২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ১৬:১৯
কল্পনায় যেই লোকটার হাত ধরে আমার আশৈশব বেড়ে ওঠা, মাঝ রাতে মায়ের বকুনি এড়িয়ে লেপ কাঁথা মুড়ি দিয়ে সারা রাত জেগে যার বই পড়ে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে বালিশ ভেজানো, যার লেখা পড়ে কৈশোর আর প্রথম যৌবনে বুকের মাঝে হালকা শির শির করা প্রেমের অনুভূতি টের পাওয়া, প্রথম যৌবনে যার হাত ধরে প্রথম প্রেমের অনুভূতি টের পাওয়া, যার উপন্যাস পড়ে পড়ে একই সাথে জীবনমুখী আর কল্পনাপ্রেমী হয়ে বেড়ে ওঠা তার নাম হুমায়ুন আহমেদ।
জীবনকে চিনতে শেখা আমার এই লোকটার হাত ধরেই। হোক না তা কল্পনায়! কিন্তু এত নিবিড় করে এই মানুষটা আমার বেড়ে ওঠার সাথে জড়িয়ে ছিল যে তাকে আমারই ঘরের লোক বলে মনে হত,যেন চাইলেই ছোঁয়া যায়,ইচ্ছে করলেই গল্প জুড়ে দেয়া যায়!
এই মানুষটার লেখা এত টানত আমায়- যে কত কাল গেছে, শুধু একজন লেখকের নামই জানতাম । কেউ জিজ্ঞেস করলেও অন্য কোন লেখকের নাম আওড়াতে পারতাম না! খানিকটা বড় হবার পর কিছুটা অন্য লেখক কে না জানার লজ্জায় আর হুমায়ুনের প্রায় সব লেখা পড়া শেষ হবার যন্ত্রণায় অনেকটা অনাগ্রহের সাথেই অন্য লেখকের বই হাতে নেয়া আমার। তাই আমার ব্যক্তিত্ব যেমন ভাবেই গড়ে উঠেছে, তার পেছনে এই পরম গুণী জনের বিশেষ এক অদৃশ্য হাত আছে। এই মানুষটা কে নিয়ে আমার আবেগের জায়গা কম না!
লোকমুখে অসংখ্যবার শুনেছি হুমায়ুন আহমেদ ভালো লেখক নয়, তার সব লেখা প্রায় একই রকম, নিজের লেখার নকল নিজেই করেন, করেন বিদেশী লেখারও অনুকরণ! সে যত যাই ই বলুক না কেন, এ কথা অনস্বীকার্য যে যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশে বাঙালিকে সাহিত্যের দিকে টেনেছে একা হুমায়ুন আহমেদ বাঙালি গুণীর কদর বোঝে না।
উন্নত বিশ্বে সাহিত্যিকদের দিন শেষে পেটের কথা, পরিবারের কথা চিন্তা করতে হয় না। তাদের যেন সাহিত্য ধ্যানমগ্নতা না কাটে তার জন্য সরকারই ব্যবস্থা করেন। আর আমাদের দেশে সকল প্রকার শিল্প ও সাহিত্য কর্মের জন্য ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে হয়! সেই দেশে থেকেও সাহিত্যের প্রতি কি প্রবল মমতা নিয়েই না তিনি কেবল সাহিত্য চর্চার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরী ছেড়ে দিলেন! নিজে। ছোটখাটো এই মানুষটা নিজের তৈরি বিখ্যাত চরিত্র মিসির আলী আর হিমু চরিত্রের মতই আশ্চর্য রকম রহস্যময়।
মাঝে মাঝে বড় আফসোস হয়, এ প্রজন্ম কখনো জানবে না কি উত্তাল জনতা তার ধারাবাহিক নাটক “কোথাও কেউ নেই” এর পরিসমাপ্তি পছন্দ না হওয়ায় তাকে দৃশ্যপট পরিবর্তন করার অনুরোধে বিক্ষোভ করে! সেদিন ও তিনি তেমনি নির্ভীক দাঁড়িয়ে ছিলেন যেমন ভাবে জীবনের শেষ দিন গুলো ক্যান্সারের সাথে লড়েছেন!
এ প্রজন্ম জানবে না নব্বই এর দশকে বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবার কি অধীর আগ্রহ নিয়েই না অপেক্ষা করেছে বিটিভির ৮ টার বাংলা সংবাদের পর তার নাটক দেখার জন্য!হিন্দি আর পশ্চিমা সিনেমার ভিড়ে তারা কখনো “আগুনের পরশমণি” দেখে নিজের অজান্তে কাঁদবে না।
অনেক কালের স্বপ্ন এই গুণীজনকে অন্তত একবার স্পর্শ করার! তার জীবদ্দশায় সেই সৌভাগ্য আমার হয়নি। সম্প্রতি সুযোগ হল গাজীপুরের নুহাশ পল্লী ঘুরে আসার।
সেই নুহাশ পল্লী, আমার স্বপ্নের প্রবাদ পুরুষের নিজ হাতে গড়া যার প্রতি ইঞ্চি মাটি। সাথে সেই প্রবাদ পুরুষের সমাধিস্থল। যদিও তাকে এভাবে দেখার কোন ইচ্ছাই আমার ছিল না কোনকালেই।তবু কিছুটা মনের বিরুদ্ধেই যাওয়া।সান্ত্বনা এটুকুই যে তিনি নেই তো কি হয়েছে, তার যত্নে গড়া নুহাশ পল্লী দেখা কি কম সৌভাগ্যের!
শালবনের মাঝ দিয়ে রাস্তা, হঠাৎ যেতে যেতে পরিচিত এক বিশাল দরজা। বাড়ির ভেতর পা দিয়েই চোখে পড়ল চির চেনা এক জায়গা।কোন দিন না যাওয়া এক জায়গা অথচ কত চেনা। হয় নাটক বা সিনেমায় দেখা নয়ত গল্পে পড়া। নেকেরই হয়ত জানা নেই যে হুমায়ুন স্যারের গড়া নুহাশ পল্লীতেই তার প্রায় অর্ধেক এর বেশী নাটক চিত্রায়িত হয়েছে। তিনিই বাংলাদেশে প্রথম শুটিঙয়ের একটি পুরো সেট তৈরি করেছেন।
ঢুকেই সেই কাঠের বাড়িটার উপর অনেকক্ষণ একা বসে থাকলাম। অনুভব করার চেষ্টা করলাম তার গন্ধ,খোঁজার চেষ্টা করলাম তার চিহ্ন। অসংখ্য অসাধারণ শিল্পের মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়া নাম না জানা অনেক অনেক গাছের ভিড়ে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় তার মূল বাড়ি বৃষ্টি বিলাসের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালাম। বাড়িটা এখন বাণিজ্যিকভাবে গেস্ট হাউজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।অথচ এটা হতে পারত একটা স্মৃতি পাঠাগার। কোথাও চোখে পড়ল না তার স্মৃতি সংগ্রহশালা।তবে কি নিজের স্বপ্নের নুহাশ পল্লীতে তার স্বপ্নই কুঁড়ে কুঁড়ে মারা যাচ্ছে?
সমাধিস্থলের সামনে গিয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি, রাখার চেষ্টাও করিনি। কখন যে চিবুক বেয়ে মুক্ত ঝরেছে, বলতে পারিনা! সত্যিই, “নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে” তার কথাই সত্য হল। নুহাশ পল্লীর মাটিতে আমার প্রবাদ পুরুষ ঘুমিয়ে আছে শান্তির ঘুম। নিশ্চয়ই জ্যোৎস্না রাতে এখনো তার গাইতে ইচ্ছে করে “চাঁদনি পসরে কে আমায় স্মরণ করে,কে আইসা দাঁড়াইসে গো আমার দুয়ারে...!”
আপনার মন্তব্য