আবদুল হাই আল হাদী

২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ১৩:৫৫

সারি ও লুভা নদীর দূষণ বন্ধ হোক

আন্তর্জাতিক নদী দিবস আজ

সিলেটের সারি ও লুভা নদীর পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। তীব্র মাত্রায় এসিড জাতীয় পদার্থের কারণে নদী দুটির পানি নীল বর্ণ ধারণ করেছে। কয়লা খনি থেকে নির্গত এসিড জাতীয় পদার্থকে পানি দূষণের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের (এম.এস.পি সিবি) বার্ষিক প্রতিবেদনে এ উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ এ নদী দুটির পানির ভয়াবহ মাত্রার দূষণের খবরে পরিবেশবাদী ও সচেতন মানুষকে বিচলতি করে তুলেছে।


ভারতের গণমাধ্যমে প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (পিটিআই)’র বরাত দিয়ে সংবাদটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী জানা গেছে, মেঘালয় রাজ্যের জৈন্তা পার্বত্য জেলার অন্যতম মাইন্ডু (Mynthdu)  ও লুখা (Lukha)  নদীর পানিতে ভয়াবহ দূষণ দেখা দিয়েছে। দূষণের কারণেই নদীর পানি বিবর্ণ হয়ে উজ্জ্বল আকাশি বর্ণ ধারণ করেছে। মেঘালয় রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (এম.এস.পি. সি.বি) তাদের ২০১২ সালের বার্ষিক রিপোর্টে কয়লা খনি থেকে নির্গত এসিড জাতীয় পদার্থকে এ এলাকার পানি দূষণের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এম.এস. পি.সি.বি’র সদস্য সচিব জে.এইচ. নেংগং গণমাধ্যমকে আক্রান্ত নদীগুলো থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য কর্মকর্তা নিয়োগের কথা জানিয়েছেন। দিল্লিভিত্তিক কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগার জানিয়েছে, উচ্চ মাত্রার এসিডের জন্য ওই পানি মানুষের ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সেখানকার পানির তলদেশে ধুলা সাদৃশ্য উপাদানের উপস্থিতিও পরিবেশবিদরা লক্ষ্য করেছেন। নদীগুলোর অদূরে অবস্থিত সিমেন্ট কারখানার বায়ু বাহিত ছাইয়ের দিকে নির্দেশ করে তারা বলেছেন-এটা দূষণের সম্ভাব্য কারণগুলোর একটি হতে পারে। এছাড়া চুনাপাথরের খনি থেকে নির্গত পদার্থকেও এ দূষণের জন্য ও দায়ী করা হচ্ছে।

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মাইন্ত্রু ও লুখা নদীর পানি ভয়াবহ ভাবে দূষণে আক্রান্ত এবং এজন্য সেখানকার সরকার ও জনগণ উদ্বিগ্ন হয়ে ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবেন-এটাই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত। প্রশ্ন আসতে পারে, এতে বাংলাদেশের জনগণের উদ্বিগ্ন হওয়ার কী আছে। ব্যাপারটি বুঝার জন্য এখানে কিছুটা বিস্তৃত আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হবেনা। ভারতের মাইন্ত্রু ও লুখা নদী বাংলাদেশে যথাক্রমে সারিনদী ও লুভা নদী নামে পরিচিত। মাইন্ত্রুু নদী জোয়াইয়ের মিহমাইন্ত্রু (Mih-Mynthdu)  নামক স্থানে উৎপত্তি লাভ করে পুরো জোয়াই শহর ঘুরে বাংলাদেশের দিকে প্রবাহিত হয়েছে। আমলারিম সাবডিভিশনের কাছে ‘লেসকা’ নামক স্থানে লামু ও উমসিয়ারিং নামক দুটি নদীকে সঙ্গে করে জৈন্তাপুরের লালাখাল দিয়ে এটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে সারি নামে প্রবাহিত হয়েছে। সারি নদী জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও সিলেট সদরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ছাতকে সুরমা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। পথিমধ্যে এর সাথে কুইগাঙ, পিয়াইন, ধলাইসহ আরো ছোট বড় কয়েকটি নদী এর সাথে যুক্ত হয়েছে। এটি স্থানে স্থানে গোয়াইন ও চেঙেরখাল নামেও পরিচিত।

অপরদিকে, মেঘালয়ের লুখা নদী জৈন্তা পার্বত্য জেলার নরপুহ বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রম এলাকা থেকে উৎপত্তি লাভ করে খাতড়–ং নামক স্থানে লুথনা নদীর সাথে মিলিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। কানাইঘাট উপজেলার মূলাগুল এলাকা দিয়ে প্রবেশ করে ‘লুভাছড়া’ নাম ধারণ করে প্রবাহিত হয়ে চড়িপাড়া এলাকায় লুভারমুখ নামক স্থানে এটি সুরমার সাথে মিলিত হয়েছে। ‘খাতড়–ং’ এলাকায় যেখানে লুথনা নদী লোখার সাথে সেখানেই এ নদীর রং পরিবর্তন হয়েছে। লুথনা নদীর উৎপত্তি হয়েছে মিন্দিহাতি ও লুমশনং এলাকা যা কয়লা ও চুনাপাথরের ভারি উত্তোলন কাজের জন্য সুপরিচিত।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মেঘালয়ের মাইন্ত্রু ও লুখা নদী যথাক্রমে সারি ও লুভা নদীর সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। নামকরণ ও অবস্থানগত পার্থক্য ছাড়া এগুলোর মধ্যে কোন ব্যবধান নেই। মাইন্ত্রুর পানিই সারি’র পানি; লুখা নদী মানেই লুভা নদী। সে নদী দুটির পানিই সারি ও লুভা নদীতে প্রবাহিত হয়ে অবশেষে সুরমায় মিলিত হয়েছে। উজান থেকে প্রবাহিত বলে সে নদী দুটির যেকোনো নেতিবাচক প্রভাব ভাটির নদীতে পড়তে বাধ্য। তীব্র মাত্রায় এসিড জাতীয় পদার্থের কারণে নদীর পানি বিবর্ণ হওয়ার যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তা আমরা সারি ও লুভার ক্ষেত্রেও প্রত্যক্ষ করছি। এ দুটির পানিও নীল, উজ্জ্বল আকাশী বর্ণের।

সিলেটের সারি নদী পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্যস্থান। লুভাতেও পর্যটকদের আনাগোনা দিন দিন বাড়ছে। মূলত: নদীর নীল পানি পর্যকটদের মুগ্ধ করে। কিন্তু আপাত: মনোমুগ্ধকর হলেও পানির এ নীল বর্ণই উদ্বেগের কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ভারতের সরকারী সংস্থার মতানুসারে আমরাও মনে করছি যে, সারি ও লুভা নদীর পানিতে তীব্র মাত্রায় এসিড জাতীয় পদার্থের উপস্থিতি রয়েছে এবং এজন্য এ নদী দ্বয়ের পানি নীল রং ধারণ করেছে। তাছাড়া পানির তলদেশে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে ধুলা জাতীয় সাদা পদার্থের উপস্থিতি দেখা যায় যা নদীর উজান থেকে নেমে আসা সিমেন্ট কারখানার বায়ুবাহিত ছাই বলে আমাদের বিশ্বাস। অধিকন্তু সারি নদীর প্রায় ৩০ কিলোমিটার উজানে নদীতে বাঁধের মাধ্যমে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা আমরা জানি। সেটির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব নদীর পানিতে পড়া খুবই স্বাভাবিক। মোট কথা, সারি ও লুভা নদীর নীল স্বচ্ছ পানি যে মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে, ভারতীয় সংস্থার তথ্যের প্রেক্ষিতে তা আমরা নিঃসন্দেহ ধরে নিচ্ছি।

সারি নদীর সাথে জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও সদর এলাকার প্রায় সব খাল বিল, হাওড়-বাওড় ও নালা-ডোবা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এ নদীর অস্তিত্বের সাথেই এখানকার জীবন ও প্রকৃতির অস্তিত্ব নির্ভরশীল। বিশেষ করে, বাংলাদেশের একমাত্র জলাবন রাতালগুলের প্রাণ ও জীবের অস্তিত্ব নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত এর সাথে। লুভা নদীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। দু’টি নদীই শেষ পর্যন্ত সুরমায় মিলিত হয়েছে। তাই এ নদী দুটির দূষিত পানি সুরমার পানিকেও বিষাক্ত করে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করতে পারে আমাদের আশংকা।

বাংলাদেশে বায়ু, পানি ও মাটি দূষণের ঘটনা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীব বৈচিত্র্যের সুরক্ষার জন্য এখানকার প্রচেষ্টা পর্যাপ্ত নয়। ভারতীয় গণমাধ্যমে যে সংবাদ সারি ও লুভা নদীর উজানের ব্যাপারে  প্রকাশিত হয়েছে, তা বাংলাদেশের কোন সরকারি সংস্থার নজরে পড়েছে বলে মনে হয়না। তাই আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব এ নদী দুটি থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে সরকারি বা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে উপযুক্ত গবেষক দিয়ে পরীক্ষা করানো প্রয়োজন এবং সে রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করে করণীয় ঠিক করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে ভারতের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর এ সংশ্লিষ্ট রিপোর্ট ও কারিগরি সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। তা-না হলে এ দূষণ প্রকৃতি ও জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। সিলেটে পরিবেশ প্রতিবেশ সর্বোপরি জীবন ও প্রকৃতির অস্তিত্বের স্বার্থেই ব্যাপারটিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেওয়া উচিত।


লেখক: সভাপতি, সারি নদী বাঁচাও আন্দোলন

আপনার মন্তব্য

আলোচিত