ফারুক আহমদ

০৯ ফেব্রুয়ারি , ২০১৬ ০০:২৭

‘লাঙ্গল টু লন্ডন’ এবং কয়েকজন সিলেটপ্রেমীর ইতিহাস চর্চা- ২

বরীন্দ্রনাথ লিখেছেন: “আমাদের দেশের পুরাবৃত্ত, ভাষাতত্ত্ব, লোক-বিবরণ প্রভৃতি সমস্তই এ পর্যন্ত বিদেশি পন্ডিতেরা সংগ্রহ ও আলোচনা করিয়া আসিয়া ছিলেন। [...] দেশে থাকিয়া দেশের বিবরণ সংগ্রহ করিতে আমরা একেবারে উদাসীন, এমন লজ্জা আর নাই।”

কবির এই কথাগুলোতে ‘লজ্জা’ শব্দটি ‘উপদেশ’ না ‘গালি’ তা পাঠকেরাই ঠিক করবেন। আমি বলতে চাচ্ছি, সেই উদাসীনতা কি আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পেরেছি? না, পারিনি। আমরা এখনো মনেকরি অন্য কেউ আমাদের ইতিহাস লিখে দিলেই ধন্য হই। এখনো কমিউনিটি লিডারদের মুখ থেকে শোনা যায়, আমাদের পূর্বপুরুষদের অবদান নিয়ে লিখতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে- নিজেরা না লিখলে লিখবে কে?

ভারতীয় উপ-মহাদেশ থেকে বর্হিবিশ্বে বাঙালির অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল বিলাতের পথ ধরে। এর সূচনাকারী কোনো রাজা-বাদশা, বণিক, পন্ডিত বা লেখক-কলামিস্টও নন। তারা ছিলেন লস্কর নামক খেটে-খাওয়া মানুষ। আমাদের এই পূর্বসূরিদের কেউ কেউ ‘লাঙ্গল টু লন্ডন’ বলে থাকেন। বলতেই পারেন। এর অর্থ হচ্ছে তাঁরা কৃষক ছিলেন অথবা কৃষিকাজ করেই লন্ডনে এসেছেন। এমনকি এও বলতে পারেন যে, তাঁরা কেউ কেউ নিরক্ষর ছিলেন। কিন্তু বলতে পারবেন না তাঁরা অশিক্ষিত ছিলেন। দেশে থাকতে কৃষিকাজ সম্পর্কে যেমন তাঁদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা ছিল। লস্করের কাজ করতে গিয়ে তেমনি জাহাজের অনেক কাজে শুধু পারদর্শী নয় বিশেষজ্ঞও ছিলেন। ইংরেজি ভাষায় লিখতে না জানলেও কথা বলতে পারতেন। সেজন্য বিলাতে, ডাঙ্গায় উঠেও তাঁরা নানা ধরণের ব্যবসা করেছেন। তাঁরা ভারতীয় খাবারের দোকান চালুর আগে এদেশে ইংলিশ, ইটালিয়ান, ফ্রেঞ্চ ইত্যাদি রেস্টুরেন্টে ওয়েটারি করেছেন, শেফ হিসেবে কাজ করেছেন। এই জাতীয় রেস্টুরেন্টের শেফ বা ওয়েটার হওয়া শুধু তখন কেন, এখনো চাট্টিখানি কথা নয়। রেস্টুরেন্ট পরিচালনায় প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জনের কারণেই তাঁরা শুধু ব্যবসায়ি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেননি ব্রিটেনের মানুষের খাদ্যাভ্যাসেরও পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন।

আমাদের পূর্বসূরিদের এই সকল ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত এদেশের মহাফেজখানাগুলোতে যেমন সুরক্ষিত আছে, তেমনি ইংরেজি ভাষায় লেখা শত শত ইতিহাস গ্রন্থে আছে, বর্তমানেও লেখা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। আমার মতো লোকতো বটে স্বয়ং আব্দুল গাফফার চৌধুরী, এম এর আখতার মুকুল সহ বাংলাদেশের অনেক খ্যাতিমান লেখক-সাংবাদিক-আমলাকেও, বিলাতে এই ‘লাঙ্গল টু লন্ডন’দের অধীনে, কীভাবে ক্যাশে কাজ করতে হয়, ওয়েটারি করতে হয়, কীভাবে সেলাইয়ের মেশিন চালাতে হয় তা শিখতে হয়েছিল। এই কথাগুলো এম আর আখতার মুকুল তাঁর লন্ডনে ছক্কু মিয়া বইতে রেকর্ড করে গেছেন। আব্দুল গাফফার চৌধুরী অসংখ্য লেখায়ও তা উল্লেখ আছে। আছে আরো অনেকের লেখায়ও।

তাই বলা যায়, ‘লাঙ্গল টু লন্ডনি’রা আমাদের মতো অক্ষরজ্ঞানীদের চাইতে অনেক বিষয়ে বেশী শিক্ষিত ছিলেন। তাঁরা প্রায় সকলেই বাংলার পাশাপাশি উর্দু, হিন্দি ও ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারতেন। প্রমাণ চান? পড়ে দেখুন, আজ থেকে ২৫১ বছর আগে, ১৭৬৫ সালে মির্জা শেখ ইতিশামুদ্দিন ইংল্যান্ড সফর করেন। তাঁর সেই সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে লখা ‘শিঘ্রুফ নামায়ে বিলায়েৎ’; মির্জা আবু তালিব খানের লেখা এবং ১৮১০ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ট্রেভেল্স অব মির্জা আবু তালিব খান, ইন এশিয়া, আফ্রিকা অ্যান্ড ইউরোপ’; ১৮৪০ সালে প্রকাশিত লিন্ডজিদেও লেখা ‘লাইফ অব দ্য লিন্ডজিজ গ্রন্থটি’; ১৮৬১ সালে প্রকাশিত হেনরি মেহিউ’র ‘লন্ডন লেবার অ্যান্ড দ্য লন্ডন পোওর’ ; ১৮৭২ সালে প্রকাশিত, যোসেফ সলটারের লেখা ‘দ্য এশিয়াটিক ইন ইংল্যান্ড: স্কেচেস্্ অব সিক্সটিন ইর্য়্সা এমং ওরিয়েন্টাল্স’ ইত্যাদি গ্রন্থগুলো।

আর বিশ শতকের ষাটের দশকে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের নিয়ে ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল কেথলিন হান্টারের লেখা ‘হিস্টরি অব পাকিস্তানিজ ইন ব্রিটেন’। এর পুরোটাই বাঙালিদের নিয়ে লেখা। বিলাতে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আগমনের ইতিহাসের একটি বড় অংশ জুড়েই আছে বাঙালির কথা। এগুলো কি ইতিহাস নয়? এ ধরণের অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায়। আমাদের পূর্বসূরিদের এই ইতিহাস এক বা দুই বছরের নয়, অন্তত সাড়ে তিনশ’ বছরেরও বেশী সময়ের। কিন্তু আমরা তা পড়তে রাজী নই, জানতে রাজী নই। খুঁজে বের করে নিয়ে এসে ইতিহাস হিসেবে নতুনভাবে হাজির করার জন্য নিজেরা সময় দিতে রাজী নই।

অথচ তৃতীয় বিশ্বের মানুষ হিসেবে, -আমাদের চাল নেই, চুলা নেই, ইতিহাস নেই, এটা নেই ওটা নেই, অর্থাৎ দেশ থেকে নিয়ে আসা ‘নেই’ শব্দটি এখনো দেদারছে ব্যবহার করেই চলেছি। এই মানসিকতা থেকেই আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ৮১তম জন্মদিবসের অনুষ্ঠানেও আমাদের পূর্বসূরিদের অর্জন ও অবদান নিয়ে লেখার অনুরোধ আসে। আর এই ইতিহাস লেখার বিপদ সম্পর্কে বলতে গিয়ে আব্দুল গাফফার চৌধুরী যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন তা’ই এখন তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

বলা বাহুল্য, কেউ নিজের কমিউনিটির অর্জন-অবদানের কথা তুলে ধরতে না চাইতে অনুরোধ করে বা কাউকে ভাড়া করে নিয়ে এসে লেখানোর দরকার নেই। এর বিপদ আমরা দেখেছি ১৯৮৪ সালে, ‘ইনার লন্ডন অ্যাডুকেশন অথরিটি’র, ‘সেন্টার ফর এশিয়ান স্টাডিজ’-এর পক্ষে, পাকিস্তানি ড. এফ এস ভাট্টিকে দিয়ে বিলাত-প্রবাসী বাংলাদেশীদের ইতিহাস লেখানোর উদ্যোগ থেকে। এর পরেও কেউ নিজ থেকে লিখতে গিয়ে একটু ভুল করলে আর রক্ষা নেই। সদল বলে সভা ডেকে লেখকের মুন্ডুপাত করি, সমাজছাড়া করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।

কথায় আছে, ‘ফুটবলের ট্রাই-ব্রকেরারে পেনালটি কিক মেরে গোল করলে খেলোয়াড়ের কপালে বাহবা জোটে না, কিন্তু মিস করলেই কেলেঙ্কারি।’ বিলাতে এসে দেখলাম বাঙালি ইতিহাস লেখকদের ভাগ্যে এই কেলেঙ্কারিই ঘটেছে ও ঘটছে। সে তুলনায় বাহাবা জোটেনি।

১৯৮৯ সালে এদেশে আসার পরে, সদ্য প্রকাশিত ‘প্রবাসীর কথা’ গ্রন্থটি পড়ি। দেশে থাকতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটি নাটকে যে লন্ডনি চরিত্রটি দেখে নিচক একটি চরিত্রই মনে করেছি। নাটকটি উপভোগ করেছি। শুধু আমি কেন, দেশে কারো কাছেই সেই নাটকটি সিলেট-বিদ্বেষী বলে মনে হয়নি। কিন্তু ‘প্রবাসীর কথা’ গ্রন্থটি পড়ে জানলাম এই চরিত্র সৃষ্টি করে নাট্যকার লন্ডনিদের অপমান করেছেন! এই একই গ্রন্থ পড়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত চরমপত্রের লেখক এম আর আখতার মুকুলের ‘লন্ডনে ছক্কু মিয়া’ শীর্ষক আরেকটি বইয়ের কথা জানতে পারি। আরও জানতে পারি, ৯৪ পৃষ্ঠা সম্বলিত এই গ্রন্থেও ‘সংযোজন ক্রোড়পত্র’ বাদ দিলে মূল পাঠ্যাংশের ৫৬ পৃষ্ঠার মধ্যে ৩৯ পৃষ্ঠাই নানা ধরণের ব্যঙ্গচিত্র।

নুরুল ইসলামের ভাষায়, ‘সেগুলোর অর্ধেকই আঁকা হয়েছে তথাকথিত অশিক্ষিত সিলেটি লন্ডনিদের জীবন নিয়ে’ (পৃ.-৩৩০)। ইত্যাদি ইত্যাদি।
অনেক খোঁজাখুজির পরেও ‘লন্ডনে ছক্কু মিয়া’ বইটি পাইনি। কিন্তু প্রবাসীর কথা গ্রন্থটির একের পর এক বিবরণ পড়ে তা বিশ্বাস করেছি। তারপর আমিও সময়-সুযোগে লেখকের মুন্ডুপাত করতে কখনো কসুর করিনি।

এমনকি তিনি যখন মৃত্যুপথযাত্রী হিসেবে লন্ডনে চিকিৎসাধীন ছিলেন তখনও। শেষপর্যন্ত বইটি পেলাম ২০১৫ সালে। পড়ে হতবাক! ‘প্রবাসীর কথা’ গ্রন্থটি পড়ে মনে হয়েছিল ছক্কু মিয়া হয়তো কোনো সিলেটির নাম। কিন্তু ‘লন্ডনে ছক্কু মিয়া’ বইটি পড়ে আমার চোখ একেবারে ছানাবাড়া। ছক্কু মিয়া স্বয়ং এম আর আখতার মুকুলের ছদ্মনাম। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে, ‘ব্রিটেনে বসবাসকারী বাঙালিদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এবং একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের অন্যতম শ্রেষ্ট নেতা মরহুম গাউসের খানের স্মৃতির উদ্দেশ্যে’।

‘লন্ডনে ছক্কু মিয়া’ বইটি যে একেবারে দুধেধুয়া তুলসিপাতা তা নয়, এমনকি ‘প্রবাসীর কথা’ও নয়। একজন সিলেটি হিসেবে আমি নিজে লিখলেও তা হবে না। ইতিহাস শুধু গৌরবের কথা নয়, অগৌরবের কথাও বলে। ইতিহাস লেখারও অনেক ধরণ থাকে। এম আর আখতার মুকুল তাঁর বিলাতের বাঙালিদের কথা গল্পের আদলে সুখপাঠ্য করে তুলে ধরেছেন। এতে মুক্তিযুদ্ধে সিলেটিদের ভূমিকার কথাও বাদ যায়নি। এমনকি লেখকের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমার নিজের অভিজ্ঞতার কোনো অমিল আমি খুঁজে পাইনি।

দ্বিতীয়ত ‘প্রবাসী কথা’ গ্রন্থটি পড়ে মনে হয়েছিল, অভিযোগগুলো আমল নিলে বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাটকগুলোও বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ, নাট্যকার নাটকের চরিত্রগুলোতো আফ্রিকার কোনো জঙ্গল থেকে আমদানি করতে পারবেন না, এমনকি ভাষাও না। কোনো অঞ্চলের ভাষা ব্যবহার করলে সে অঞ্চলের মানুষেরা যদি অপমানিত বোধ করেন তা হলে নাটকের চরিত্র ও ভাষা আসবে কোন দেশ থেকে? অথচ আমরা তা-ই করেছি।
তারপর যে গ্রন্থটি নিয়ে হৈচৈ হল সেটি মনিকা আলীর ‘ব্রিক লেইন’। এটিও ইতিহাস গ্রন্থ নয়, উপন্যাস। এর বিরুদ্ধেও আমরা আন্দোলন করলাম। লেখক গ্রান্টা পুরস্কার বা অন্য কোনো সম্মাননা যাতে না পান, সেজন্য যা যা সবই করেছি। অথচ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম থেকে আরম্ভ করে, লন্ডনে, বিশিষ্ট সমাজ-বিজ্ঞানী ও লেখক ড. রেণু লুৎফা পর্যন্ত খ্যাতিমান সিলেটি কোনো লেখক-বুদ্ধিজীবী মনিকা আলীর বইয়ে কোনো খারাপ দিক খুঁজে পাননি। আরও অবাক হবার মতো বিষয় যে, এখন আমরা এই মনিকা আলীকে নিয়েই গর্ববোধ করি, করছি।

এ তালিকায় তৃতীয় গ্রন্থ ছিল গোলাম মুর্শিদের ‘কালাপানির হাতছানি বিলাতে বাঙালির ইতিহাস’। বইটি প্রকাশের পরে একটি পত্রিকা, প্রথম পৃষ্ঠায় ছবিসহ খবরটি ছাপিয়েছিল। পরে বিভিন্ন ত্রুটি তুলে ধরে সমালোচনাও করে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের কমিউনিটি লিডারগণ পত্রিকাগুলোর ভূমিকায় সন্তুষ্ট হতে না পেরে সভা ডেকে লেখকের মু-ুপাত করেন। সেই অনুষ্ঠানগুলোর একটিতে দর্শক-শ্রোতা হিসেবে আমিও ছিলাম, এবং সম্ভবত আমি ছাড়া সকল শ্রোতাই ছিলেন বক্তা। একপর্যায়ে একজন নেতাকে কানে কানে প্রশ্ন করেছিলাম, ভাই,- আসলে লেখক সিলেটিদের বিরুদ্ধে কী লিখেছেন? আর কী কী ভুল তথ্য দিয়েছেন? উত্তরে তিনিও কানে কানে আমাকে বলেন, -‘সাংবাদিক মি. চৌধুরী সেগুলো তুলে ধরবেন, বইটি আমি পড়িনি’।

আমি নিজেও বইটির তথ্যগত ত্রুটি ও ভালো দিকগুলো তুলে ধরে একাধিক সমালোচনা লিখেছি। কোনো লেখকই প্রেরিতপুরুষ নন, সাধারণ মানুষ। তাঁদের লেখা গ্রন্থ কোন ধর্মগ্রন্থ নয় যে ভুল থাকবে না। সেজন্যই প্রত্যেক লেখকই, তাঁর গ্রন্থের বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা-সমালোচনা আশা করেন। আর আমার মতো হলেতো দ্বারে দ্বারে ঘুরেন সমালোচনা লেখাবার জন্য। প্রত্যেক লেখকই জানতে চান বইটি পাঠক-সমালোচকের দৃষ্টিতে কেমন হয়েছে, কোথায় কী ধরণের ত্রুটি রয়েছে। পরের সংস্করণে সংশোধন করেন। কিন্তু আমাদের কমিউনিটি নেতারা তাঁকেও পূর্ব লন্ডনে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন।

বক্তাদের অনেকেই বলেছেন, গোলাম মুরশিদ পূর্ব লন্ডনের মালবারি স্কুলে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। অথচ তিনি এই পূর্ব লন্ডনে, বর্ণবাদীদের হাতে শহিদ আলতাব আলীর নামে নামকরণ করা পার্কটির নাম বিকৃত করে বলেছেন, সেটি জাহাজিনেতা আফতাব আলী নামে নামকরণ করা হয়েছে! প্রায় সকলেই বলেছেন লেখক এই সকল বিকৃতি ইচ্ছাকৃতভাবেই করেছেন। ইত্যাদি ইত্যাদি।

এবার, এই আলতাব আলী পার্কে দীর্ঘদিন ধরে শোভা পাচ্ছে যে সাইন বোর্ডটি, সেটির পুরোটা নয়, মাত্র প্রথম কয়েকটি লাইনের দিকে দৃষ্টি দিতে চাই। বোর্ডটিতে লেখা আছে: “এই পার্কটি আলতাব আলীর স্মৃতির উদ্দেশ্য উৎসর্গ করা হয় ১৯৯৪ সালে। ২৫ বছর বয়েসী আলতাব আলী এই পার্কের পাশ্ববর্তী এডলার স্ট্রিটে তিন টিনএজ ছেলের বর্ণবাদি হামলায় প্রাণ হারান ১৯৭৮ সালের ৪ মে। [...] বাঙালি কমিউনিটি ব্যাপক বর্ণবাদী হামলার শিকার হয়েছে ১৯৭০-এর দশকের পুরো সময় জুড়ে। ইট ছোঁড়া হয়েছে তাদের ঘরের জানালায়, দরজায় ঢেলে দেয়া হয়েছে মল-মূত্র এবং বাঙালিদের আসা যাওয়া ‘নিষিদ্ধ’ থেকেছে টাওয়ার হ্যামলেটসের বেশির ভাগ এলাকাতে। ১৯৭৭ সালের লোকাল ইলেকশনের রাতে ঘটে আলতাব আলীর হত্যাকান্ড (?)।”

পুরো সাইনবোর্ডটির পাশাপাশি বানানের কথা না হয় বাদই দিলাম। মাত্র এই চারটি লাইনে যদি দৃষ্টি দেই, তা হলে প্রশ্ন জাগে, -‘এই পার্কটি আলতাব আলীর নামে উৎসর্গ করা হয়’ নাকি নামকরণ করা হয়? অর্থাৎ ‘নামকরণ’ ও ‘উৎসর্গ’ কি সমার্থক শব্দ? দ্বিতীয়ত ‘এই পার্ক’ বলতে কোন পার্ক? অর্থাৎ এটির আগে আর কোনো নাম ছিল কি? আলতাব আলী ১৯৭৮ সালের ৪ঠা মে মারা গেলে, তারও এক বছর আগে, ১৯৭৭ সালের লোকাল ইলেকশনের দিন মারা যান কীভাবে? ১৯৭৭ সালে কি লোকাল ইলেকশন হয়েছিল?

অথচ ভুলে ভর্তি এই সাইনবোর্ডটি দীর্ঘদিন ধরে পার্কে, ইতিহাস হিসেবে শোভা পাচ্ছে। শুনেছি তৎকালীন নির্বাহী মেয়রের আস্থাভাজন, লন্ডনের দুইজন খ্যাতিমান সাংবাদিক এই সাইনবোর্ড লিখেছিলেন। নিঃসন্দেহে ধারণা করতে পারি কাউন্সিলের কাজ হিসেবে ভালো বরাদ্দও পেয়েছিলেন। উভয়েই আবার সিলেটি। প্রশ্ন হচ্ছে, খোদ সিলেটি হয়েও এ ধরণের ভুলের জন্য আমাদের নেতারা কি তাঁদেরকেও সমাজচ্যুত করবেন? না করলে কেন করবেন না?

আরেকটি উদাহরণ দিই। নুরুল ইসলাম সিলেটিদের নিয়ে কেউ কোনো কথা বললেই তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। সেজন্য তাঁর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। কিন্তু সেই তিনিও তাঁর ‘প্রবাসীর কথা’ গ্রন্থেও ৪৬৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “মাঝি-মাল্লা হিসেবে সিলেটের মানুষের ইতিহাস অনেক পুরানো।” একই কথা লিখেছেন ইউসুফ চৌধুরীও।
কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় প্রাচীন কাল থেকেই সিলেটেতো বটে, পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে কৃষিকাজ সম্মানীত। কিন্তু বিশেষ করে মধ্যযুগ থেকে অন্তত সিলেটে নৌকা চালানো, সেভাবে সম্মানীত ছিল না, এখনো নয়। অথচ স্বয়ং ‘প্রবাসীর কথা’ ও ‘দ্য রুটস্ অ্যান্ড টেইল্স অব দ্য বাংলাদেশি সেটেলার্স’ গ্রন্থ দুটির লেখদ্বয় আমাদর পূর্বসূরিদের ‘মাঝি-মাল্লা’ বলেছেন! অথচ উভয়ে সিলেটি! সেজন্য তাঁদেরকে কি অভিযুক্ত করা যাবে না? গেলে করা হচ্ছে না কেন?

এভাবে সিলেটি লেখকদের লেখা ইতিহাস থেকে অনেক উদাহরণ দেয়া সম্ভব। আগেই বলেছি তাঁরা লেখক, প্রেরিত পুরুষ নন এবং তাঁদের কাছে ওহি নাজিল হয় না। ভুল তাঁদের হবেই। সেজন্য একজন লেখককে লেখার মাধ্যমেই তাঁর ভুলগুলো ধরিয়ে দিতে হবে। এই দায় বিশেষ কোনো অঞ্চলের, মানুষের বা সমাজকর্মীদের নয়, যিনি ইতিহাস জানেন তাঁর। তিনিই প্রতিবাদের ভাষায় প্রতিবাদ জানাবেন। কোনো লেখক যদি উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো অঞ্চলকে হেয় করার জন্য ইতিহাস লিখে থাকেন তা হলে সে ইতিহাস আস্তাকূড়ে নিপতিত হবে বাধ্য। গোলাম মোর্শেদ একজন খ্যাতিমান পন্ডিত ও গবেষক হিসেবেই সুপরিচিত। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু উল্লিখিত বইটি প্রকাশের পর থেকে তাঁর গবেষণা অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ। একজন লেখকের জন্য এর চাইতে বড় অপমান ও শাস্তি আর কী হতে পারে?

পরিশেষে বলি, কার্ল মার্কসের কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর ইংরেজি অনুবাদ যখন লন্ডনে প্রকাশিত হয়, তখন, জার্মান রাষ্ট্রদূত সেটি নিষিদ্ধ করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। তখন তাঁকে জানানো হয়েছিল, মন্দ ধ্যানধারণা নিষ্ক্রিয় করার জন্য ব্রিটিশ পলিসি হল তার অবাধ প্রচারের সুযোগ দেয়া। পন্ডিতদের ধারণা সম্ভবত সে কারণেই ব্রিটেনে কমিউনিস্ট আন্দোলন হয়নি, বিপ্লবও হয়নি। অথচ, কার্ল মার্কস লন্ডনেই বসবাস করতেন এবং তাঁর আশা ছিল ইংল্যান্ডেই প্রথম বিপ্লব হবে। আমরাও ব্রিটেনে থাকি। কিন্তু তাঁদের কিছুই কি শিখতে পারি না?

আপনার মন্তব্য

আলোচিত