ইয়াহইয়া ফজল

২৫ জানুয়ারি, ২০১৬ ০১:৪৪

ভালো থাকুন মান্না ভাই

মানুষকে তার প্রাপ্য স্বীকৃতিটুকু দিতে আমরা বরাবরই কার্পণ্য করি। একজন মানুষ চলে গেলে তখন আমরা তাকে নিয়ে ব্যস্ত হই, আবেগাপ্লুত হই, প্রশংসায় ভাসাই। কিন্তু যিনি ইহলোক ত্যাগ করলেন তাঁর কাছে এর তখন এসবের কি মূল্য। কবি নজরুল ইসলাম তো সে সত্যটাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন।

‘যেদিন আমি চলে যাব সেদিন হয়তোবা বড় বড় সভা হবে, কত প্রশংসা, কত কবিতা বেরুবে হয়ত আমার নামে, দেশপ্রেমিক-ত্যাগী-বীর-বিদ্রোহী বিশেষণের পর বিশেষণ, টেবিল ভেঙ্গে ফেলবে থাপ্পড় মেরে, বক্তার পর বক্তা। এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে-বন্ধু তুমি যেন যেওনা। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ করো, তোমার ঘরের আঙ্গিনায় বা আশেপাশে যদি একটি ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও সেইটিকে বুকে চেপে বলো, বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি।’

সেই কথার সূত্র ধরলে বলা কঠিন ‘এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদন’ নাকি ‘চুপটি করে বসে অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ’ করছি আমি এই লিখাটির মাধ্যমে। কিন্তু তবুও মনে হচ্ছে এতটুকু লেখা, এতটুকু বলা অন্তত জরুরী। একজন মানুষকে বাইরে থেকে সবাই দেখে। কিন্তু তার অন্তর্নিহিত গুণাবলী কয়জন দেখতে পায়?

হ্যাঁ, আমি মান্না ভাইয়ের কথা বলছি। আখতারুজ্জামান মান্না। এই নামটি সিলেটের একজন সক্রিয় ক্রীড়া সংগঠকের, একজন প্রাক্তন হকি খেলোয়াড়ের। ক্রীড়া বিষয়ক সংবাদ লিখতে গিয়ে আমি অসংখ্যবার এই নামটি লিখেছি। তার প্রতিক্রিয়া ছেপেছি। এমনও হয়েছে অনেক সংবাদের বেলা কেউ মন্তব্য করতে চাচ্ছেন না নিজ নামে। মান্না ভাইকে ধরেছি। তিনি মন্তব্য করেছেন। বলেছেন, সত্য বলছি নাম বলতে সমস্যা কোথায়। আজ যখন তাঁর নামটি লিখছি তখন তিনি আর আমাদের মাঝে নেই।

মান্না ভাইয়ের সাথে পেশাগত সূত্র ধরেই আমার প্রথম পরিচয়। আমি তখন অধুনালুপ্ত ‘সিলেট প্রতিদিন’ পত্রিকার ক্রীড়া বিভাগে কাজ করি। আমার অগ্রজ ও বর্তমান প্রেসক্লাব সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রশিদ রেনু ভাই তখন বিভাগটির সম্পাদক। রেনু ভাই আমাকে মান্না ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, তুমি চোখ বন্ধ করে মান্না ভাইয়ের উপর নির্ভর করতে পারো।

এরপর দীর্ঘ সময় পেরিয়েছে। আমি সিলেট প্রতিদিনের পর দৈনিক উত্তরপূর্বে। তারপর সেখান থেকে চলে এলাম দৈনিক কালের কণ্ঠে। আঙ্গুলের হিসেবে তাও দশ বছর মানে এক দশক! এই সময়ে আমি অসংখ্যবার মান্না ভাইয়ের সাথে নিউজ সংক্রান্ত কাজে যোগাযোগ হয়েছে। কখনও ফোন দিয়েছি নিজের প্রয়োজনে কখনও তিনি দিয়েছেন। সিলেট ক্রীড়া সংস্থা কিংবা সিলেটের ক্রীড়াঙ্গণের অসঙ্গতি নিয়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে যতবারই যোগাযোগ করেছি দেখেছি তিনি আগে থেকেই অবগত। নিউজ সংক্রান্ত বিষয়ে সময়ে অসময়ে ফোন দিয়ে জ্বালাতন করেছি। কোন কিছুর জন্য আটকে গেলে সবার আগে ফোন দিয়েছি মান্না ভাইকে। বলেছি আমার এই তথ্যটা লাগে, ওই ডকুমেন্টটা লাগবে। যত ব্যস্ত থাকুন না কেন, ‘দেখি ফজল কোন ব্যবস্থা করতাম পারি কিনা।’ মান্না ভাই ঠিকই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

ক্রীড়াপ্রেমী এই মানুষটি আসলে সবসময় সিলেটের ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে ভাবতেন। কখনও কখনও নিজেই ফোন করে বলতেন, দেখো হকি লিগ হচ্ছে না দীর্ঘদিন। নতুন ছেলেরা বেরিয়ে আসবে কিভাবে। এরাতো সুযোগই পাচ্ছে না নিজেদের প্রমাণের। কিছু একটা করো। কিংবা কোন অসংগতি দেখলেই তথ্য দিয়ে বলতেন, দেখো এই বিষয়ে কিছু করা যায় কিনা।’ এমন উৎকণ্ঠা নিয়ে তাঁর ফোন আমি জীবনে অসংখ্যবার পেয়েছি। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি সিলেটে যারা স্পোর্টস সাংবাদিকতা করেন তারা সবার আমার মতো স্মৃতি আছে মান্না ভাইয়ের সাথে। ক্রীড়াঙ্গণের প্রতি এমন দায়বোধ আজকের দিনে তেমন একটা চোখে পড়ে না।

পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মান্না ভাইয়ের সবচেয়ে বড় যে গুণ আমার চোখে পড়েছে তা হলো, তাঁর সততা। এমনও হয়েছে, নিউজ করতে গিয়ে অনেক জটিলতার মধ্যে পড়েছি কোনটা সঠিক নির্ধারণ করতে পারছি না। তাকে বলেছি, তিনি অকপটে সঠিকটা বলে গেছেন। এই সত্য বলার কারণে অনেক সময় তাকে ভোক্তভোগী হতে হয়েছে। কিন্তু কখনও তিনি ভুল তথ্য দিয়ে মিস গাইড করেননি। অনেক ক্ষেত্রে অনেক সংবাদ তার বিপরীতে গেছে। কিন্তু তাকে কোনদিন ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখিনি। দেখা হলে নিজেই আগ বাড়িয়ে বলতেন, তোমার রিপোর্ট পড়েছি, ভালো হয়েছে। হয়তো তখন আমি অপ্রস্তুত হয়ে বলতাম, মান্না ভাই লিখতে গিয়ে তো আপনারও অ্যাগিনেস্টে চলে গেলো। তিনি তখন পিঠে হাত দিয়ে বলতেন, তো কি হয়েছে। তুমি তো সত্যটাই লিখেছ। এই সময়ে এরকম ক্রীড়া সংগঠক নেই বললেই চলে। যারা আছেন তাদের বেশিরভাগই সত্য গ্রহণ করতে পারেন না। তারা পক্ষে গেলে বাহবা দেন, পক্ষে না গেলে ক্ষুব্ধ হন।

সুদর্শন ও নিপাট ভদ্রলোক মান্না ভাইয়ের মুখে সারাক্ষণই হাসি লেগে থাকতো। তার মতো এরকম আরেকজন মান্না ভাই কবে আসবেন কে জানে। এতক্ষণ তো পেশাগত সম্পর্কের কথা বলে গেলাম। এবার ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়ে দুটি কথা বলতেই হয়। দরগা গেইটে মান্না ভাইয়ের ‘জালালাবাদ রেস্টুরেন্ট’ নামে একটা রেস্তুরা আছে। অবসর সময়ে তিনি সেখানেই বসতেন। এদিক দিয়ে গেলে গাড়ির আড়ালে আড়ালে চলে আসতে হতো। কারণ মান্না ভাইয়ের চোখে পড়লে আর রক্ষা নেই, তিনি না খাইয়ে ছাড়বেন না।

মান্না ভাই চলে গেলেন বড্ড অসময়ে। মান্না ভাই, আপনি তো চলে গেলেন। সিলেটের ক্রীড়াঙ্গণ যখন আপাদমস্তক ক্রীড়া সংগঠকদের অভাবে ধুকছে তখন আপনার চলে যাওয়া ক্রীড়াঙ্গণের জন্য বড় দুঃসংবাদ। আর আমার জন্য দুসংবাদ হলো, এখন সংবাদ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে আমাকে আরো সতর্ক হতে হবে। প্রাপ্ত তথ্য ক্রস চেক করে নিতে হবে। কষ্ট বেড়ে গেলো। মান্না ভাই, যতদিন ক্রীড়া সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত থাকবো প্রতিনিয়ত আপনার অভাববোধ করবো। আমার না হয় কষ্ট হলো তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু আপনি যেখানে থাকুন, যে অবস্থায় থাকুন, ভালো থাকুন।

ইয়াহইয়া ফজল : সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য

আলোচিত