্য মজুদ করে রেখে দিয়েছিলেন”। “ইমাম বুখারী, সহীহ আল-বুখারী, অধ্যায়: আন-নাফাকাত, অনুচ্ছেদ: হাবসুর রাজুলি কুতা সানাতিন আলা আহলিহি ওয়া কায়ফা নাফাকাতুল ইয়াল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬২”

২. মানুষ ও চতুষ্পদ জন্তুর খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়া অন্য জিনিসপত্র যা মৌলিক প্রয়োজনে পড়ে না, তা মজুদ করা যাবে।

৩. নিজ শহর থেকে নয় বরং দূরবর্তী শহর- যেখান থেকে সাধারণত সংশ্লিষ্ট এলাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আসে না, সেখান থেকে আমদানি করে মজুদ করে রাখা যাবে।“মুফতি মাওলানা মানসূরুল হক, ফাতাওয়ায়ে রাহমানিয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৭”

৪. ভবিষ্যতের সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ এড়াতে অথবা অতিরিক্ত মৌসুমি উৎপাদন অন্য মৌসুমে সহজলভ্য করার উদ্দেশ্যে সরকার প্রয়োজনীয় পরিমাণ পণ্য সামগ্রী মজুদ করতে পারবে।
তবে যে কোন অবস্থায় যদি মানুষ বা পশুর প্রয়োজনে মজুদকৃত পণ্য বিক্রির প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে পণ্য সামগ্রী আটকে না রেখে প্রয়োজন ও মানবিক দিক বিবেচনা করে সুলভ মূল্যে বিক্রি করে দেয়া কর্তব্য।

ইসলামী আইনে বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ: বাজার ও দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক গতিতে চলুক এটাই ইসলামের দাবি। স্বাভাবিক অবস্থায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা বা মূল্য নির্ধারণ করার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অধিকার সরকারের নেই এবং প্রয়োজনও নেই। বাজারে পণ্য সামগ্রীর আমদানি ও তার চাহিদার আলোকে দ্রব্যমূল্যের উত্থান-পতন হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে সরকার দ্রব্যমূল্যে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। “ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, রাদ্দুল মুহতার, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৭৩; বুরহানুদ্দীন আল-মারগিনানী, আল-হিদায়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৫” ক্রেতা ও বিক্রেতার পারস্পরিক চাহিদার ভিত্তিতেই পণ্য দ্রব্যের মূল্য নির্ধারিত হবে।

রসূলুল্লাহ স. দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ থেকে বিরত থেকেছেন। তাঁর আমলে একবার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে লোকেরা এসে বলল, “হে আল্লাহর রসূল! আমাদের জন্য দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিন। তখন নবী স. বললেন, “প্রকৃতপক্ষে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণকারী হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ। তিনিই মূল্য বৃদ্ধি করেন। তিনিই সস্তা করেন। রিযিকদাতা তিনিই। আমি তো আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করতে চাই এ অবস্থায় যে, কোন রূপ জুলুম, রক্তপাত বা ধন-মালের অপহরণ ইত্যাদির দিক দিয়ে আমার কাছে দাবিদার কেউ থাকবে না”। “ইমাম তিরমিযী, জামে আত-তিরামিযী, অধ্যায়: আল-বুয়ু, অনুচ্ছেদ: মা জাআ ফিত তাসয়ীর, আল-কুতুবুস সিত্তাহ, রিয়াদ: দারুল সালাম, ২০০০, পৃ. ১৭৮৩-৮৪”। সাহাবাদের দাবির প্রেক্ষিতে রসূলুল্লাহ স. দ্রব্যমূল্য নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করেননি। কেননা দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের অধিকারী হচ্ছে ক্রেতা ও বিক্রেতা। দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করতে গেলে তাদের অধিকারে হস্তক্ষেপ হবে, যা কোন মতেই সমীচীন নয়। বরং তা আরও জুলুমের শামিল।

তবে ব্যবসায়ীরা যদি স্বেচ্ছাচারী হয়ে মাত্রাতিরিক্ত চড়া মূল্যে পণ্য বিক্রি করে ভোক্তা সাধারণের দুঃখ-দুর্দশা ও দুর্ভোগ সৃষ্টি করে তাহলে জনগণকে মূল্য বৃদ্ধির শোষণ থেকে মুক্ত করতে এবং তাদের ন্যায্য অধিকার সংরক্ষণ করতে সরকার বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শক্রমে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিবে এবং ব্যবসায়ীদেরকে তা মানতে বাধ্য করবে।“ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, রদ্দুল মুহতার, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৭৩; বুরহানুদ্দীন আল-মারগিনানী, আল-হিদায়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৬”

আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী বলেন, ‘গণঅসন্তোষ সত্ত্বেও অন্যায়ভাবে যদি কোন হালাল বস্তুর উচ্চ মূল্য চাপিয়ে দেয়া হয়, তবে তাও হবে হারাম। পক্ষান্তরে লোকদের মধ্যে সুবিচার ও ইনসাফ কার্যকর করার উদ্দেশ্যে যদি মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হয় এবং প্রচলিত দামে (Standard Price) বিক্রয় করতে ব্যবসায়ীদেরকে বাধ্য করা হয় কিংবা প্রচলিত বিনিময় মূল্যের অধিক গ্রহণ থেকে তাদের বিরত রাখা হয় তাহলে তা শুধু জায়েজই নয়, ওয়াজিবও।” “আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী, অনু: মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, ইসলামে হালাল হারামের বিধান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫৩-৫৪”

বাংলাদেশে মজুদদারি ও মূল্যবৃদ্ধির চিত্র: নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী সহজলভ্য ও ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা সরকারের দায়িত্ব এবং ভোক্তা শ্রেণীর অধিকার। কিন্তু আমাদের দেশের বাজার ব্যবস্থাপনা মজুদদার লুটেরাদের হাতে কুক্ষিগত। অতি মুনাফাখোর অসাধু একদল ব্যবসায়ীর যাঁতাকলে আজ সাধারণ মানুষ নিষ্পেষিত। অসাধু ব্যবসায়ী শ্রেণি সিন্ডিকেট করে পণ্য গুদামজাত করে রাখে এবং কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে পণ্যের মূল্য নিজেদের ইচ্ছাকৃত নির্ধারণ করে। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ও বাজার তদারকির জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের ভূমিকা ভোক্তা সাধারণ যথেষ্ট মনে করেন না। কখনো অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ী শ্রেণির সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশ থাকার কথাও গণমাধ্যমে প্রকাশ হতে দেখা যায়। কর্তৃপক্ষের এই দুর্বলতার সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে দফায় দফায় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে। ফলে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। আর ক্রেতা সাধারণ আকাশ ছোঁয়া দ্রব্যমূল্যের কারণে হয়ে পড়ে দিশেহারা। বিশেষত রমযান ও ধর্মীয় উৎসবগুলোতে বাজার ব্যবস্থাপনায় শোচনীয় অবস্থা বিরাজ করে। তখন কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ী নিত্য প্রয়োজনীয় সকল পণ্য মজুদ করে রাখে। এতে অস্বাভাবিকভাবে পণ্যের মূল্য হু হু করে বাড়তে থাকে। ভোক্তা শ্রেণি প্রয়োজনের তাগিতে চড়া মূল্যে পণ্য সামগ্রী ক্রয় করতে বাধ্য হয়। ফলে এ সুযোগে অতি মুনাফাখোর একদল অসাধু ব্যবসায়ী সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। আর সাধারণ মানুষ চড়া মূল্যে পণ্য ক্রয় করে নিঃস্ব থেকে আরও নিঃস্ব হয়। এ সমস্যা নিয়ে প্রিন্ট মিডিয়ায় অনেক লেখালেখি হয় এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বহু সচিত্র প্রতিবেদন ও প্রচার হয়। বিভিন্ন সময়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা হয়। সেমিনারে এ সমস্যা নিরসনে বিস্তারিত আলোচনা করা হয় এবং সুপারিশমালা গ্রহণ করা হয়। তখন সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মজুদদারি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণের নানা কথা বলে থাকেন এবং ব্যবসায়ীরা বহু প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। কিন্তু বাস্তবে এ সমস্যার প্রতিকার সামান্যই পরিলক্ষিত হয়।

মজুদদারির ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যে অস্থিতিশীল ও অরাজকতাপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়, তা অর্থব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়। আর সামাজিক কর্মকাণ্ডে যে নৈরাজ্যকর ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তা সমাজ ব্যবস্থাকে পর্যুদস্ত করে ফেলে। ইসলাম এ ক্ষেত্রে শাশ্বত ও যুগোপযোগী বিধান দিয়েছে। মজুদদারিকে নিষিদ্ধ করেছে এবং এ অবস্থা নিরসনে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ ছাড়াও এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আরও কিছু পদক্ষেপ রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন: সরকার মজুদদারির কুপ্রভাব সর্বসাধারণের সামলে তুলে ধরবে। এ ক্ষেত্রে ইসলামী বিধি-নিষেধগুলো প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। মজুদদারদেরকে শরয়ী নির্দেশনা পালনে পদক্ষেপ নিবে এবং ভোক্তাদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট থাকবে। দেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলে সরকার মজুদদারদেরকে নীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে মজুদকৃত পণ্য সুলভ মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য করবে। মুজদদার শ্রেণি যদি তা অস্বীকার করে, তাহলে জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে এবং তাদের স্বার্থ ন্যায়সঙ্গতভাবে রক্ষার উদ্দেশ্যে সরকার মজুদকৃত পণ্য সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করে তা ন্যায্য মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সরকার নিত্য প্রয়োজনীয় সে সকল পণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে যা মজুদদারির কারণে দুষ্প্রাপ্য এবং দেশের অভ্যন্তরে সব পণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালাবে। সরকার অন্যান্য দেশের সাথে পণ্য বিনিময় করবে বা তাদেরকে ব্যবসায়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করবে। বিশেষত দুষ্প্রাপ্য পণ্য সামগ্রী বাণিজ্যিকীকরণে তাদের উৎসাহিত করবে এবং পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা প্রদান করবে। যদি মুজদদারির কারণে পণ্য সামগ্রীর মূল্য বেড়ে যায় এবং বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে, তাহলে সরকার ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শক্রমে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিবে। আর মজুদদার শ্রেণিকে পণ্য ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য করবে। কিন্তু বাজার যখন স্থিতিশীল হয়ে যাবে তখন ক্রেতা-বিক্রেতাকে স্বাধীনতা দেয়া হবে, যাতে তাদের চাহিদার আলোকে পণ্য মূল্য নির্ধারিত হয়।

সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠন করবে। মনিটরিং সেলের অধীনে নিজস্ব জনবল দিয়ে প্রতিনিয়ত বাজার পরিদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যদি পরিদর্শকদলের নিকট কোন অনিয়ম পরিলক্ষিত হয় তাহলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

খাদ্য নিজস্ব উদ্যোগে আমদানির জন্য সরকার একটি বোর্ড গঠন করতে পারে। এ বোর্ডের মাধ্যমে পণ্য আমদানি করবে বা যারা পণ্য আমদানি করবে এ বোর্ড তাদের মনিটরিং করবে। এতে আমদানীকারকরা বেশি মূল্যে পণ্য বিক্রির সুযোগ নিতে পারবে না।

এ সকল পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নৈরাজ্যকর ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে একটি সুন্দর পরিবেশ বিরাজ করবে এবং ক্রেতা-বিক্রেতার অধিকার সুনিশ্চিত হবে।

উপসংহার: ইসলাম মানব জাতির কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলাম যুগোপযোগী বিধান দিয়েছে। ব্যবসায়-বাণিজ্যের মত অতীব গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডেও কল্যাণকর নীতি-আদর্শ উপহার দিয়েছে। এ নীতির অন্যতম দিক হলো- মজুদদারি, মুনাফাখোরী, কালোবাজারি ও যে কোন প্রতারণামূলক ব্যবসায়-বাণিজ্যের নিষিদ্ধকরণ। ইসলাম অতি মুনাফার লোভে প্রতারণা করে ও অপকৌশল অবলম্বন করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী আটক রাখাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। আধুনিক কালেও যেখানে পৃথিবীর নানা স্থানে মজুদদারির প্রভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনসাধারণ বিপর্যস্ত, সেখানে ইসলাম বহুকাল পূর্বেই এর আইনগত বিধান বর্ণনা করে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের অধিকার নিশ্চিত করেছে। পরিশেষে আমরা বলতে পারি, ইসলাম নির্দেশিত পন্থায় যদি ব্যবস্থায়-বাণিজ্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা হয় তাহলে শুধু মজুদদারির অপতৎপরতাই নয় ব্যবসায়-বাণিজ্যে কোন ধরণের নৈরাজ্য থাকবে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত