সীমান্ত দেব তূর্য

০৭ ফেব্রুয়ারি , ২০১৬ ২২:০৩

র‌্যাগিং একটি ভাইরাসের নাম

"র‍্যাগিং" বিষয়টা একটা "ফান"। যারা র‍্যাগিংকে ফান বলে সম্বোধন করেন, তারা হয়ত র‍্যাগিং জিনিসটা বুঝেন না, না হয় তারা নিতান্তই মূর্খ। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যে "র‍্যাগিং" চলে তাকে কোনোভাবেই "মজা" করার কাতারে ফেলা যায় না।

হাফিজুর মোল্লা নামটি এখন অনেকেরই কাছে পরিচিত। কারণ এখন সে সব পত্রিকার শীর্ষ সংবাদ। না বলতে একটু ভুল হয়েছে। "হাফিজুরের করুণ মৃত্যু" এটি এখন সকল পত্রিকার শীর্ষ সংবাদ।

ছেলেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর মার্কেটিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল। দরিদ্র পরিবার থেকে উঠা আসা হাফিজুরের বাবা ছিলেন একজন অটোরিকশা চালক। দারিদ্র্যতার কষাঘাতে বেঁচে থাকা এই পরিবারের একমাত্র সম্পদ ছিল হাফিজুর। এই মৃত্যুতে আজ তার মা পাগলপ্রায়। চারদিন ধরে ঘরের চুলায় নেই আগুন। ছেলেটির মারা যাওয়া কোনও স্বাভাবিক ঘটনা নয়। প্রচলিত কোনও দুর্ঘটনায়ও নয়। ভার্সিটির কিছু ক্ষমতাধর ভাইদের উগ্রতার জন্য শিকার হয়ে  হাফিজুর আর নেই।

হাফিজুরের সহপাঠী ও পরিবারের অভিযোগ, শীতের মধ্যে বারান্দায় থাকা এবং রাতের বেলায় ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যাওয়ার কারণে হাফিজ ঠাণ্ডায় আক্রান্ত হন। অসুস্থ অবস্থায় তীব্র শীতের মধ্যেও হাফিজকে গত ২৬ জানুয়ারি রাতে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা বাইরে থাকতে হয়।

ভার্সিটিতে তো পড়ো। টিকে থাকার পূর্বশর্ত কোনো না কোনও রাজনৈতিক দলের সাথে তোমাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হতেই হবে। আর না হলে প্রতি রাতে তোমার পায়ু পথে বাঁশ খেতেই হবে! আর রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হলেই যে বেঁচে যাবা এমনটাও নয়। যদি যুক্ত হয় তাহলে ভাইদের কথা মতই চলতে হবে।  হাফিজুরও সেই পথেই গিয়েছিল। এর ভালো পুরষ্কারও পেয়েছে সে।

এই যে পত্রিকাগুলো কত ইনিয়ে বিনিয়ে বলছে, যে তাকে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যেতে হত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডিউটি দিতে হত। কেন বলছে? কারণ তাদের এ ছাড়া আর কিছু ছাপার নেই। নিজের মন গড়া কথা তো আর লিখতে পারে না বা লোকে বলে নাই এমন কিছুও ছাপতে পারে না।

হাফিজুরের বাবা দৈনিক প্রথম আলোতে নিম্নোক্ত কথাগুলো বলেন-

"গত সপ্তাহের বুধবার হাফিজ ঢাকা থেকে বাড়ি এসেছিল। প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে এসেছিল। কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, “আমি আর বাঁচব না।” জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী হয়েছে। ও জানায়, শীতের মধ্যে বাইরে ‘‘ডিউটি’’ করতে হয়। ওই দিন নাকি সে ওদের বলেছে, তার শরীরটা ভালো না। ডিউটিতে যেতে পারবে না। কিন্তু তার পরও মাঠে নিয়ে গিয়ে রাত সাড়ে নয়টা থেকে একটা পর্যন্ত দাঁড় করিয়ে রেখেছে।’"

হাফিজুরকে রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে যেতে হত কেন? না গেলে হয়ত মেয়েদের পিছনে হাত মারার হুকুম চলে আসত বড় ভাইদের কাছ থেকে। র‍্যাগিং-র‍্যাগিং!

হাফিজুর আর কিছুর জন্য নয়, শুধুমাত্র র‍্যাগিং এর জন্য মরেছে, র‍্যাগিং এর ভয়ে মরেছে। হয়ত তাকে ডিউটি না দিলে ভয়াবহ র‍্যাগের শিকার হুওয়া লাগত। এই ভয়েই হয়ত সে অসুস্থ শরীরেও রাত একটা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে দ্বিধা বোধ করে নি।

শুনেন ভাই, আপনারা যারা র‍্যাগ দেন তাদের উদ্দেশ্যে বলি, র‍্যাগ দেয়ার জন্যই আপনারা মা'র পেট থেকে বের হন নাই। এইটা আপনার ভুল ধারণা যে, আপনারা একজনকে র‍্যাগ দিবেন আর সে আপনাদের সম্মান করবে।  আপনারা র‍্যাগিং এর সংজ্ঞাটাই পালটে দিয়েছেন।  কাউকে দিয়ে গান গাওয়ানো, আর অভিনয় করানো বা মোট কথাই শ্লীলতার মধ্যে অনেক কিছুই করা যায়। কিন্তু না আপনাদের অশ্লীল হতে হবে- কে কয়টা বাজে গালি দিতে পারে তা আপনাদের দেখতে হবে, কার প্যান্টের নিচে কয়টা তিল আছে ওইটা আপনাদের দেখতে হবে। একটা ছেলের সাহস আছে কি না তা আপনারা একটু অন্য উপায়েই বুঝে থাকেন, কোনও অচেনা মেয়েকে সকলের সামনে বিব্রতিকর  পরিস্থিতিতে ফেলে প্রপোজ করতে পারলে তার সাহস আছে। আর সাহসের পরীক্ষা না দিলে পারলে চপ-থাপ্পড় তো আছেই। মেয়েদের অবস্থা তো আরও খারাপ। যে মেয়েটা কারো সামনে কথা বলতে লজ্জা পেত, সে মেয়েটাকে আপনারা সবার সামনে নাচতে বলেন! তো ঐসময় তার মানসিক নিপিড়নবোধ ছাড়া আর কি-ই বা হয়ে পারে? তাছাড়া শীতের দিনে জুনিয়রদের দিয়ে সিনিয়রদের কাপড় ধোয়ানো, শীতের দিনে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা, এসব তো রয়েই গেছে।

আর আজকাল র‍্যাগিং ভাইরাস এর মতো কাজ করছে। ভাইরাস যেমন নিজে থেকে অনুলেপনের  মাধ্যমে অনেক ভাইরাস বানায়, তেমনি র‍্যাগিং ও সিনিয়র ব্যাচ থেকে জুনিয়র ব্যাচে সংক্রমিত হচ্ছে। "র‍্যাগিং" প্যারাসাইটের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। র‍্যাগিং ভয়ানক প্যারাসাইটের মতো মহামারিতে রূপান্তরিত হওয়ার আগে ব্যবস্থা নিন। সবকিছু যে প্রতিকারের মধ্যে সমাধান করতে হবে এমন তো কথা নেই, প্রতিরোধ করুন। "Prevention is better than cure". আর আমার মত কয়েকজন নোবডি সারাজীবন চিৎকার চেঁচামেচি করলেও র‍্যাগিং বন্ধ হবে না। র‍্যাগিং বন্ধে আইন হোক, তা বাস্তবায়িত হোক।

র‍্যাগিং বন্ধ হোক, ভার্সিটি "র‍্যাগিং" নামক ভাইরাস মুক্ত হোক!!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত, মন্তব্য লেখকের নিজস্ব। সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত, মন্তব্য সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

আপনার মন্তব্য

আলোচিত