০৫ অক্টোবর, ২০১৬ ১৬:২১
নার্গিস অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। অল্প বয়স, চোখে রঙিন স্বপ্ন। এই বয়সে নতুন যা দেখে তাতেই তার আগ্রহ।
সবচেয়ে বেশী আগ্রহ নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি। নিষিদ্ধ জিনিস বলতে মা যা নিষেধ করেন তার সবটাই।তা প্রেমের উপন্যাস পড়া হোক আর স্কুল পালিয়ে শিরিনদের বাড়ি গিয়ে চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া হোক, সবটাই তার ভালো লাগে। হঠাত একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে নার্গিস আবিষ্কার করল বাড়িতে অচেনা একটা উঠতি বয়সের ছেলেকে।
-“মা, বাইরের ঘরে বসা ছেলেটা কে?”
-“বদরুল, তর মাস্টর।আজ থেকে তরে পড়াইতো। থাকতোও আমরার সাথে। লজিং মাস্টর”।
-আমি তার কাছে পড়তাম না, মা। ফোয়া আমার দিকে ড্যাবড্যাব করিয়া চাইয়া রইছে, যানি গিল্লা খাইবো!”
-“অত মাতিস না ফুরি, পড়ন লাগত। তর বাপে ঠিক কইরা দিছে”।
গল্পের শুরুটা হয় এভাবেই। এভাবেই নার্গিসের সাথে বদরুলের প্রথম দেখা।
গল্পটা অন্য রকম হতে পারত। কিন্তু গৎবাঁধা সাধারণ সেই বাংলা সিনেমায় গিয়ে ভাগ্য ঠেকে। পড়ার টেবিলে বসে গণিতের সূত্র আর বিজ্ঞানের তত্ত্ব বিশ্লেষণের সাথে সাথে নার্গিস আর বদরুলের সম্পর্ক আগায়। পুরোনো নিয়মে সুন্দরী ছাত্রীর প্রেমে পড়ে বদরুল।
-“নার্গিস,কাল স্কুলে যাবার দরকার নেই।তারচেয়ে বরং আমার ক্যাম্পাসে চলে এস। দুজনে মিলে ঘুরব অনেক”।
-“মা জানলে রাগ করব। যাইমু না”।
-“তুমি না আসলে খুব খারাপ হবে কিন্তু! নিজের মান সম্মান বাঁচাতে চাও তো চলে এস”!
পাশের ঘর থেকে মা সব শুনতে পায়। পরের দিন থেকে বদরুলকে আর কখনো নার্গিসদের বাড়ির আশেপাশে দেখা যায়নি।
৫ বছর পরের কথা। নার্গিস এখন সাবালিকা যুবতী। স্কুল, কলেজের পাঠ চুকিয়ে সে এখন সম্মানে পড়ুয়া ছাত্রী। ধার্মিক হলেও আধুনিকা।
হঠাত একদিন ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে পুরোনো চেহারার সামনে থমকে দাঁড়ায় নার্গিস। কৈশোরের দুঃস্বপ্ন খুব আকস্মিক এসে দাঁড়ায় তার সামনে।
মনে পড়ে সেই সব দিন, এই লোকটা তারই বাড়িতে বসে তার শরীর চেয়েছিল। মন না। খুব বড় বিশ্বাসটা সেদিন ভেঙেছিল নার্গিসের।তার উপর সেই বাবা মার শাসন, চোখ রাঙানি, ঘরবন্দি হওয়া সব এই লোকটার জন্য। তারপর কতকাল বাবা মা তাকে বিশ্বাস করেনি! সব কিছু মুহূর্তের মাঝে তোলপাড় করে নার্গিসকে।
বদরুল কথা বলার জন্য আগায়।
-“আপনার সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। আমি আপনাকে ছাড়া খুব ভালো আছি বদরুল। দয়া করে আমার রাস্তা ছাড়ুন”।
-“নার্গিস, তোমাকে ভালোবেসে আমি এতদিন পর ফিরে এসেছি। আমাকে তুমি গ্রহণ কর। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই”।
-“আপনার কিছু বলার থাকলে আমার বাবার সাথে কথা বলতে পারেন”।
এরপর আর কিছুই মনে নেই নার্গিসের। কিন্তু যা ঘটেছে তা দেখেছে শতাধিক জনতা। পরবর্তীতে প্রযুক্তির উন্নয়নে সারা দেশ।
বদরুল সাহেব মাথায় রাগ চেপে রাখতে পারেন নি। ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত করেছেন তার ভালোবাসা নার্গিসকে।
এই বদরুল শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। হ্যাঁ, আমার স্বীকার করতে লজ্জা হচ্ছে সে আমারই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তারচেয়ে বড় লজ্জা সে একটি হাইস্কুলে শিক্ষকতা করে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়ে সর্বোচ্চ সম্মানের পেশাকে আপন করা একজন মানুষ ভালোবাসার কি অসাধারণ দৃষ্টান্তই না স্থাপন করে গেল!
এরপরও নিন্দুকদের কথা থেমে নেই। কেউ বলছে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা না করার ফল বেরুচ্ছে। মেয়েরা বাইরে ইচ্ছে মত ঘুরবে আর এ সব হবে না?
কেউ বা বলছে, “মেয়েটার দোষ না থাকলে কি আর ছেলেটা মেরে ফেলতে যায়? বুঝলেন ভায়া, এক হাতে তালি বাজে না! নিশ্চয়ই মেয়েটার কোন দোষ ছিল”।
যত দোষই থাক, বদরুল কি সত্যিই অধিকার রাখে তার জীবন নিয়ে নেবার? কুপিয়ে মাথার খুলি থেকে মগজ বের করে দেবার? ইচ্ছে করল, আর খুন করে ফেললাম? খুব সহজ??
কি জানি, পুরুষতান্ত্রিক ধর্মীয় সমাজ ব্যবস্থায় অধিকার রাখে হয়ত!
কিন্তু আমার দেশের মানুষ কি সত্যিই অনন্য। আসামি কে ধরে পিটিয়েছে, লম্বা হাতের আইনের কাছে তুলে দিয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ করতে হয়ত সামান্য সময় নিয়েছে, কিন্তু করেছে তো!
শুনেছি বদরুল দেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রলীগের সহ সাধারণ সম্পাদক ছিল। বিচার হবে এমন অনেক আশ্বাসের ভিড়ে এখনও নিশ্চয়ই আড়ালে লুকিয়ে আছে বদরুলের অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী।
হয়ত এই বদরুলও ছাড়া পেয়ে যাবে। আমরা আরও একবার তনু হত্যার মত “নার্গিস হত্যার বিচার চাই” বলে রাস্তা কাঁপাবো।
আমরা আম জনতা শুধু রাজপথ কাঁপাতে পারি, বদরুল রক্ষাকারীদের মন নয়।
আপনার মন্তব্য