কিরন শেখর কুন্ডু

১৫ ফেব্রুয়ারি , ২০২৪ ২২:৪৩

কী হচ্ছে মিয়ানমারে?

যেকোনো রাষ্ট্রের ইতিহাসের দিকে তাকালে যেমন ভাঙাগড়ার খেলা দেখা যায়, মিয়ানমারও তার ব্যতিক্রম না। বরং ভৌগলিক অবস্থান এবং জাতিগত বৈচিত্র্যময়তার কারণে এর বিষয়টি আরও জটিল। এর এক অংশ দক্ষিণ এশিয়ার সাথে, অপর অংশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে যুক্ত। একদিকে যেমন বাংলাদেশ, ভারত আবার এই দেশের সাথে সীমানা রয়েছে থাইল্যান্ড ও লাওসের!

সংক্ষিপ্তভাবে রাজনৈতিক ইতিহাস বলতে গেলে মিয়ানমার তৎকালীন বার্মা ব্রিটিশদের কাছ থেকে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। ব্রিটিশদের নিকট থেকে স্বাধীনতা লাভকারী বাকি দেশগুলোর মতোই জন্ম থেকেই ভৌগলিক ত্রুটিপূর্ণ বিভাজন ব্যবস্থা নিয়ে শুরু হয়। মিয়ানমার রাষ্ট্রের জন্মের পূর্বেই, মিয়ানমার রাষ্ট্রের জনক বলে পরিচিত জেনারেল অং সান হত্যার শিকার হন। আরেকটি চমকপ্রদ ব্যাপার মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জন্ম হয় এই রাষ্ট্রের জন্মের পূর্বে!

মিয়ানমারের প্রায় ১১০ রকম বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী আছে তার মাঝে প্রধান ৮টি সম্প্রদায়। যেমন বামার, শান, কারেন, রাখাইন, চাইনিজ, ভারতীয় ইত্যাদি। পাহাড়-পর্বত ঘেরা সমুদ্র সীমাবেষ্টিত এর সমতল ভূমির পরিমাণ কম। এটি ৭টি রাজ্য এবং ৭ অঞ্চল মিলিয়ে ১৪ ভৌগলিক ভাগে বিভক্ত।

কাগজে কলমে এটি গণতান্ত্রিক দেশ হলেও জন্মের পর থেকে বেশিরভাগ সময় কেটেছে সরাসরি সেনাবাহিনী কিংবা সেনাবাহিনী পরিচালিত পুতুল সরকার দিয়ে। অস্থিতিশীল শাসন ব্যবস্থার কারণে মিয়ানমারের রাজনীতিতে দুইটা সমস্যা অন্তত ভীষণভাবে প্রকট। প্রথমত, সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দল তাদের সাথে আন্দোলনে যুক্ত আছে দেশের বেসামরিক জনগণ। দ্বিতীয়ত, ত্রুটিযুক্ত বিভাজনের কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীনতা কিংবা স্বতন্ত্র শাসন ব্যবস্থা দাবিতে যুদ্ধরত অস্ত্রধারী গোষ্ঠী।

আর বর্তমানে মিয়ানমার আলোচিত এই স্বাধীনতাকামী অস্ত্রধারী গোষ্ঠীর কারণে। প্রায় ২০টির মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী দল থাকলেও ময়দানে ভূমিকা আছে ৮টির। এই দলগুলোর মাঝে কয়েকটির সাথে আবার মিয়ানমার সরকারের সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি বিদ্যমান।

পূর্বে রাজনৈতিক দলগুলো আলাদাভাবে কাজ করলেও মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী নেত্রী অং সান সুকির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির (NLD) আহবানে সাড়া দিয়ে আন্দোলনরত। এনএলডি বার বার ভোটে জয়লাভ করলেও জান্তা সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। তাই এনএলডি বাকি রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে মিয়ানমার জান্তা সরকারের বিপরীতে 'ন্যাশনাল ইউনিটি গভারমেন্ট অব মিয়ানমার' নামে বিকল্প সরকার ব্যবস্থার ঘোষণা করেছে।

তবে হঠাৎ করেই কারণ মিয়ানমারের আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে বিশেষজ্ঞরা এমন মনে করেন না। বলে রাখা ভালো, মিয়ানমারের জান্তা সরকার এতো দীর্ঘসময় শাসন করার পেছনে ছিল চিনের একছত্র সমর্থন। অনেকে মনে করেন জান্তা সরকারের উপর থেকে চিনের সমর্থন কমতে শুরু করেছে। এর কারণ হতে পারে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দলগুলো শক্ত অবস্থান। আবার মিয়ানমার সরকার তার শান স্টেটে গড়ে তুলেছে পৃথিবীর সবচাইতে বড় 'স্ক্যাম জোন'। এখানে জোর করে নাকি চিনা নাগরিকদের জোর ধরে এনে স্ক্যামিং কাজে বাধ্য করা হচ্ছে! এছাড়া বঙ্গোপসাগরে রাখাইন রাজ্যে ভারতকে সমুদ্রবন্দর বানানোর অনুমতি দেওয়াসহ নানা কারণে জান্তা সরকারের সাথে চিনের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।

পূর্বে স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীগুলো আলাদাভাবে বিদ্রোহ চালিয়ে গেলেও এবার ৩টি দল এক হয়ে থ্রি- ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে জোট গঠন করেছে এবং সমসাময়িক সময়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটির উপর আঘাত হেনেছে, এমনকি চিন সীমান্তবর্তী শান স্টেটের কিছু অংশ এখন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের শাসনে চলছে।

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য, আর এখান বিচ্ছিন্নতাবাদী 'আরাকান আর্মি' থ্রি ব্রাদারহুড জোটে অন্যতম সদস্য। ভারত এবং চিন দুই দেশেরই নির্মিয়মান সমুদ্রবন্দর এখানে অবস্থিত। আমরা বাংলাদেশ থেকে নিয়মিত যে গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে তা 'আরাকান আর্মির' সাথে সে দেশের পুলিশ এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গোলযোগের কারণে।

একদিকে দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক দলগুলোর বেসামরিক জনগণের প্রতিরোধ আবার সীমান্ত এলাকায় স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীর বিপক্ষে যুদ্ধ সবমিলিয়ে টালমাটাল জান্তা সরকারের অবস্থা। এমনকি জান্তা প্রধান আশংকা করে বলেছে এভাবে চললে মিয়ানমার একসময় ভেঙে একাধিক রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে যেতে পারে।

রোহিঙ্গাদের কথা না বললে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে; রোহিঙ্গারা আরাকান রাজ্যের বাসিন্দা এদের একটা অংশ 'আরসা' নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত আছে। জান্তা সরকারের তুলনায় আরকান আর্মি এদের প্রতি কিছুটা নমনীয় বলে জানা গেছে।

যদিও মিয়ানমারের সামরিক সরকার যথেষ্ট বেকায়দায় আছে, কিন্তু তাদের পতন দ্রুতই হবে না বলে অনুমেয়। যুদ্ধের মাধ্যমে যদি ফয়সালা হয় তাহলে সীমান্ত পার হয়ে রোহিঙ্গা এবং অন্যান্য সামরিক ও সরকারি চাকুরের আশ্রয় প্রার্থিতার আবেদন বাড়তে থাকবে।

  • কিরন শেখর কুন্ডু: ব্যাংকার, সংগঠক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত