শাহরিয়ার বিপ্লব

১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ২২:৩৮

টাঙ্গুয়ার রাজনীতি, রাজনীতির টাঙ্গুয়া

চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা প্রকৃতির কিছু উপাদানকে জেন্ডারাইজেশন করেছেন। যেমন খরস্রোতা উত্তাল পানির প্রবাহকে নদ, শান্ত স্নিগ্ধ ধীর বহতা প্রবাহকে নদী বলেছেন। তেমনি সূর্যের উত্তাপ আর প্রখরতাকে পুরুষের পৌরুষ বা ক্ষিপ্রতার সাথে এবং চাঁদের আলোকে নারীর সৌন্দর্য, স্নিগ্ধতা, কোমলতার সাথে মিলিয়েছেন।

বাংলাদেশেও একইভাবে টাঙ্গুয়ার হাওরকে নারীর সাথে মিলিয়ে চরিত্র  নির্ধারণ করেছেন। শুধু নারীই না, নারীর যে মহান রূপ, গর্ভধারিণী, মমতাময়ী, পরম আশ্রয়দাত্রী, ''মা'' এর সাথে তুলনা করা হয়েছে। সেই জন্যে এই হাওরটিকে,'মাদার ফিশারিজ' বলেছেন হয়তবা। মা মাছদের অভয়ারণ্য, মাছের প্রজনন শুধু না, মাছ, গাছ, কীটপতঙ্গ সহ বিভিন্ন প্রজাতির জীবের নিরাপদ মাতৃগর্ভ হলো এই জলাভূমিটি।

২০০০ সালে রামশার কনভেনশন অনুযায়ী সাইট ঘোষণার প্রপোজালে তাই বলা হয়েছে ''Tanguar haor plays an important role in fish production as it functions as a 'mother fishery' for the country. Every winter the haor is home to about 200 types of migratory birds. The haor is an important source of fish. There are more than 140 species of fresh water fish in the haor.''

বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৯ সালে এটিকে Ecologically Critical এরিয়া বলে ডিক্লেয়ার করেছে। এই Critical কিভাবে হলো বা কারা করল সেই দিকে আর যাচ্ছি না, তবে আমরা জানি।

এর পূর্বে ১৯৮৯ সনে প্রথম এশিয়ান wetlandএর তালিকায় নাম উঠে। ১৯৯২ সালে rashid & scott রিপোর্টে আন্তর্জাতিক পরিচিতি পায়। পরে অন্য একটি রিপোর্টে migratory water bird দের নিরাপদ আস্তানার তালিকাতেও টাঙ্গুয়া উঠে আসে ১৯৯৪ সালে।

১৯৯৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ইজারা প্রথা বাতিল করেন। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী দের নিয়ে যৌথ ব্যবস্থাপনায় টাঙ্গুয়ার সংরক্ষণ! বা উন্নয়ন! এর দায়িত্ব নেয়।

এই কথাগুলো বললাম এই জন্য যে আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেই সকার একটা বিশেষ ব্যবস্থাপনার মধ্যে এটিকে রেখেছে। যাকে মেডিকেল এর ভাষায় ICU বা CCU. বলতে পারি। পুরু এলাকাটি যদি মা হয় তবে তার সকল সম্পদ সন্তান তুল্য। ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যারা আছেন তারা সবাই লেবার ওয়ার্ডের স্টাফ। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তো আছেনই। আমার পুরা লিখাটা তাদের দিকেই।

উৎসব আমার প্রিয়। জোছনা আরো প্রিয়। ভরা পূর্ণিমা হলে তো পাগল পারা। আমার মতো গ্রামের প্রতিটা ছেলেমেয়ের জীবনেই চাঁদনী রাতে কবি হতে ইচ্ছা হয়, বাউল হতে, প্রেমিক হতে ইচ্ছে হয়। হৃদয়ে প্রেমের বান ডাকে। জোছনার মায়াবী নেশায় মাতাল হই আমরা। এটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতিকে যে ভালবাসতে পারে না - সে জোছনা বুঝে না। যে জোছনা বুঝে না -সে প্রেম বুঝে না। যে প্রেম বুঝে না - সে তো মা-মাটিকেই বুঝে না।।

সুতরাং যারা দেখতে, আনন্দ করতে, জোছনায় ভিজতে গেছেন, সেই হাজার হাজার জোছনা বিলাসীদের সাথে আমার সমর্থন প্রশ্নাতীত। আমিই বরং যেতে না পারার আক্ষেপে ভুগছি।

যারা জোছনা উৎসবের আয়োজন করেছেন, যারা সহযোগিতা করেছেন, যারা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন, যারা গণমাধ্যমে কাজ করেছেন,তারা অবশ্যই জোছনা প্রেম, হাওরের প্রেম, দেশপ্রেমের প্রশ্নে আমার মতো নগণ্য মানুষের চেয়ে অনেক অনেক ঊর্ধ্বে। তাদেরকে সালাম ও অভিবাদন জানাই।

কিন্তু এই যে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা বড় বড় কর্মকর্তা গন তারা কি জানেন না কি কি কারণে critical বলা হয়েছে। ecological tourism করতে গেলে কি কি ব্যবস্থা নিতে হয়। তারা কি জানেন না এই এলাকাটা শুধু মাদার ফিশারিজ না আরো বেশি কিছু । পরিযায়ী পাখীদের আশ্রয়স্থল শুধু না, এর সাথে এই এলাকার eco system এর একটা international link আছে। যে linkএর কারণে রামশার তিনটি criteria fulfilled হয়েছে।

CCU বা ICU তে কিভাবে আত্মীয় বা দর্শনার্থীদের দেখাতে হয় লেবার ওয়ার্ডের লোকজন যদি না জানে বা না মানেন তবে রোগীর অবস্থা কি হয় অনুমান করুন।

রাজনৈতিক নেতারা তাদের রাজনীতির স্বার্থে অনেক কিছুই করতে চাইবেন, রাজনীতি ও অর্থনীতির সব খেলাতে কি আপনারাও সাথী হবেন? তাহলে সমাজে বা সরকারে expart এর কি প্রয়োজন? আমাদের সমাজে অনেক জ্ঞানী শিক্ষিত রাজনীতিবিদ যেমন আছেন তেমনি অশিক্ষিত বা আমার মতো অর্ধ-শিক্ষিতরাও আছেন। রাজনীতির কুটিল খেলায় কিংবা অর্থনীতির নীতিহীন খেলায় কখনো কখনো একই মোহনায় মিলিত হন। কিন্তু আপনারা কেন?? যেখানে eco diversity-র প্রশ্ন জড়িত।। আপনারা কি কেন্দ্রীয় সরকারের এক্সপার্ট দের মতামত নিয়েছিলেন?? শহরের খাবার-পানীয় খাওয়াতে, শহরের যন্ত্র-শহরের শিল্পীর নিত্য শোনা কণ্ঠ শোনাতে ডেকেছেন পর্যটকদের??তাহলে পর্যটনের নতুন সংজ্ঞাই শিখতে হবে।

যাই হোক, আপাতদৃষ্টিতে তাহিরপুরের উপজেলা চেয়ারম্যান, তারুণ্যে উদ্ভাসিত, আধুনিকতায় অনন্য, প্রিয় ছোট ভাই জনাব কামরুল ইসলামকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। যতদূর জানি তিনিই এই উৎসবের উদ্যোক্তা (প্রথম আলো)। কামরুলকে যারা ধন্যবাদ দিতে কষ্ট পান তারা অবশ্য বলেন, এটা অন্য একজনের ব্রেইন-চাইল্ড প্রোগ্রাম। হতেই পারে।

তাকে আরেকটি কারণে ধন্যবাদ দিতে চাই যে, রাজনীতিতে তিনি সফলতার একটা দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। অন্যান্য উপজেলার বিএনপির চেয়ারম্যানরা যখন এক টন গম দিতে পারেন না নিজের ইচ্ছায় সেখানে তিনি তার ইচ্ছায়, তার ব্যবস্থাপনায়, তার নেতৃত্বে, তার সভাপতিত্বে এতবড় একটা প্রোগ্রাম সফলতার সাথে শেয করেছেন।

সবচেয়ে এনজয় করেছি প্রথম আলোর নিউজ পড়ে। সাবেক সাংসদ জনাব নজির হোসেন সাহেব বলেছেন সরকারি বেসরকারি সব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে, সরকারি ব্যবস্থাপনা ফেল করেছে, হাওরের সম্পদ লুট হচ্ছে। অথচ একই মঞ্চে সরকারী দলের বর্তমান সাংসদসহ আরো একজন সাংসদ উপস্থিত ছিলেন(সূত্র প্রথম আলো)।

সরকার এবং সরকারি organs কে যখন কেউ condemned করে তবে সরকারকে প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তির morality কই থাকে?

এ প্রসঙ্গে বলবো, সাবেক সাংসদের সময়েই বর্তমান বেসরকারি দুটি প্রতিষ্ঠান সরকারের সাথে co-managemente এর দায়িত্ব পায়। যে তের বছর সম্পদ উজাড় হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করলেন, তার পাঁচ বছর তিনিই এম পি ছিলেন।

তবুও তাঁর অভিযোগের সাথে আমি কিছুটা একমত। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় এক কর্মকর্তার সম্পর্কে যা শোনা যায়, তাতেই বোধগম্য, কি হয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, রোগ সারাতে রোগীকেই মেরে ফেলতে হবে। এত লুটপাটের পরেও হিজল করচ বাগ বেড়েছে। ঘাস লতা বেড়েছে। মাছ বেড়েছে। আমরা শুধু ব্যবস্থাপনাটাকে আন্তর্জাতিকীকরণ চাই।।

টাঙ্গুয়া নিয়ে রাজনীতি শুরু হয় মূলত এরশাদ শাসনামলে। সিলেটের সাবেক এম এন এ জনাব মোয়াজ্জেম হোসেন সাহেব এই ফিশারিটি লিজ আনেন তখন। মোয়াজ্জেম সাহেবের সাথে এরশাদের সম্পর্কের কারণে বিরোধী দলের বক্তব্যতেও চলে আসে টাঙ্গুয়া প্রসঙ্গ। সে অনেক কথা। এরশাদের শেষ দিকে মোয়াজ্জেম সাহেবের অধীনস্থ স্থানীয় দুইজনের হাতে থাকা ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ধারাবাহিক যুদ্ধের খবর আমরা তখন শুনতাম কল্পকাহিনীর মতো। ১৯৯১ সালে এই দুজনের একজন চলে যান, তৎকালীন সাংসদ আমার রাজনৈতিক গুরু,যার কাছ থেকে 'যে গল্পের শেষ নাই' থেকে রাজনৈতিক পড়ালেখার সুযোগ হয়েছিল, আমার প্রিয় জনাব নজির হোসেনের কাছে। দুইজন একসাথেই ছিলেন। কিন্তু '৯৬ সালে সৈয়দ রফিকুল হক সাহেব এমপি হলে নজির ভাইয়ের সেই মিত্র চলে যায় রফিক সাহেবের নিয়ন্ত্রণে। অবশ্য এর মধ্যেই সৈয়দ রফিকুল হক সাহেব লিজ প্রথা বাতিল করার ব্যাপারে তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদকে বুঝাতে পেরেছিলেন।

তারপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।। ব্যাস। বাতিল হলো টাঙ্গুয়া নিয়ে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ। যদিও হাইকোর্টে গিয়েছিলেন টাঙ্গুয়ার আংশিক নিয়ন্ত্রণ নিতে কেউ কেউ।

  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত